দোকান বন্ধ করে ডিফার্জ-দম্পতি চুপি চুপি কথা কইছে। স্বামী বলছে–আর কতদিন বলো দেখি? কতদিন আর অপেক্ষা করতে হবে এমনি ধারা?
স্ত্রী উত্তর দিচ্ছে–হয়তো বহুদিন! জমি তৈরি করার সময়টা দীর্ঘই হয়ে থাকে! ভূমিকম্পের কথা ভাবো! এক মিনিটে গোটা দেশটা ধ্বংস করে দেয় সে। কিন্তু ভূমিকম্পের উপযোগী অবস্থা তৈরি হয় মানুষের চোখের আড়ালে দীর্ঘদিন ধরে। বজ্রপাতের কথা ভাবো! বাজ মাথায় পড়লে এক সেকেন্ডে মানুষ মরে। কিন্তু বজ্রপাতের উপযোগী অবস্থার আবহাওয়া তৈরি হয় দীর্ঘদিন ধরে। আমরাও প্রস্তুত হচ্ছি। একদিন বাজের মত পড়বো গিয়ে অত্যাচারীর মাথায়, ভূমিকম্পের মত এসে গুঁড়িয়ে দেবো অত্যাচারী বড়লোকদের সমস্ত শক্তি!
স্বামী বললে–একদিন? আমরা বেঁচে থাকতে-থাকতে আসবে কি সে-একদিন?
–নাই-বা এলো? প্রস্তুতি চলছে তো! দেশের প্রতি নগরে, প্রতি গ্রামে জ্যাকস্ ভাইদের সংঘ গড়ে উঠেছে। পুলিশে জ্যাক্স্, সেনাদলে জ্যাক্স্, দোকানে জ্যাক্স্, হোটেলে জ্যাকস্। একদিন এক শুভ মুহূর্তে এরা মাথা নাড়া দিয়ে জেগে উঠবে সবাই, অত্যাচারী রাজার সিংহাসন টলমল করে কেঁপে মাটিতে পড়ে চুরমার হয়ে যাবে অমনি। প্রতীক্ষা করো।
প্রতীক্ষা আর বেশি দিন করতে হলো না। বাসুকির সহস্র ফণা দুলে উঠলো একদিন প্রভাতে! ধরণী কেঁপে উঠলো থর-থর…থর…থর…।
রোগা, শুকনো দাঁড়কাক যেন হাজারে-হাজারে উড়ছে ডিফার্জের দোকানের চারিপাশে। কিন্তু এরা দাঁড়কাক নয়, মানুষ। এদের মাথার উপর ইস্পাতের ঝিলিক খেলে যাচ্ছে মাঝে-মাঝে। যে-কোন অস্ত্র হাতের কাছে পেয়েছে, তাই নিয়ে ছুটে এসেছে এরা। সারা সেন্ট আন্টইন-পাড়া এক সুরে গর্জন করছে, হাতিয়ার তুলে হাজারে-হাজারে অনাবৃত বাহু বাতাসে দুলছে শীতের দিনে পাতাঝরা অরণ্যে মলিন কালো বৃক্ষশাখার মত!
হাতে হাতে অস্ত্র, হাজারে হাজারে! কোথা থেকে এলো এত অস্ত্র? কেউ বলতে পারে না–কোথা থেকে এলো। কিন্তু এসেছে তারা…অজানা লোকেরা বিতরণ করেছে সেই অস্ত্র ভিড়ের ভিতর। বন্দুক, কার্তুজ, বারুদ, লোহার ডাণ্ডা, বাঁশের লাঠি, কাঠের মুগুর, ছুরি, কাটারি, কোদাল, কুড়াল–আঘাত করবার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে, এমন কোন জিনিসই বাদ পড়েনি। যাদের ভাগে কোন হাতিয়ার পড়লো না, তারা রাস্তা খুঁড়ে পাথর আর ইট তুলতে লাগলো। সেন্ট আন্টইনের প্রত্যেকটা লোকের মাথায় বিকার চেপেছে, বিকারের রোগীর মতই দপ্ করছে তাদের নাড়ী, জ্বলজ্বল করছে তাদের টকটকে লাল চোখ। জীবনটাকে সবাই মনে করছে খেলার বস্তু, আর সে খেলার বস্তুটাকে গুড়ো করে ভেঙে ফেলবার জন্যই ব্যস্ত হয়ে উঠেছে এই হাজার হাজার লোক–যারা দাঁড়কাকের মত এসে ভিড় করেছে ডিফার্জের দোকানের সমুখে, এই সাংঘাতিক সকালবেলায়।
দাঁড়কাকেরা ঘুরছে ডিফার্জকে কেন্দ্র করে। ধ্বংসের এই মহাযজ্ঞের প্রধান পুরোহিত সে। অস্ত্রবিতরণে ডিফার্জ, আদেশদানে ডিফার্জ, সকল ব্যাপারে ডিফার্জ! কাউকে পিছনে হটিয়ে দিচ্ছে, কাউকে সমুখে টেনে আনছে, কাউকে অস্ত্র দিচ্ছে, কারুর অস্ত্র কেড়ে নিচ্ছে, হুকুম দিচ্ছে, শাসন করছে, উপদেশ দিচ্ছে, মিনতি করছে–সারা গায়ে বারুদ আর ঘাম, চরকির মত ঘুরছে অনবরত।
–তিন নম্বর জ্যা, তুমি আমার কাছে থাক!–এই বলে সে চিৎকার করে উঠলো–এক নম্বর আর দু’নম্বর জ্যাস্ত তামরা এক-একটা দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করো, এগিয়ে গিয়ে! আমার স্ত্রী কোথায়? আমার স্ত্রী?…মাদাম ডিফার্জের উত্তর শুনতে পাওয়া গেল কাছেই! মাদাম ডিফার্জ কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। আজ আর তার হাতে সেলাই নেই, তার বদলে আছে একখানা কুঠার। কোমরবন্ধে একখানা বাঁকা ছোরা, আর একটা গুলিভরা পিস্তল। ডিফার্জ জিজ্ঞাসা করলো–তুমি কোন্ দিকে যেতে চাও?
উপস্থিত তোমাদের সঙ্গেই যাচ্ছি। কিন্তু আমি নেবো মেয়েদের দলের নেতৃত্ব। শয়তানদের হত্যা করার কাজে মেয়েরা কি অক্ষম?
বজ্রনাদ ____ করে উঠলো ডিফার্জ–দেশপ্রেমিক বান্ধবেরা! আমরা প্রস্তুত। চলো– ___ চলল!
এক গর্জন উঠলো বহু সহস্র কণ্ঠ থেকে। সেই বিরাট জনতা ছুটলো এবার, যেন কূল ছাপিয়ে সমুদ্র ছুটলো তরঙ্গে-তরঙ্গে। সমগ্র নগরী প্লাবিত, মগ্ন হয়ে গেল সেই তরঙ্গের নিচে। গির্জায়-গির্জায় বাজছে আতঙ্কের ঘণ্টা, জয়ঢাক বাজছে তোরণে-তোরণে, উদ্বেল সমুদ্র ধেয়ে গিয়ে ভেঙে পড়লো ব্যাস্টিল-কারাদুর্গের পাঁচিলের ওপর।
গভীর পরিখা ব্যাস্টিলের চারিপাশে। একটার পর একটা টানা-সেতু-নীরেট পাথরের প্রশস্ত দেওয়াল, তার মাথায় আটটা গুম্বজ,-গুম্বজে-গুঁজে কামান, বন্দুক, আগুন, বিস্ফোরক! মৃত্যুকে তুচ্ছ করে আগুন আর ধোঁয়ার ভিতর এগিয়ে চললে পাগল জনতা, আগুন আর ধোঁয়া অতিক্রম করে এগিয়ে গিয়ে গুম্বজে-গুম্বজে কামান নিলো দখল করে।
মদের দোকানী ডিফার্জ চোখের পলকে গোলন্দাজ হয়ে দাঁড়ালো। ঘণ্টার পর। ঘণ্টা কামান দাগতে লাগলো ব্যাস্টিলের দুর্গপ্রাচীরে। গভীর পরিখা পার হয়ে, টানা-সেতু উত্তীর্ণ হয়ে, নীরেট পাথরের দেয়াল টপকে, গুম্বজে-গুম্বজে কামানের পাশে দাঁড়ালে গিয়ে বিরাট জনসমুদ্র। ডিফার্জ গর্জন করে ওঠে থেকে থেকে– কমরেডরা! বিশ্রাম নেই…শত্রু মাররা! এগিয়ে চলো ব্যাস্টিলের মাঝখানে! জ্যাক। নম্বর এক! জ্যাক্স্ নম্বর দুই! জ্যাক্স্ নম্বর এক হাজার! জ্যাক্স্ নম্বর দু’ হাজার! জ্যাক্স্ নম্বর পঁচিশ হাজার! ভগবানের ভক্ত, ভগবানকে ডেকে নাও! শয়তানের যে সঙ্গী, শয়তানকে সে স্মরণ কর! এগিয়ে চলো বন্ধু! এগিয়ে চলল! শত্রু মারো!