এই গোপন চক্রান্তের ফল ফলতে বিলম্ব হল না।
ডার্নের মুক্তির উপলক্ষে সেদিন সন্ধ্যায় পারিবারিক উৎসবে মেতেছেন ডাক্তার ম্যানেট–এমন সময়ে অস্ত্রধারী নাগরিকেরা গিয়ে সাধারণতন্ত্রের নামে দ্বিতীয়বার বন্দী করলো ডার্নেকে! অপরাধ, দেশদ্রোহ…জনসাধারণের উপর অত্যাচার! অপরাধ নিজের হোক বা পূর্বপুরুষের হোক, কথা একই।
এই আচমকা বিপদ সবাইয়ের মাথায় এসে পড়লো যেন নীল আকাশ থেকে বজ্রের মত।
ডার্নে আবার কারারুদ্ধ!
পরদিনই বিচার। প্রশ্ন উঠলো, আগের দিন যাকে অভিযোগ থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, আজ আবার তাকে পুনরায় অভিযুক্ত করা হল কেন? তার উত্তরে একখানা কাগজ দাখিল হল আদালতে।
ব্যাস্টিল অধিকারের দিনে ডাক্তার ম্যানেটের ১০৫নং কারাগহুর থেকে যে কাগজখানা উদ্ধার করেছিল ডিফার্জ, এটা সেই কাগজ। ম্যানেট তার কারাবাসের দিনে নিজের হাতে লিখে রেখেছিলেন–অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগ! কে সেই অত্যাচারী? অত্যাচারী–মার্কুইস এভরিমন্ডি! এভরিমন্ডি-মাকুইসের আবেদনেই ম্যানেট বিনা বিচারে আঠারো বছর বন্দী ছিলেন ব্যাস্টিলের নির্জন কারায়।
হায় দুর্ভাগা ম্যানেট!
এই কাগজের কথা তার একেবারেই স্মরণ ছিল না!
হ্যাঁ, এভরিমন্ডি-বংশ যে তার কারাবাসের কারণ, তা তিনি জানতেন। মাকুইসের আহ্বানে একদা তাকে যেতে হয়েছিল এক পীড়িতা নারীর চিকিৎসার জন্য। সেখানে গিয়ে বিকারগ্রস্ত রোগিণীর প্রলাপ থেকে এক ভয়াবহ কাহিনী শুনতে পান তিনি। রোগিণীর ভাইকেও দেখতে পান ঐ গৃহে, সে তখন মরতে বসেছে। তার বুকে তরোয়াল বিদ্ধ হয়েছে! রোগিণীর পিতাও নিহত হয়েছেন ঐ গৃহেই, এ-বৃত্তান্তও ম্যানেটের কানে আসে!
ম্যানেট ফিরে এলেন। কিন্তু মাকুইসের ভয় রইলো–তার এ অনাচারের ইতিহাস হয়তো ম্যানেট একদিন প্রকাশ করে দেবেন। দণ্ডের ভয় না থাক, কলঙ্কের ভয় মার্কুইসের ছিল। তাই তিনি ব্যবস্থা করলেন ম্যানেটকে সরিয়ে ফেলবার। আচমকা তাকে ধরে ব্যাস্টিলে বন্দী করা হল।
রাগে দুঃখে প্রতিহিংসার কামনায় ম্যানেট বুকের রক্তে লিখেছিলেন– এভরিমন্ডির বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগের বিবরণ। সেদিন প্রতিহিংসায় অন্ধ ম্যানেট স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি যে ঐ বিবরণ থেকেই আজ তার প্রাণাধিকা কন্যার প্রিয়তম স্বামীর জীবনান্ত ঘটবে। এর চেয়ে নিষ্ঠুর পরিহাস নিয়তির ভাণ্ডারে তো কিছু থাকতে পারে না!
এভরিমন্ডি! ম্যানেটের শত্রু ওরা। কিন্তু কন্যার মুখ চেয়ে এভরিমন্ডি-বংশধরকে তিনি হৃদয়ে স্থান দিয়েছিলেন। তখন কি জানতেন যে, তিনি এভরিমন্ডিকে ক্ষমা করলেও, আর-একজন কেউ দুনিয়ায় আছে–যার কাছে এভরিমন্ডি-বংশের ক্ষমা লাভের কোন আশাই নেই?
হ্যাঁ, এমন একজন আছে দুনিয়ায়। সে হল মাদাম ডিফার্জ।
জামাতার স্বপক্ষে তবুও ম্যানেট কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু আদালত আর সে-কথায় কর্ণপাত করলো না। এভরিমন্ডি-বংশের যে পৈশাচিক অত্যাচারের বিবরণ ম্যানেটের লিখিত অভিযোগে প্রকাশ পেয়েছে, তাতে স্বয়ং ম্যানেটের কোন কথাও। কেউ আর শুনতে চাইলো না, অপরাধীর স্বপক্ষে।
মৃত্যুদণ্ডের আদেশ প্রচারিত হল।
ম্যানেট লুটিয়ে পড়লেন ডার্নের পায়ের কাছে। তিনিই ঠেলে দিয়েছেন প্রিয় জামাতাকে, মৃত্যুর মুখে। তিনিই নিজের হাতে প্রিয় কন্যাকে সাজিয়ে দিয়েছেন বিধবার বেশে! তিনিই নয়ন-মণি দৌহিত্রীকে করে দিয়েছেন পিতৃহীনা! হায় ভাগ্য!
ডার্নে স্থির, গভীর, অবিচলিত। লুসীও তাকে বিদায় দিলেন কিছুমাত্র বিচলিত না হয়ে। যাও প্রিয়তম! আমার জন্য বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না তোমায়। আমিও এলাম বলে!–এই হল লুসীর বিদায়-বাণী।
জানা গেল–অভিশপ্ত এভরিমন্ডি-বংশের শেষ সন্তানকে পরদিন বেলা তিনটেয় গিলোটিনে নিক্ষেপ করা হবে।
০৮. মৃত্যু ও অমৃত
পাগলের মত ডাক্তার ম্যানেট ঘুরতে লাগলেন শহরের পথে-পথে। যে-যেখানে বন্ধু আছে, যেখানে তিলমাত্র সহানুভূতি পাওয়ার আশা আছে, সকলের দরজায় পাগলের মত ঘুরতে লাগলেন তিনি। এই কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ডাক্তার হিসেবে বহু লোকের বহু উপকার তিনি করেছেন। কিন্তু কেউ-ই আজ বেপরোয়া বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে তাকে সাহায্য করতে রাজী হল না। আর ওধারে তার প্রতীক্ষায় ব্যাঙ্কের অফিসে বসে রইলেন লরী ও–
সিডনী কার্টন!
সিডনী কার্টন?–হ্যাঁ, সেই উছুঙ্খল, সুরাসক্ত, চরিত্রহীন, মক্কেলহীন উকিল সিডনী কার্টন! সে বহুদিন থেকে ফ্রান্সে রয়েছে। লুসীরা ডার্নের অনুসরণ করে প্যারীতে উপনীত হবার ঠিক পরেই সে এসেছে। কিন্তু ঘটনার গতি লক্ষ্য করা ছাড়া আর কিছুই সে করেনি। কী-ই বা করবার ছিল? যেখানে ডাক্তার ম্যানেটের মত সম্মানিত ব্যক্তিকেই অগ্রসর হতে হয়েছে অতি সাবধানে, সেখানে বিদেশী সিডনী কি করতে পারে? সে শুধু বাইরে বাইরে সন্ধান নিয়েছে, দুশ্চিন্তায় কাতর লুসীর কাছে গিয়ে সমবেদনা জানাবার প্রয়াস সে করেনি।
আজ, ডার্নের ভাগ্য যখন চূড়ান্তভাবে স্থির হয়ে গেছে, সে এসে বসলো লরীর অফিসে।
এখানে সিডনী কার্টনের আর একটু পরিচয় দেওয়া দরকার। যেদিন আদালতে তার চেহারার সমত্ব দেখিয়ে সে ডানের মুক্তির উপায় করে দেয়, সেদিন স্বভাবতই ডাক্তার ম্যানেট আর লুসীর দৃষ্টি তার উপর পড়েছিল। ডার্নের সঙ্গে সঙ্গে সে-ও লুসীদের বাড়িতে আসে। লুসীর অপরূপ সৌন্দর্য দেখে, ডানের মতন সেও মুগ্ধ হয়। কিন্তু যখন জানতে পারলো, লুসী ডার্নেকে ভালবাসে, তখন কার্টন তার মনের সমস্ত ভালবাসার খবর তার নিজের মনেই রুদ্ধ করে রেখে দিলো। জগতে আর কেউই সে-খবর জানলো না। লুসীর ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হয়ে কাটনের অবলম্বনহীন জীবন ক্রমশ একেবারেই ব্যর্থ হয়ে গেল। আদালতে তার পসার একদম কমে গেল! শোনা গেল, লন্ডনের আঁধার পল্লীর অন্ধকার হোটেলে-হোটেলে, দুশ্চরিত্র লোকেদের সঙ্গে সে ঘুরে বেড়ায়। ক্রমশ সে নিজে ইচ্ছে করেই লুসীদের বাড়ি আসা বন্ধ করে দিলো, কিন্তু লুসীকে না দেখে তার মন যখন হাঁপিয়ে উঠতো, তখন এক একদিন হঠাৎ এসে উপস্থিত হতো। কিন্তু লুসীর সঙ্গে কোন কথা বড়-একটা বলতো না। লুসীর মেয়েকে আদর করে চলে যেত। যতক্ষণ সে লুসীদের বাড়িতে থাকতো, ততক্ষণ তার কথাবার্তায়, তার ভঙ্গিতে, কেউ বিন্দুমাত্র আপত্তি করবার কিছু পেতো না। সীদের বাড়িতে না এলেও, লুসীদের সব খবরই সে রাখত। তার গোপন ভালবাসার একমাত্র লক্ষ্য ছিল, কোন রকমে লুসীর সাহায্যে আসা। তাই যখন সে শুনলো, ডার্নে ফ্রান্সে গিয়ে বিপন্ন হয়েছে, তাকে উদ্ধার করবার জন্যে লুসীরাও ফ্রান্সে চলে গিয়েছে, সে আর লন্ডনে বসে থাকতে পারেনি।