কামান, বন্দুক, আগুন আর ধোঁয়া। সেতুর পর সেতু পেরিয়ে, পরিখার পর পরিখা উত্তীর্ণ হয়ে, গুম্বজের পর গুম্বজে চড়ে নীরেট দেয়ালের মাথায় গিয়ে ওঠে বিরাট জনসমুদ্র। অস্ত্রের মুখে রৌদ্র জ্বলে ঝক্ঝক্! মশালের মুখে আগুন জ্বলে জু-জুল! খড়ের গাদায় সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ে আগুন আর ধোঁয়া! আর্তনাদ, অভিশাপ, গোলাবৃষ্টি–বিরাট জনসমুদ্র এগিয়ে চলে ব্যাস্টিলের কেন্দ্রস্থলে। উথলে ওঠে জনসমুদ্রের তরঙ্গ, চিরতরে ডুবে যায় ফরাসীদেশের অত্যাচারী রাজতন্ত্র! নিরুপায় দেখে দুর্গরক্ষীরা সাদা নিশান উড়িয়ে সন্ধির প্রার্থনা জানালো।
ঝড়ের বেগে ধেয়ে যায় জনতা, তার মাথার উপর চকিতে উড়লো একবার সেই শ্বেতপতাকা, অমনি উল্লাসে গর্জন করে প্রাচীরের মাথার দিকে ছুটলো জনতা, যেন আকাশপানে লাফিয়ে উঠলো সমুদ্রের তরঙ্গ। সেই তরঙ্গদোলার মাথায় চড়ে ডিফার্জ আর তার সঙ্গীরা গিয়ে পড়লো ব্যাস্টিলের মাঝখানে। একজন প্রহরীকে সমুখে দেখে তার গলার কলার চেপে ধরলো ডিফার্জ :
–১০৫, নর্থ টাওয়ার, জিনিসটা কি?
ভীত ত্রস্ত প্রহরী বুঝতে পারলো না—১০৫?
–হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওটা কি কোন বন্দীর নাম? ১০৫, নর্থ টাওয়ার?
–ও একটা কারা-গহ্বরের নাম!
–দেখাও সেটা!
ঘুরতে-ঘুরতে কক্ষের পর কক্ষ, সিঁড়ির পর সিঁড়ি, দ্বারের পর দ্বার, সুড়ঙ্গের পর সুড়ঙ্গ অতিক্রম করে চললো প্রহরীর পিছনে-পিছনে ডিফার্জ আর তিন নম্বর জ্যাক্স্! অবশেষে ছোট একটা গর্ত! কক্ষ বলা ভুল তাকে। যেন পাথরের ভিতর খোদাই করে বার করা হয়েছে একটা গর্ত! একটা মাত্র জানালা, তাতে মোটা-মোটা লোহার গরাদে!
সেই ঘরের দেয়ালে ডিফার্জ দেখে, তখনও রয়েছে একটা নাম লেখা, আঁচড় কেটে-কেটে। ডিফার্জ পড়লো–আলেকজান্ডার ম্যানেট!
সেই গর্তের মেঝে খুঁড়ে, চিমনী ভেঙে, লোহার খাট আর টুল উল্টেপাল্টে তালাসী করলো ডিফার্জ। হ্যাঁ, পেলো বইকি! চিমনীর কোন্ ফাঁকে সে আবিষ্কার করলো একতাড়া কাগজ!
তারপর তারা বেরিয়ে পড়লো, ১০৫ নম্বর নর্থ টাওয়ার থেকে। প্রাঙ্গণে তখন ডিফার্জের সন্ধানে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সবাই। ডিফার্জ এসে আবার নেতৃত্ব গ্রহণ করলো সেই বিরাট জনসমুদ্রের। ১০৫-এর মতই ছোট-ছোট গর্ত থেকে সাতজন বন্দীকে করা হল মুক্ত! আর ব্যাস্টিলের সবচেয়ে মজবুত, সবচেয়ে উঁচু গুম্বজ থেকে ধরে আনা হলো সাতজন উঁচুদরের রাজকর্মচারীকে!
তারপর সেই সাতজন বন্দীকে কাঁধে করে নিয়ে বেরুলো সেই বিরাট জনতা– ব্যাস্টিলের কারাদুর্গ থেকে। কাঁধে তাদের সাতজন মুক্ত রাজবন্দী, আর সেই জনসমুদ্রের মাথার উপর উঁচু-বাঁশে-বসানো সাতটি রক্তঝরা নরমুণ্ড! সেই অত্যাচারী সাতজন রাজকর্মচারীর সদ্য-কেটে-আনা মুণ্ড! যুগের পর যুগ অত্যাচারিত, অপমানিত জনতার সেই পাগল প্রতিহিংসা রক্তের অক্ষরে লেখা হয়ে গেল মানুষের ইতিহাসে। যুগ পালটে গেল।
***
এই যুগ-পালটানো ঘটনার অল্প পরেই একদিন টেলসন ব্যাঙ্কের লন্ডন অফিসে কথা হচ্ছিলো মিস্টার লরীর সঙ্গে চার্লস্ ডার্নের। ব্যাঙ্কের প্যারী-শাখার কাজকর্ম গুটিয়ে ফেলার দরকার হয়েছে। সেখানে আর কারবার চলছে না। কাগজপত্র যথাসম্ভব নিয়ে আসতে হবে লন্ডন অফিসে। সব হয়তো নিয়ে আসা সম্ভব হবে না–কারণ ফরাসী সীমান্তে কড়া পাহারা বসিয়েছে বিদ্রোহীরা। যা নিয়ে আসার উপায় নেই, তা লুকিয়ে রেখে, বা নষ্ট করে দিয়ে আসতে হবে। এ গুরুভার কাজের জন্য মিস্টার লরীকে দু’চার দিনের জন্য যেতেই হবে প্যারীতে একবার। ডার্নেকে ডেকে পাঠিয়েছেন লরী এই সংবাদই দেবার জন্য। ডার্নে ও ম্যানেটকে না জানিয়ে লরী যেতে পারেন না, কারণ, ওঁরাই এখন লরীর একমাত্র আপনার জন পৃথিবীতে।
লরী এ-সময়ে প্যারী যাবেন শুনেই ডার্নের চক্ষুস্থির! প্যারী যাবেন? যে-প্যারীতে এখন মৃত্যুর প্রলয়নাচ চলেছে চব্বিশ ঘণ্টা? যে প্যারী ছেড়ে পালাবার জন্য ব্যগ্র সবাই? ফ্রান্সের রাজা-রানী বন্দী! জমিদার ও ভূতপূর্ব শাসকেরা–যে পেরেছে, সেই পালিয়েছে। যে পারেনি সে গিলোটিনে প্রাণ দিয়েছে। গিলোটিন-বড়লোকদের মাথা কাটবার জন্য বিদ্রোহীরা নতুন কল তৈরি করেছে ঐ গিলোটিন! খ্যাঁচ্, খ্যাঁচ –অস্ত্র পড়ছে অপরাধীর শিরে, একের পর এক! মাথার পর মাথা লুটিয়ে গড়িয়ে পড়ছে নিচেকার ঝুড়ির ভিতর! এই গিলোটিনে দৈনিক দুশো-একশো লোক প্রাণ দিচ্ছে। বিদ্রোহীদের অবিশ্বাস বা সন্দেহভাজন যে, তার আর নিস্তার নেই গিলোটিন থেকে। যে কেউ একটা যেমন তেমন অভিযোগ করলেই হল। সঙ্গে-সঙ্গে অভিযুক্ত ব্যক্তি বন্দী হবে। সঙ্গে-সঙ্গে তার বিচার হবে এবং সঙ্গে-সঙ্গে গিলোটিন।
কিন্তু ডার্নের সমস্ত প্রতিবাদ, সমস্ত অনুনয় ব্যর্থ হয়ে গেল। লরী এতকাল টেলসন ব্যাঙ্কের নিমক খেয়েছেন, এখন তিনি গিলোটিনের ভয়ে ব্যাঙ্কের কাজে অবহেলা করবেন? বিশেষ করে লরী হলেন ইংরেজ, হঠাৎ কোন ইংরেজকে গিলোটিনে পাঠাতে ফরাসী-বিদ্রোহীরাও সাহস পাবে না।
লরী সেইদিনই রাত্রে রওনা হবেন। মনস্থির করে ফেলেছেন একেবারে।
লরীকে নিরস্ত করতে না পেরে ডার্নের বড়ই চিন্তা আর ভয় হল তার জন্য। কিন্তু উপায় তো নেই। তিনি চলে আসবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন, এমন সময়ে ব্যাঙ্কের মালিকদের ভিতরই একজন এসে লরীর হাতে দিলেন একটা চিঠি। চিঠির খামখানা নোংরা হয়ে গেছে, যেন বহু হাত ঘুরে এসেছে সে। লরী চিঠিখানা হাতে নিয়ে বললেন–না, মহাশয়! বহু খোঁজই তো করা হল। এ-নামের কাউকে দেখতে পাই না।