সব শুনে লরী কপালে করাঘাত করে হতাশভাবে বললেন–কিন্তু তুমি যে ছুটে এলে ম্যানেট, কী করতে পারবে তুমি? ডার্নেকে বাঁচাবার কতটুকু শক্তি আছে তোমার?
–তা আছে। একটু গর্বের সঙ্গেই ম্যানেট বললেন–তা কিছু আছে! কারণ, আমি আঠারো বৎসর বন্দী ছিলাম ব্যাস্টিলে। আমার নাম সবাই জানে–আজকের এই বিদ্রোহীরা। আমার খাতির এরা করবে। ইতিমধ্যেই খাতির পেয়েছি। ডার্নের খবর আমি সীমান্তের অফিসে বসেই সংগ্রহ করতে পেরেছি। অন্য কেউ সে খবরটাই যোগাড় করতে পারত না।
লরী বললেন–কী খবর? কী খবর পেয়েছে?
–ডার্নেকে বন্দী করে রাখা হয়েছে লা-ফোর্সের কারাগারে।
লরী শিউরে উঠলেন–লা-ফোর্সের কারাগারে? সেখান থেকে তো জীবন্ত বেরিয়ে আসতে কাউকে দেখলাম না এ-কয় দিনে। তোমার যদি কিছু করতে হয় তো–এক্ষুণি, ডাক্তার! হয়তো এখনও সময় থাকতেও পারে! যদি কিছু উপায় তুমি করতে পারো, তবে তা এক্ষুণি করো ডাক্তার! কাল হয়তো দেখবে যে, সব ফুরিয়ে গেছে। বিদ্রোহীরা বেশি সময় নেয় না। কেউ একজন অভিযোগ করলেই হল যে, এ-লোকের দ্বারা জনসাধারণের উপর অত্যাচার হয়েছে। জজ আর জুরী বসেই আছে মৃত্যুদণ্ড দেবার জন্য। গিলোটিন পাতাই আছে! যাও, যাও ডাক্তার! লুসী এখানেই থাকুক, তুমি দেখ কি করতে পারো!
বাইরের উঠানে কয়েক শত লোক অস্ত্রে শান দিচ্ছিলো তখনো, রক্তরাঙা অস্ত্র… রক্তরাঙা মানুষ! সেই কয়েক শত লোকের ভিড়ের ভিতর ঢুকে পড়লেন শুক্লকেশ ম্যানেট! অফিস-ঘরের দরজা একটুখানি খুলে লরী দেখতে লাগলেন– ম্যানেট কি-যেন-কি কথা কইছেন সেই ভিড়ে দাঁড়িয়ে! সহসা সেই ভিড় চিৎকার করে উঠলোব্যাস্টিলের বন্দী ম্যানেট, দীর্ঘজীবী হোন! ব্যাস্টিল-বন্দীর আত্মীয় এভরিমন্ডিকে চাই আমরা। মুক্ত করো ব্যাস্টিল-বন্দীর আত্মীয়কে। চলো সবাই লা ফোর্সে! চলো সবাই লা-ফোর্সে!
সেই কয়েক শত লোক ডাক্তার ম্যানেটকে কাঁধে করে নিয়ে ছুটে চললো লা ফোর্সে। লুসী আশায় উৎফুল্ল হয়ে ভূতলে জানু পেতে বসে ধন্যবাদ দিতে লাগলেন ভগবানকে। লরীরও আশা না হল তা নয়, কিন্তু তিনি জানেন–বন্দীকে খালাস করে আনা কত কঠিন আজকের দিনে! বেশি আশা করতে সাহস হল না তার।
চার দিন পরে ফিরে এলেন ম্যানেট। লরীর সঙ্গে গোপনে আলাপ হল তাঁর। জনতা তাকে কাঁধে করে নিয়ে গিয়েছিল লা-ফোর্সে। সারা দীর্ঘপথ রক্তে পিছল..মড়ার গাদা চারিদিকে। জনসাধারণ হত্যা করেছে জনসাধারণের শত্রুদের। কারার ভিতরেও চলেছে হত্যাকাণ্ড। বিচারসভা বসেছে কারার ভিতর। বিচারকেরা গায়ের জোরেই বিচারক হয়ে বসেছে। তাদের সম্মুখে বন্দীরা আনীত হচ্ছে একটি একটি করে। বেশির ভাগ বন্দীকে সঙ্গে-সঙ্গেই সঁপে দেওয়া হচ্ছে জনতার হাতে, তারা সঙ্গে-সঙ্গেই টুকরো করে কেটে ফেলছে তাদের। দু’চার জন মুক্তি পাচ্ছে। দু’একজনকে আবার ফেরত পাঠানো হচ্ছে কারাগারে। ম্যানেট এই বিচারসভার সমুখে গিয়ে পরিচয় দিলেন নিজের। তাঁকে জানে সবাই। জুরীর ভিতর বসেছিল তার সেকালের এক ভৃত্য, নাম তার ডিফার্জ।
তিনি শুনতে পেলেন–ডার্নে তখনও জীবিত। সেই স্বয়ং-নিযুক্ত আদালতের সমুখে তিনি জামাতার স্বপক্ষে অনেক কিছুই বললেন–প্রাণের সমস্ত দরদ ঢেলে! ম্যানেটের আঠারো-বৎসর ব্যাস্টিল-বাসের কাহিনী যে শুনেছে, সেই বলেছে– ডার্নের মুক্তি পাওয়া উচিত। ডাক্তার আশা করছেন প্রতি মুহূর্তে যে, এইবার সে মুক্তির আদেশ দেওয়া হবে, এমন সময়ে কেমন করে যেন হাওয়া বদলে গেল একেবারে। জুরীদের ভিতর কানাঘুষা চললো কিছুক্ষণ, তারপর আদেশ হলো– মুক্তি এখন হতে পারে না এভরিমন্ডির, তবে তাকে কারাগারে নিরাপদে রক্ষা করা হবে, জনতার হাতে তুলে দেওয়া হবে না তাকে। ডার্নেকে সঙ্গে সঙ্গে আবার কারাগারের ভিতরে চালান করে দেওয়া হলো। ডাক্তার তখন সকাতরে প্রার্থনা করলেন–তাকে সেইখানে থাকতে দেওয়া হোক, যতক্ষণ-না উন্মত্ত জনতা কারাগার ছেড়ে চলে যায়। তারা গেল চার দিন পরে। এই চার দিন ডাক্তারকে লা-ফোর্সে থেকে পাহারা দিতে হয়েছে–যাতে কারাগারের ভিতর থেকে ডার্নেকে টেনে বের করে হত্যা না করে রক্তপাগল জনতা।
এই চার দিনের ভিতর লরী একটা বাসা ঠিক করেছেন লুসীদের জন্য। লুসী ও ম্যানেট সেইখানেই বাস করতে লাগলেন। ডানে কবে মুক্তি পাবেন, স্থির নেই। মুক্তি পেলে ফ্রান্স ত্যাগ করে যাওয়া এখন কখনোই সম্ভব হবে না ডার্নের পক্ষে। কাজেই দীর্ঘদিন সকলের প্যারীতে থাকতে হবে হয়তো।
দেখতে দেখতে ডাক্তার ম্যানেটের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লো চিকিৎসক হিসাবে। বিদ্রোহী নেতারা তাঁকে লা-ফোর্সে ও অন্য তিনটে কারাগারের পরিদর্শক নিযুক্ত করল। শুধু চিকিৎসক বলে নয়, আগের দিনের ব্যাস্টিল-বন্দী বলে তিনি এই কাজ পেলেন। তার ফলে ডার্নের সঙ্গে সাক্ষাৎ হতে লাগলো তার মাঝে-মাঝে। লুসীকে পত্র দেবার সুযোগও পেলেন ডার্নে, ম্যানেটের হাত দিয়ে। দীর্ঘ এক বৎসর কেটে গেল এইভাবে। না হল ডার্নের মুক্তি, না হল তার বিচার। ম্যানেট এখন আর লুসী বা লরীর সাহায্যের উপর নির্ভরশীল নন, বরং তার উপর নির্ভর করেই এঁরা সবাই বাস করছেন প্যারীতে। আজ ম্যানেটের যেমন সম্মান, তেমনি তার কাজের শক্তি, আর তেমনি তার মনের জোর। এক বৎসর কেটে গেল। ডার্নের মুক্তির জন্য ম্যানেটের চেষ্টার বিরাম নেই। কিন্তু মুক্তির কথা তো পরে, বিচারের ব্যবস্থা পর্যন্ত হল না অভাগা বন্দীর। ও-রকম তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় কই নতুন শাসকদের? নতুন যুগের ঢেউ এসেছে দেশে। রাজার বিচার করা হয়েছে, রাজার উপর মৃত্যুদণ্ড প্রচার হয়েছে, রাজশির ছিন্ন হয়েছে ঘাতকের আঘাতে। সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ফরাসীদেশে, সে-তন্ত্রের মূল নীতি হলো, “সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা, আর তার অভাবে মৃত্যু।” সারা পৃথিবী ভয় পেয়ে কোমর বেঁধে দাঁড়িয়েছে এই নতুন সাধারণতন্ত্রের বিরুদ্ধে। কিন্তু এই সাধারণতন্ত্র, কারও ভয়ে ভীত নয়, কারও কুটি দেখে নিরস্ত হবার পাত্র নয়। “হয় জয়, নয় মৃত্যু”–তার পণ! নোতরদামের গির্জার আকাশচুম্বী চুড়ায় দিবানিশি উঠছে কৃষ্ণপতাকা! পৃথিবীতে যে যেখানে অত্যাচারী আছে, তাদের সমূলে বিনাশ করবার জন্য তিন লক্ষ ক্ষুধার্ত, চিরদিন পদদলিত লোক লাফিয়ে উঠেছে ফরাসীদেশের প্রতি গ্রাম ও নগর থেকে। যেন দৈত্যের পাল গর্জন করে বেরিয়ে পড়েছে পাহাড় ও সমতল, পাথর ও বালুকা, লোকালয় ও অরণ্য থেকে। দক্ষিণের রৌদ্র-ঝলমল আকাশের নিচে, আর মেঘ-ঢাকা উত্তর-ফ্রান্সের আকাশের নিচে দ্রাক্ষা ও জলপাইয়ের আবাদে, আর শস্যহীন ক্ষেত্রের নাড়াবনে, নদীতীরে আর সাগর উপকূলে–সর্বত্র জেগেছে পালে-পালে দৈত্য-রক্ত-পিপাসায় লকলক জিহ্বা মেলে দিকে দিকে ছুটেছে তারা। সারা দেশে ছুটেছে ধ্বংসের বন্যা। তুচ্ছ ডার্নের কথা ভেসে গেল সে-প্লাবনের মুখে!