তখনই ঘর ঠিক হয়ে গেল।
.
ঘরে গিয়ে পোশাক বদল করবার সঙ্গে সঙ্গেই সকাল বেলার খাবার নিয়ে এলো একজন খানসামা।
মিঃ লরী তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে পড়লেন, তার ইচ্ছে সমুদ্রের ধারে কিছুক্ষণ বেড়িয়ে আসা।
ডোভার শহরটা ঠিক সমুদ্রের উপরে নয়; একটু দূরে, পাহাড়ের গায়ে। সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে যদি কেউ শহরের দিকে তাকায়, তার হঠাৎ মনে হবে শহরটা সমুদ্রের ভয়ে ছুটে পালাবার চেষ্টা করছিল। বেশি দূরে যেতে পারেনি; মাঝপথে পাহাড়কে পেয়ে তারই বুকে মুখ লুকিয়ে রয়েছে। সমুদ্র কিন্তু অত সহজে তাকে ছেড়ে দিতে রাজী নয়। সে পেয়াদার পর পেয়াদা পাঠাচ্ছে শহরটাকে ধরে আনবার জন্য। সে
পেয়াদা হল পাহাড় সমান বড় বড় ঢেউ। সে সব ঢেউ কিন্তু শহরের নাগাল পাচ্ছে না; শহর পাহাড়ের গায়ে অনেক উঁচুতে বসে ঢেউ-পেয়াদাকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে। ঢেউয়েরা রেগে যাচ্ছে তাতে, লাফিয়ে উঠছে কূলের উপর। তাতে শহরের কিছু ক্ষতি হচ্ছে না; মাঝখান থেকে ভেঙে পড়ছে কূলের মাটি। বেড়াবার পক্ষে খুব যে মনোরম জায়গা এটা, তা নয়। একটা সোঁদা আঁশটে গন্ধ ডাঙায়; আর একটা গোলমেলে আওয়াজ জলের দিক্টাতে, সে-আওয়াজ শুনতে শুনতে বিরক্তি ধরে যায় মানুষের।
ডোভারে তখন ব্যবসা-বাণিজ্য খুব কমই হত। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্য না করেও হঠাৎ বড়লোক হতে দেখা যেতো দু’চার জনকে। কী করে হত? জাহাজ তো মাঝে মাঝে ডোবে সমুদ্রে! সে সব জাহাজের অনেক মালপত্রই ভাসতে ভাসতে কূলে গিয়ে লাগে। তার ভিতর সোনা-দানা হীরে-জহরতের বাক্সও পাওয়া যায় মাঝে মাঝে। ডোভারের উপকূলটা এরকম ভাবে বাঁকানো যে ওখানে এসে লাগলে সে জিনিস আর ভেসে বাহির সমুদ্রে যেতে পারে না। এখন যেমন সরকারী লোক নিযুক্ত হয়েছে ঐ সব ভেসে-আসা মাল টেনে তুলবার জন্য, তখন তা ছিল না। কাজেই যার সম্মুখে পড়ত, সেই নিয়ে যেত। কেউ কেউ বড়লোক হয়ে যেত এই ভাবেই। তাই লোভে লোভে ডোভারবাসী সবাই সমুদ্রের ধারে ধারে ঘুরে বেড়াত অবসর পেলেই।
সেদিনও ঐ রকম কয়েকজন লোক ঘুরে বেড়াচ্ছিল সমুদ্রের তীরে। মিঃ লরীর ভাল লাগল না তাদের ঐ রকম ঘোরাফেরা। অনেকক্ষণ সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থেকে তিনি হোটেলে ফিরে গেলেন।
বিকেলের দিকে কুয়াশায় আবছা হয়ে এলো চারিদিক। ওপারের ফরাসী-উপকূল ভাল দেখা যায় না আর। সেইদিকে চেয়ে মিঃ লরীর মনে নানা চিন্তার উদয় হতে লাগল। দুঃখেরই চিন্তা। পনেরো বছর আগে একটি দু’বছরের শিশুকে কোলে নিয়ে ফরাসী-দেশ থেকে পালিয়ে এসেছিলেন তিনি। সেই দু’বছরের শিশু আজ সতেরো বছরের তরুণী। তাকেই আজ আবার ফরাসীদেশে নিয়ে যাবার দরকার হয়েছে। রয়্যাল জর্জ হোটেলে এসে তারই পথ চেয়ে বসে রয়েছেন মিঃ লরী। অবশ্য আজকের দিনটা এমনিতেই তাকে অপেক্ষা করে থাকতে হত, কারণ কালকের আগে আর জাহাজ নেই ওপারে যাবার।
তখন সন্ধ্যা উতরে গেছে। খাওয়ার ঘরে লোকের ভিড় দেখে মিঃ লরী তার খাবার আলাদা জায়গায় দিতে বললেন। নির্জনে বসে চিন্তা করতে চান তিনি। এই যে তরুণীটি আসছেন, কী ভাবে এঁর সঙ্গে আলাপ করবেন তিনি, তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না এখনও। কিন্তু বুঝে পড়ে ঠিক হয়ে থাকা দরকার; তা নইলে বিপদ হবে দু’জনেরই; তাঁরও, তরুণীরও! নিজের মনকে তিনি আরও সময় দিতে চান তৈরি হওয়ার জন্য।
খাওয়া শেষ হবার আগেই সদরে একখানা ঘোড়ার গাড়ির শব্দ শোনা গেল। দু’মিনিট পরেই একজন খানসামা এসে মিঃ লরীকে জানালো যে, একজন তরুণী তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান।
খানসামা আরও বললো যে, যে ঘরখানা মহিলাটির জন্য আগে থেকে বন্দোবস্ত করে রাখা হয়েছিল, সেইখানেই তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তিনি সেই ঘরেই অপেক্ষা করছেন। মিঃ লরী তখন তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে সেইদিকে চললেন। ঘরের ভিতর আলো অতি কম, সহসা তিনি কিছুই দেখতে পেলেন না, কিন্তু একটি মিষ্টি কণ্ঠস্বর তিনি শুনতে পেলেন; কে যেন তাকে আসন গ্রহণ করবার জন্য অনুরোধ করে উঠলো। মিঃ লরী এইবার ঠাহর করে দেখলেন–সামনেই একটি তরুণী আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন, টুপি হাতে করে। মেয়েটির বয়স বছর সতের। ছিপছিপে লম্বা চেহারা, বেশ সুন্দরী। মাথায় একরাশ সোনালী চুল।
মিঃ লরী নমস্কার করলেন। অপরিচিত বৃদ্ধ ভদ্রলোকের যেরকম নমস্কার করা উচিত এক তরুণীকে, সেই ভাবেরই এ নমস্কার। কারণ, পরিচয় যেটুকু হয়েছিল একদিন, তা এ-মেয়েটির মনে থাকবার কথা নয়। পনেরো বছর আগে এই লুসী ম্যানেটকে তিনিই ফরাসীদেশ থেকে কোলে করে নিয়ে এসেছিলেন অবশ্য, কিন্তু এই দীর্ঘ পনেরো বছর একে আর দেখবার সুযোগ হয়নি তার। তিনি যখন টেলসন ব্যাঙ্কের লন্ডন-অফিসের খাতাপত্রের তদারকে ব্যস্ত, তখন লুসী ম্যানেটের তদারক করছিলেন পল্লী-অঞ্চলের এক বিদ্যালয়ের পরিচালক। অবশ্য, ব্যাঙ্ক থেকেই যোগানো হয়েছে লুসীর সমস্ত খরচা।
মেয়েটিই কথা বালো প্রথমে। ব্যাঙ্ক থেকে কাল একখানা চিঠি পেয়েছি, আমার বাবার টাকাকড়ি বিষয়-আশয়ের সম্বন্ধে। শুধু টাকাকড়িই নয়, বাবার নিজের কথাও কিছু আছে চিঠিতে। এতদিন পরে এ-রকম চিঠি এল–এতে আমি আশ্চর্য হয়ে গেছি। বাবাকে আমি চোখেও দেখিনি । শুনেছি যে আমার জন্মের কয়েকমাস আগেই–