*
পরের দিন।
একা ঘরে বসে সেলাই করছিলেন লুসী ম্যানেট।
ঘরে এসে ঢুকলো সিডনী কার্টন। মক্কেলশূন্য উকিল সিডনী, যার কাজ হলো অন্য উকিলদের কাগজ ঠিক করে দেওয়া, আর কোর্টে গিয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকা।
উপার্জন কিছু আছে। অন্য উকিলদের সাহায্য করে বেশকিছু পায় সে। তার বারো-আনা খরচ হয় মদে। সংসারে সে একা। আপনার জন্য কোথাও কেউ নেই। প্রতিভা ছিল, নষ্ট হয়েছে মদে। কর্মশক্তি ছিল, লোপ পেয়েছে মদে। মনুষ্যত্ব ছিল, প্রায় ধ্বংস হয়েছে মদে। প্রায়’ বলছি এইজন্য–মাঝে-মাঝে তার আচরণে নিবন্ত মনুষ্যত্বের ছাই-চাপা পাঁশুটে আলো এখনো এক-আধবার দেখা দেয় বইকি!
সিডনী কার্টন এসে ঘরে ঢুকলো। লুসী অভ্যর্থনা করে বসতে বললেন তাকে। একটু বিব্রত বোধ করলেন বইকি লুসী! সিডনীকে ঠিক সুস্থ মনে হচ্ছিল না। লুসীর মনে হল, হয়তো অতিরিক্ত পান করে এসেছে সে। কিন্তু এ কী?–সিডনীর। মুখে তো এ-রকম বিষণ্ণ ভাব কখনো দেখা যায় না! যা দেখা যায় সর্বদা, সে । হল ছোট-বড় কতকগুলো রেখা–যাদের দিকে তাকালেই লোকের বুঝতে বাকি থাকে না যে সিডনী কার্টন কত বড় উচ্ছঙ্খল, অসংযমী আর চরিত্রহীন পুরুষ। আজকের এ মলিন মনমরা ভাব তো সিডনীর মুখে বড় কেউ দেখেনি কোনদিন।
লুসী প্রশ্ন করলেন–আপনার কি অসুখ করেছে মিস্টার কার্টন?
–না। তবে আমি যে-জীবনযাপন করি, তাতে স্বাস্থ্য তো ভালো থাকবার কথা নয়! দুশ্চরিত্র লোকের মুখে লাবণ্যের আলো দেখবার আশা করবেন না।
–এর চাইতে ভালো জীবনযাপন করায় তো বাধা নেই, মিস্টার কার্টন।
–বড্ড দেরি হয়ে গেছে। আর উঠবার আশা নেই, এখন ক্রমেই নামছি, নামতে থাকবো!
টেবিলের উপর দুই কনুই রেখে, দুই হাতে মুখ ঢেকে বসে রইলো সিডনী। অন্তরের আবেগে সারা শরীর কাঁপছিল তার, টেবিলখানাও কাঁপতে লাগলো তার কনুইয়ের ভারে।
সিডনীর এ-রকম কাতরতা কখনো দেখেননি লুসী। তিনিও বিষণ্ণ হয়ে পড়লেন। সিডনী মুখ না তুলেই বলতে লাগলো–আমায় ক্ষমা করতে হবে কুমারী ম্যানেট! একটা কথা বলতে এসেছি। কিন্তু বলতে এসে এখন ভয়ে কাঁপছি, এমন গুরুতর কথা সেটা। আপনি শুনবেন আমার কথাগুলি?
–শুনলে যদি আপনার কোন উপকার হয়, তবে সানন্দে শুনবো।
–এত দয়া আপনার? ভগবান ভালো করুন আপনার!
মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে ধীরভাবে বলতে লাগলো সিডনী–ভয় পাবেন না, শুনুন। যা বলবো, তাতে শিউরে উঠবেন না। লোকে বলে না–আহা! ছেলেটা মরে গেল, নইলে খুব বড় হতে পারতো? আমিও সেইরকম। মরে গেছি। তা নইলে বড় হতে পারতাম!
লুসী বললেন–কেন একথা বলছেন? আমার তো মনে হয় এখনো সময় আছে আপনার, ইচ্ছে করলে আপনি এখনো একটা যোগ্য নোক হয়ে উঠতে পারেন।
–আপনার যোগ্য? একবার কথাটা বলুন মুখ দিয়ে, মিস্ ম্যানেট! বিশ্বাস করবার মত কথা না হলেও সে কথাটা আমি সারাজীবন মনে রাখবো…সারা জীবন!
লুসীর মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল, তিনি কাঁপতে লাগলেন।
সিডনী বলে চললো–এই দেখুন আমাকে। নিজেকে নিজে নষ্ট করেছি, শরীরটাকে করেছি ধ্বংস!…মাতাল। প্রতিভার অপচয় করে-করে অন্তর আজ শূন্য! এই অপদার্থ জীবের ভালোবাসার প্রতিদান দেওয়া যদি আপনার পক্ষে সম্ভবও হত, তাহলেও আমি খুশি হতাম না তাতে। আমি জানি আমার দ্বারা একটা জিনিসই ঘটতে পারত সে ক্ষেত্রে, আপনাকে কলঙ্কে ডুবিয়ে, অনুতাপে মনস্তাপে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিজের সাথে-সাথে নরকে নামিয়ে নিয়ে যাওয়া আপনাকে! তাছাড়া অন্য কিছু করবার শক্তি ছিল না আমার! কিন্তু সে সব কথা অবান্তর! আমি জানি আমার জন্য কোন করুণা আপনার অন্তরে থাকতে পারে না। পারে না যে–এতে আমি খুশি, মিস্ ম্যানেট!
–সে করুণা না-ই যদি থাকে, তবুও কি আপনার কোন উপকারে আসতে পারি না আমি? মহত্ত্বের পথে কি আবার তুলে দাঁড় করিয়ে দিতে পারি না আমি আপনাকে? আপনি যে বিশ্বাস করে আপনার হৃদয়ের গোপন ব্যথার কথা আমায় জানিয়েছেন, তার প্রতিদানে আপনার কি কোন উপকারই করতে পারি না আমি?
লুসীর চোখ জলে ভরে এল। তিনি সকাতরে বললেন–আপনার কোন উপকারে কি আসতে পারি না আমি?
সিডনী মাথা নেড়ে বললো–না। কিছু না! তবে আর দু’একটা কথা বলবার আছে। তা যদি শোনেন ধৈর্য ধরে, তাহলেই যথেষ্ট উপকার করা হবে। আমি আপনাকে জানাতে চাই যে, আমার জীবনে এই অল্প কিছুদিন আগে থেকে একটিমাত্র সুখস্বপ্নের উদয় হয়েছিল, সে-স্বপ্ন-আপনি। এই গৃহের সুখ-নীড়ের মাঝখানে আপনাকে দেখবার পর থেকেই প্রত্যহ অন্তত একবার আমার মনে হয়েছে আমার শৈশবের গৃহের কথা–যার কথা তার আগে এতদিন আমার একবারও কখনো মনে হত না। সেখানে এমনি নির্মল আবহাওয়া চিরদিন বিরাজ করত, আমার দেবীর মত মায়ের আশেপাশে। আপনার সঙ্গে পরিচিত হবার পর থেকেই মাঝে মাঝে মনস্তাপ দেখা দিয়েছে আমার নিঃসাড় প্রাণে-হায়, এ আমি কোথায় নামিয়ে এনেছি আমাকে! আপনার কাছে আসবার পর থেকেই মাঝে-মাঝে শুনতে পেয়েছি কাদের যেন বিস্মৃত কিন্তু পরিচিত কণ্ঠস্বর–ওঠো, এই পাঁকের ভিতর পড়ে থেকো
আর, উঠে চলো আলোর রাজ্যে!–মনে জেগেছে আধ-গড়া সংকল্প-হা, আমি উঠবো, আবার উঠবো, এই আলস্য আর লালসার দাসত্ব ঝেড়ে ফেলে আবার। নতুন করে শুরু করব সেই জীবন-সংগ্রাম–যা থেকে ভীরুর মত পালিয়ে এসে সকলের পেছনে মুখ লুকিয়েছি আমি! কিন্তু সে সংকল্প আধ-গড়াই রয়ে গেছে চিরদিন, পুরোপুরি গড়ে উঠতে আর পারেনি, কুমারী ম্যানেট! শেষ পর্যন্ত সে একটা স্বপ্ন মাত্রই রয়ে গেল…সুখস্বপ্ন! স্বপ্নই বটে, কুমারী ম্যানেট…কিন্তু আমার জীবনে স্বপ্নও আজকাল কদাচিৎ আসে। তাই এর মূল্য আছে আমার কাছে, আর তাই আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ–আমার জীবনে এ স্বপ্নের উদয় আপনার জন্যই সম্ভব হয়েছিল বলে।