লুসী ব্যথিত-কণ্ঠে বলে উঠলেন–স্বপ্ন কি নিছক স্বপ্নই রয়ে যাবে, মিস্টার কার্টন? ওর এক তিলও কি সত্য হয়ে বজায় থাকবে না আপনার জীবনে?
–না, সে আশা নেই। এ হৃদয় ছাইয়ের গাদা, এক কণা আগুনও যদি থাকতো। এতে, তারই আলোতে পথ দেখতে পেতাম হয়তো উপরে উঠবার। কিন্তু এ ছাইয়ের গাদা অন্তত এক লহমার জন্যেও উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে উঠেছিল আপনাকে দেখে, এ আমি ভুলতে পারবো না। ভুলতে পারবো না, কিন্তু উঠতেও পারবো না আমি। আগুন জ্বলে উঠে আবার তখনই নিবে গেছে, সে স্বর্গীয় আগুনকে জ্বালিয়ে রাখবে, এমন কাঠখড় তো আমার এ ছাইয়ের গাদায় ছিল না! প্রেরণা আপনি দিয়েছিলেন, কিন্তু আমার অন্তরে সৎ বৃত্তি কোথায় যে সে-প্রেরণাতে কাজ হবে?
–আপনার দুঃখকে আরও বাড়িয়ে দিলাম তাহলে আমি! দুর্ভাগ্য আমার! সকাতরে বললেন লুসী।
–না, না, এমন কথা বলবেন না। কেউ যদি আমায় উদ্ধার করতে পারতো তাহলে সে আপনি। কিন্তু উদ্ধার হবার মত শক্তিই নেই আমার, সে আমি হারিয়ে ফেলেছি! দীর্ঘদিনের অনাচারের নিচে সে কোথায় চাপা পড়ে হারিয়ে গেছে। তাকে আজ আর খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়!
–আপনার কোন উপকারেই কি তাহলে আসতে পারি না আমি?
–আপনি ধৈর্য ধারণ করে, সমবেদনার সঙ্গে এই অপদার্থ জীবের দুঃখের কথা শুনেছেন, এইতেই অপরিসীম উপকার করা হল আমার। বিশ্বাস করুন মিস্ ম্যানেট, এই যে একান্ত নিরিবিলি আপনার কাছে আমার মনের গোপন ব্যথা জানাতে পেরেছি, এ সৌভাগ্যের কথা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমি মনে রাখব, চিরদিন এর স্মৃতি আমায় গভীর আনন্দ দেবে।…হ্যাঁ, এ আলাপন আপনি গোপনই রাখবেন তো? আপনার কাছে ঐ আমার একটিমাত্র ভিক্ষা!
-~-অবশ্য।
–আপনার অতি প্রিয় ব্যক্তির…প্রিয়তমের কাছেও কোনদিন প্রকাশ করবেন না তো এ-কথা?
লুসী একটু ইতস্তত করে তারপর বললেন–আপনার গোপন কথা প্রকাশ করবার অধিকার আমার কি আছে? আপনি চিন্তা করবেন না। এ-কথা কেউ জানবে না।
–ধন্যবাদ! ভগবানের আশিস বর্ষিত হোক আপনার উপর।
বিদায় নিয়ে দ্বার পর্যন্ত গিয়ে আবারও ফিরে দাঁড়ালো সিডনী।–আপনার ভয় নেই মিস্ ম্যানেট, এ-প্রসঙ্গের আলোচনা আর কখনো শুনতে পাবেন না আমার মুখে। আজও যে একথা শুনতে পেলেন, সে শুধু আমি একটা প্রলোভন দমন করতে পারিনি বলে। কী প্রলোভন, বলব? আমি সারা জীবন মনে মনে অনুভব করতে চাই যে, আমার গোপন-কথা আমারই অন্তরে শুধু নিবদ্ধ নেই, আমার গোপন-ব্যথা গোপনে বহন করবার জন্য আর-এক অংশীদার আছে আমার। আমার নাম, আমার অকীর্তি, আমার বিফল ভালোবাসার কাহিনী যে আপনার কোমল হৃদয়ের এক কোণে চিরদিনের জন্য একটুখানিও স্থান লাভ করল, এ আমার পরম সৌভাগ্য কুমারী ম্যানেট, এ আমার আশাতীত আনন্দ!
কার্টনের যে মূর্তি এতদিন চোখে পড়েছে লুসীর, তার চেয়ে এতটাই আলাদা, এতখানি উঁচু তার আজকের এই মূর্তি, যে, তাকে বিদায় দেবার কালে একটা সান্ত্বনার কথাও বলবার পথ না পেয়ে লুসী ব্যথিত-হৃদয়ে অশ্রুবর্ষণ করতে লাগলেন। সিডনী দেখলো সে অশ্রু, দেখে বললো-কাঁদবেন না কুমারী ম্যানেট! কার জন্য কাঁদছেন? একটা অপদার্থ! একটা পশু! এখান থেকে বেরিয়ে গিয়েই যে আবার তার অভ্যস্ত পাঁকের রাজ্যে নেমে যাবে! কার জন্য দুঃখ করছেন আপনি?–তবে হ্যাঁ, যতই নেমে যাই-না কেন, যে-নরকেই বাস করি না আমি, আপনার সেবার সুযোগ যদি কখনো পাই, প্রাণ দিয়েও আমি তা করব–এ-কথা বিশ্বাস করুন কুমারী ম্যানেট! প্রাণ দিয়েও তা করব আমি! আপনি সুখী হোন। আর, সর্বসুখের মাঝে যেন আপনার স্মরণ থাকে যে, আপনার সুখের পথের কাটা দূর করবার জন্য প্রাণ পর্যন্ত উৎসর্গ করতে প্রস্তুত একটা জীব ধরায় আছে, নাম তার–সিডনী কার্টন।
০৬. ঝড় বুঝি উঠছে
পাঁচ বৎসর পরে।
লন্ডনে সোহো-পল্লীর এক গৃহে এক সুখী পরিবার। ডার্নে লুসীকে বিয়ে করেছেন। লুসী ম্যানেট আজ লুসী ডার্নে। তাদের একটি ছোট্ট মেয়েও হয়েছে, মায়ের নামে তাকে ডাকা হয় ছোট্ট লুসী বলে।–এই কয়টি মাত্র প্রাণী নিয়ে সেই ছোট্ট পরিবার। তবে হ্যাঁ, পরিবারভুক্ত না হয়েও এঁদের একটি অতি আপনজন বিশিষ্ট বন্ধু আছেন তিনি হলেন মিস্টার লরী, টেলসন ব্যাঙ্কের কর্মাধ্যক্ষ।
আর এই পরিবারে মাঝে মাঝে দুই-এক ঘণ্টার জন্য একজন সুপরিচিত অতিথির দেখা মেলে, সে হচ্ছে সিডনী কার্টন, যার সঙ্গে ছিল ডার্নের আশ্চর্য চেহারার মিল। বৎসরে তিন-চারবারের বেশি সে আসে না। এসেও ছোট্ট লুসী ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে বেশি কথা সে বলে না। দু’এক ঘণ্টা! তারপরেই সে চলে যায় আবার। দিন দিন ধাপের পর ধাপ নেমে যাচ্ছে সে, তা তার চেহারা দেখেই বোঝা যায়। মুখে ভদ্রতার অভাব না দেখিয়েও অন্তরে সবাই তাকে তাচ্ছিল্য করে, শুধু এক লুসী ছাড়া। লুসীর হৃদয় বেদনায় করুণ হয়ে ওঠে, সিডনীর বিবর্ণ মলিন মুখের দিকে চাইলেই।
ওদিকে প্যারী নগরে ডিফার্জের মদের দোকান আগের চাইতেও সরগরম। মাদাম ডিফার্জের সেলাইয়ের বিরাম নেই। একা মাদাম ডিফার্জ নয় আবার! আজকাল ঐ দোকানের এক অংশে বহু নারী এসে সেলাই নিয়ে বসে। সংকেতে কথা হয়। গুপ্তচরের ভয়ে সবাই সচকিত হয়ে ওঠে মাঝে মাঝে। ডিফার্জ সদা সতর্ক!
একদিন গভীর রাত্রে।