ও কী ও? রাজার ছিন্ন মুণ্ড! ও কী আবার? রানীর ছিন্ন শির! তরুণী রানীর শিরে সাদা চুল এলো কোথা থেকে? সেই সুন্দরী লাবণ্যময়ী যৌবনবতী নারীর শিরে? হাঃ হাঃ, কেশ শুরু হতে কি বেশি সময় লাগে? রাজার মৃত্যুর পরে নয় মাস বেঁচে ছিলেন রানী। সেই নয় মাসের প্রতি মুহূর্তে তাকে সইতে হয়েছে দারুণ অপমান, চরম অপমানের আশঙ্কা–যুবতীর কালো চুল সেই আশঙ্কাতেই অকালে সাদা হয়ে গিয়েছে।
এ টেস্ ট্যু সিটীজ সব ভেঙে চুরে যাচ্ছে! ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে সব! সব কিছু ধেয়ে চলেছে। ধ্বংসের মুখে। গোটা দেশটার উপর ঘন হয়ে নেমে এসেছে মরণের কালো ছায়া! সে ছায়া গিলোটিনের। আগে লোকে শপথ করবার জন্য ক্রশের চিহ্ন করতে, এখন করে, গিলোটিনের। গিলোটিনের ছবি সকল ঘরে, গিলোটিনের ক্ষুদে ছবি সকলের জামার বুকে! এক-একটা মুণ্ড কেটে ফ্যালে এক-এক মিনিটে…অত দ্রুত হাত চালাতে কোন জল্লাদ কোনদিন পারেনি।
নদীতে ডুবিয়ে মারা, লাইন করে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মারা–এ-সবও কি নেই? তাও আছে…সর্বত্র মৃত্যু! মৃত্যুর তাণ্ডব চলেছে এক বছরের উপর। ডার্নে পড়ে আছেন কারাগারে, লুসী পড়ে আছেন শিশুকন্যা নিয়ে লরীর তত্ত্বাবধানে, আর ম্যানেট ঘুরছেন বন্দীদের তদারক করে।
অবশেষে ডাক্তার একদিন সংবাদ নিয়ে এলেন–দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান, কাল হবে ডানের বিচার।
***
মুক্তি! মুক্তি! দীর্ঘ প্রত্যাশার পরে, দীর্ঘদিন সংশয়-দোলায় দোলবার পরে, ডার্নে পেয়েছেন মুক্তি! ডাক্তার ম্যানেটের করুণ ইতিহাস, অষ্টাদশবর্ষ ব্যাস্টিল-বাসের শোকাবহ কাহিনী, এ সব শুনে জনসাধারণের মনে জেগেছে গভীর সহানুভূতি। তাই জজ আর জুরীর মুখ থেকে প্রচারিত হয়েছে জনসাধারণের ইচ্ছা…ডার্নে মুক্ত।
সেদিন কী আনন্দ ডাক্তার ম্যানেটের গৃহে! মৃত্যুর গ্রাস থেকে ফিরে এসেছেন প্রিয়তম; লুসী চোখে জল, অধরে হাসি নিয়ে, নতজানু হয়ে বসেছেন ভগবানকে ধন্যবাদ জানাতে। বহুদিন অদর্শনের পর পিতার দর্শন পেয়ে শিশু লুসী মুখরা হয়ে উঠেছে কলকাকলি তুলে। ম্যানেটের মুখে স্নিগ্ধ হাসি, আত্মপ্রসাদে তার চিত্ত উঠেছে ভরে। লরীর আনন্দের সীমা নেই, লুসীর স্বামীকে নিরাপদ দেখে। নিঃসন্তান বৃদ্ধ লরীর জীবনে এখন যা কিছু আনন্দ, তা যে ঐ লুসীকে নিয়েই।
এদিকে এই আনন্দের বান ডেকেছে, অন্যত্র কিন্তু ডার্নের প্রসঙ্গ নিয়ে ক্রোধ আর উত্তেজনার সীমা নেই। ডিফার্জের ঘরে সেই উত্তেজনার প্রবল ঢেউ! ডিফার্জের চাইতেও মাদাম ডিফার্জের বেশি ক্রোধ এভরিমন্ডি-বংশের উপর। বিপ্লব আজ নারীর অন্তরের সমস্ত স্নেহ-মায়া-ক্ষমাকে নিঃশেষে মুছে ফেলে দিয়েছে। তাছাড়া, আরো গভীর কারণ আছে। মাদামের প্রতিজ্ঞা–এভরিমন্ডি-বংশকে ঝাড়েমূলে নির্মূল করতে হবে। এভরিমন্ডি-বংশের ছেলে-বুড়ো, নারী-পুরুষ-প্রত্যেকেরই নাম মাদাম ডিফার্জের সেলাইয়ের ভিতর বুনোট করা রয়েছে। সে দুর্বোধ্য ভাষায় রেজিস্ট্রী হয়ে গেছে যার নাম, তার আর নিস্তার নেই…কিছুতেই নেই!
ঐ এভরিমন্ডি-পরিবারের এক ভূতপূর্ব মার্কুইস–গ্যাসপার্ড যাঁর বুকে ছুরি বিঁধিয়ে দিয়ে নিজে চল্লিশ ফুট উঁচু ফাঁসিকাঠে ঝুলেছিল–সেই ভূতপূর্ব মাকুইসের প্রথম যৌবনের এক বীভৎস কুকীতির কথা বলতে হল এবার। দরিদ্র প্রজাদের ঘরে সুন্দরী রমণী দেখলে তার কামনা আগুনের মত লক লক করে উঠত। ছলে বলে-কৌশলে সে-নারীর সর্বনাশ করতেন তিনি। এক বালিকা এইভাবে চরম লাঞ্ছনায় লাঞ্ছিতা হলো তার হাতে। মনোবেদনায় দারুণ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মারা পড়লো সে, ঐ মাকুইসেরই গৃহে। বালিকার পিতা ক্ষীণ প্রতিবাদ করেছিল একটু। সেই ধৃষ্টতার শাস্তিস্বরূপে তাকেও মরতে হল ছুরিকাঘাতে। বালিকার ভ্রাতা দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করেছিল মার্কুইসকে। শিক্ষিত তলোয়ারবাজ মাকুইসের সঙ্গে সে এঁটে উঠতে পারবে কেন? অস্ত্রবিদ্যায় অশিক্ষিত কৃষক-বালক–সে-ও মরলো তরবারির আঘাতে।
দরিদ্র সেই কৃষক-পরিবারের একমাত্র অবশিষ্ট প্রাণী, একটি শিশুকন্যা, ধর্ষিতা যুবতীর কনিষ্ঠা ভগ্নী–তাকে আত্মীয়েরা পাঠিয়ে দিলো দূরে, সমুদ্রতীরে এক ধীবর পল্লীতে। সেইখানে সে মানুষ হল, আপন মনে প্রতিদিন এই মন্ত্র জপ করতে করতে মানুষ হল যে প্রতিহিংসা নিতে হবে–প্রতিহিংসা নিতে হবে–প্রতিহিংসা! সেই মেয়েই আজ এই মাদাম ডিফার্জ।
এমন যে মাদাম ডিফার্জ সে কখনো এভরিমন্ডি-বংশের বর্তমান মার্কুইস ডার্নেকে মুক্ত দেখে নিশ্চিন্ত থাকতে পারে? যেভাবে হোক, মাদাম ডিফার্জ প্রতিহিংসার ব্রত উদ্যাপন করবেই, ধর্ষণকারী মাকুইসের বংশ নির্মূল করে। আর, ডার্নে কিন্তু সেই ধর্ষকের দূর আত্মীয়ও নয়, আপন ভ্রাতুস্পুত্র! ওর মৃত্যু চাই-ই!
মাদাম ডিফার্জ জ্যা-সঙেঘর নেতৃস্থানীয় কতিপয় ব্যক্তির সঙ্গে পরামর্শ করতে বসলো গোপনে। স্বামীকেও সে এ-পরামর্শের ভিতর ডাকেনি, কারণ, ডিফার্জ একদা ডাক্তার ম্যানেটের অনুরক্ত ভৃত্য ছিল, সদাশয় প্রভুর কাছে সেদিনে যে স্নেহ সে লাভ করেছিল, তার কথা সে এখনো ভোলেনি। ডাক্তার ম্যানেটের জামাতাকে হত্যা করার পরামর্শে সে খুশি হয়ে সম্মতি দেবে না কখনো। তাই স্বামীকে গোপন করে, মাদাম ডিফার্জ চক্রান্ত করতে বসলো অন্য লোকের সঙ্গে! জ্যাকসঙ্ঘের ভিতর রক্তপিপাসু লোকের তো অভাব ছিল না! গোটা সঙঘটাই তো গড়ে উঠেছে, ফরাসীদেশের যাবতীয় নর-রাক্ষসদের (অবশ্য অত্যাচারেই রাক্ষস হয়ে দাঁড়িয়েছে এ-সব মানুষ) একত্র করে!