ফরাসীদেশ থেকে কিছুদিন ধরে নিত্যই নতুন-নতুন লোক পালিয়ে আসছে ইংলন্ডে। জমিদার, সামরিক-কর্মচারী, মন্ত্রী, ম্যাজিস্ট্রেট–সবাই পালিয়ে আসছেন প্রাণ হাতে করে। এঁরা সবাই প্রায় একবার করে টেলসন ব্যাঙ্কের লন্ডন অফিসে দেখা দিয়ে যান। অনেকের হিসাব আছে এ-ব্যাঙ্কে। অনেকের ছিল, এখন নেই, কিন্তু পূর্বের খাতিরে ধার পাওয়ার প্রত্যাশা করেন। কেউ আবার আসেন–পরিচিত বন্ধুবান্ধবের সাক্ষাৎ এখানে পাওয়া যাবে এই আশায়। ফরাসীদেশের লোকমাত্রেই জানে–পলাতক-ফরাসীদের আড্ডা লন্ডনে ঐ একটিই আছে—টেলসন ব্যাঙ্কের অফিস। তাই কোন পলাতক-ফরাসীকে পত্র লিখতে হলে ফ্রান্সবাসী ফরাসীরা টেলসনের ঠিকানাতেই পত্র দেয়। লরীর হাতের চিঠিখানাও ঐ জাতীয় একখানা চিঠি! লরী মাথা নাড়লেন–না, রোজই তো খোঁজ করা যাচ্ছে। এ-নামের কাউকে দেখতে পাই না।
চিঠিখানা টেবিলের উপর পড়ে আছে। ডার্নে শিরোনামাটা পড়লেন। তাঁর বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ড ধক্ করে লাফিয়ে উঠলো। মাথাটা বোঁ করে ঘুরে গেল। নাম লেখা আছে–মার্কুইস এভরিমন্ডি।
মাকুইস এভরিমন্ডি? সে তো ডার্নে! ফরাসীদেশে তো ডার্নের ঐ নাম! গুপ্তহন্তার হাতে তাঁর পিতৃব্য খুন হওয়ার পরে ডানেই তো এখন মার্কুইস বা জমিদার! সে অভিশপ্ত নামের সঙ্গে আর কোন সম্পর্ক রাখবেন না বলেই ডার্নে ইংলন্ডে নিজেকে ডানে নামে পরিচিত করেছেন। কিন্তু এখন-কে তাকে চিঠি লিখলো পিছনে-ফেলে-আসা ফরাসীদেশ থেকে?
ডার্নে লরীকে বললেন–এভরিমন্ডি? ভদ্রলোকটি আমার পরিচিত। চিঠিখানি যদি আমায় দেন, আমি দিয়ে দিতে পারবো।
লরী খুশি হয়েই পত্র দিয়ে দিলেন ডার্নেকে।
ডার্নের প্রকৃত নাম ডাক্তার ম্যানেট ভিন্ন কেউ জানে না। ম্যানেটও জেনেছিলেন সবে লুসীর বিবাহের দিন। জেনেই তার প্রবল ইচ্ছা হয়েছিল বিবাহ ভেঙে দেওয়ার। কিন্তু তা তিনি পারেননি, লুসীর মুখ চেয়ে। লুসী যে ভালোবাসে ডার্নেকে! তাই পরম শত্রুর পুত্রকে তিনি জামাতা বলে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গে ডার্নেকে সাবধান করে দিয়েছিলেন তিনি যেন নিজের আসল নাম লুসীকে বা লরীকে না বলেন।
ডার্নে পত্র পড়ে দেখলেন–তার ফরাসীদেশের কর্মচারী গ্যাবেল লিখেছে চিঠি। এভরিমন্ডি-জমিদারীর গোমস্তা বলে, সে বন্দী হয়েছে, শীঘ্রই তার মৃত্যুদণ্ড হবে। তাকে বাঁচাতে হলে, এভরিমন্ডি-মার্কুইসের অবিলম্বে ফ্রান্সে যাওয়া প্রয়োজন। তা নইলে প্রভুর অপরাধে ভৃত্য প্রাণ হারাবে!
০৭. প্রলয়-দোলা
মিস্টার লরী ইংরেজ, সুতরাং ফরাসীদেশের প্রলয়-দোলার মাঝখানেও তিনি খানিকটা নিরাপদ। গৃহবিবাদের সময় বিদেশী লোকের উপর অত্যাচার পারতপক্ষে কেউ করে না। আইনে ওটা নিষেধ আছে। লরী প্যারীর অফিসে বসে নিজের কাজ করে যেতে লাগলেন, কেউ তার উপর উৎপাত করতে এলো না। টাকা পয়সা আগে থাকতেই লন্ডনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল–যতটা সম্ভব! কাগজপত্র কতক মাটির তলায় পুঁতে ফেললেন লরী, কতক বা ফেললেন পুড়িয়ে। সীমান্তে পাহারার যা কড়াকড়ি, তাতে এক টুকরো হিসাবের কাগজও যে ফ্রান্স থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া যাবে, সে-ভরসা তিনি করতে পারলেন না।
ব্যাঙ্কেরই একাংশে বাস করছেন মিস্টার লরী। বাড়ির ভিতরটা নির্জন। বাসিন্দা যারা ছিল, তারা পালিয়েছে। প্যারীর অনেক মহল্লাই এখন এমনি নির্জন। একটা প্রকাণ্ড শান-যন্ত্র বসানো রয়েছে বাড়ির উঠানে। সেখানে অবিরত অন্ত্রে শান দেওয়া চলেছে। শত-শত লোক আসছে আর যাচ্ছে। সকলেরই হাতে কোন-না-কোন অস্ত্র। মানুষ কেটে-কেটে ভোতা হয়ে যাচ্ছে অস্ত্র, আর অমনি ছুটে আসছে তারা শান। দেওয়ার জন্য। তরোয়াল, কোদাল, কুড়াল, ছুরি, ছোরা! যারা আসছে, তাদের হাতে রক্ত, কাপড়ে রক্ত, হাতিয়ারে রক্ত…
রাত্রে লরী ঘরের ভিতর বসে ভগবানের নাম স্মরণ করছেন। উঃ! সবরক্ষা যে, এই মহা-নরকে আমার কোন প্রিয়জন আজ নেই! ভগবানকে ধন্যবাদ! হঠাৎ তার অফিস-ঘরের কড়া নড়ে উঠলো। সাবধানে দ্বার খুললেন লরী। হয়তো কোন দুর্ভাগ্য মক্কেল। রাত্রির অন্ধকারে টাকা নিতে এসেছে। পালাবার কোন উপায় করতে পেরেছে হয়তো। এখন টাকাটা পেলেই ত্যাগ করতে পারে এই অভিশপ্ত পুরী। লরী এমন অনেককেই দিয়েছেন টাকা গভীর রাত্রে। ব্যাঙ্কেরই টাকা অবশ্য। ব্যাঙ্কে টাকা কতদূর কী জমা আছে অভাগা মক্কেলের, তা না দেখেই টাকা দিতে হয়েছে তাকে।
কিন্তু এ কারা? মক্কেল তো নয়! লরীর চোখের সমুখে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। লুসী? ডাক্তার ম্যানেট? লুসীর মেয়ে?–এইমাত্র না তিনি ভগবানকে ধন্যবাদ দিচ্ছিলেন যে, তাঁর কোনও প্রিয়জন–হ্যাঁ ঈশ্বর! এমন নিষ্ঠুর পরিহাস কি করতে আছে কারো সঙ্গে?
ওরা ছুটে ঘরে ঢুকলো এসে। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো নিজেদের কাহিনী! লরী যেদিন চলে এলেন, তার পরদিন ডার্নেও কী একটা চিঠি পেয়েছিলেন নাকি ডার্নে; ফ্রান্স থেকে! কার নাকি জীবন রক্ষার জন্য একান্ত প্রয়োজন ছিল ডার্নের ফ্রান্সে আসবার। কাউকে কিছু বলেননি ডার্নে। লুসীর নামে একখানা পত্র লিখে রেখে, “বেড়াতে যাচ্চি একটু”–বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছেন তিনি। চিঠি পেয়েই ডাক্তার ম্যানেট ছুটে এসেছেন। তিনি জানেন ডানের প্রকৃত পরিচয়। বিদ্রোহী ফরাসী, রক্ত-পাগল ফরাসী-জনসাধারণের হাতে পড়লে চিরদিনের অত্যাচারী এভরিমন্ডি জমিদারের যে নিশ্চয়ই প্রাণ যাবে, তা বুঝতে পেরে সঙ্গে-সঙ্গেই তাকে বাঁচাবার জন্য ছুটে এসেছেন ডাক্তার ম্যানেট! ডাক্তার ম্যানেট লুসীকে আনতে চাননি কোনমতেই, কিন্তু সে কি পড়ে থাকতে চায়? স্বামী যেখানে শত্রুর হাতে মরতে বসেছে, পতিব্রতা পত্নী কি সেখানে দূরে বসে থাকতে পারে, নিজের জীবনটাকে নিরাপদ রাখবার জন্য?