ডাক্তার ম্যানেট! আপনার কন্যা যে এখন বাড়িতে নেই, তা জেনেই আমি এসেছি। তিনি ফিরে আসবার আগেই দু-একটা কথা বলতে চাই আমি আপনাকে।
–কি বলবে, বলো! কীভাবে কথা শুরু করবেন, তা ঠিক করতেই যেন ডানের কিছু সময় কেটে গেল। তারপর তিনি বললেন কিছুদিন থেকে আপনার এখানে যে-রকম ঘনিষ্ঠভাবে মিশবার সুযোগ পেয়েছি আমি, তাতে আমার আশা হয়–যে-বিষয়ে আমি কথা কইবো আজ
ডাক্তার যেন হাত বাড়িয়ে থামিয়ে দিতে চাইলেন ডার্নেকে। তারপর হাত গুটিয়ে এনে ধীরে ধীরে নিচুগলায় বললেন :
–কথাটা কি, লুসী-সম্পর্কে?
–আজ্ঞে, হ্যাঁ।
–বলো!
–কী আমি বলবো, তা বোধ হয় বুঝতে পারছেন আপনি। আপনার কন্যাকে আমি ভালোবাসি! সারা হৃদয় দিয়ে! নিঃস্বার্থভাবে! ভক্ত যে-ভাবে পূজা করে উপাস্য দেবীকে, সেইরকম পূজা করি আমি তাকে! এই কথাই বলতে এসেছি আমি আপনাকে।
ডাক্তার বসে রইলেন অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে, মাথা নিচু করে। লুসীকে বিয়ে দিয়ে পর করে দেবেন, এ কথা ভাবতেই তার কষ্ট হয়। লুসী ছাড়া জগতে তার কে আছে আর? লুসীই তাকে কবর থেকে তুলে এনেছে। লুসীরই সেবা আর যত্নে তিনি নিজের মনুষ্যত্ব আর প্রতিভা ফিরে পেয়েছেন; সমাজে আবার দশজনের একজন হতে পেরেছেন। লুসীকে হারালে এ-সবই আবার হারিয়ে ফেলা অসম্ভব নয় তার!
বহুক্ষণ নিস্তব্ধ থাকবার পর ডাক্তার বললেন–তুমি কি লুসীকে বলেছো এ কথা?
–না।
–চিঠিতেও লেখোনি?
–কখনো না।
–বলোনি, বা লেখোনি যে, তা আমি বুঝি! আমি ধন্যবাদ দিই তোমায়। ডার্নে বলতে লাগলেন–ডাক্তার ম্যানেট। আমি জানি, আপনার পক্ষে লুসী এবং লুসীর পক্ষে আপনি কত বেশি প্রয়োজনীয়। শৈশবে লুসী পিতামাতার স্নেহ পাননি, আপনাকে তিনি পেয়েছেন রীতিমত বড় হয়ে। যেন পরলোক থেকে ফিরে পেয়েছেন তিনি আপনাকে। তার অন্তরের স্নেহভক্তি–যা জীবনের প্রথম সতেরোটি বৎসরের ভিতর ফুটে উঠবার কোন পথই পায়নি, তা অকস্মাৎ আপনাকে পেয়ে একান্ত নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরলো–এক নিশ্বাসে আপনার উপর উজাড় করে দিল ভক্তি, ভালোবাসা, স্নেহ, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, নারীর অন্তরে যত কিছু পবিত্র ভাব থাকে সবই। আবার আপনিও আঠারো বৎসর এমন জায়গায় আটক ছিলেন, যার তুলনা করা যায় শুধু কবরের সঙ্গে। সেখান থেকে ভগবানের দয়ায় বেরুবার পরে ঐ মেয়েকে অবলম্বন করেই ফিরে পেলেন জীবন, স্বাস্থ্য, প্রতিভা, কর্মশক্তি, আশা ও আনন্দ। দেশের বে-আইনী অত্যাচারে, আঠারো বৎসর পূর্বে যে মহীয়সী পত্নীর কাছ থেকে চিরদিনের জন্য আপনাকে দূরে সরে যেতে হয়েছিল, তারই ছায়া যেন আপনি দেখতে পেলেন লুসীর মাঝে! ঐ মেয়েই আপনার জীবনের সম্বল, ওঁকে কেন্দ্র করেই আপনার সংসার, উনিই আপনার চোখের আলো– তা সবই বুঝি আমি। এ অবস্থায় বিয়ে দিয়ে ঐ মেয়েকে পর করে দেওয়া আপনার পক্ষে কতখানি শক্ত, তাও আমি বুঝি! আর বুঝি বলেই, এ বিয়ের প্রস্তাবই আমি উত্থাপন করতাম না, যদি-না এমন একটা উপায় আমি আবিষ্কার করতে সক্ষম হতাম, যাতে আপনাকে দুঃখ পেতে না হয়। আমার প্রস্তাব এই যে, লুসীকে আমি আপনার কাছ থেকে নিয়ে যাবো না, আমিই এসে আপনার কাছে আশ্রয় নেবো লুসীর পাশে! একটি সন্তানের জায়গায় দু’টি হবে আপনার!
এতক্ষণ নীরব নিস্পন্দ থাকবার পর, ডাক্তার এইবার ডার্নের হাতের উপর একটুখানি মৃদু চাপ দিলেন। তারপর, এতক্ষণ পরে তিনি মুখ তুলে চাইলেন একবার। তার মুখ দেখেই ডানে বুঝলেন যে অন্তরে তার লড়াই চলেছে একটা; মেয়ের ভালো কিসে হবে সেই চিন্তা একদিকে, আর নিজের সুখ-সুবিধা কিসে বজায় থাকবে–সেই চিন্তা অন্য দিকে। লড়াইয়ে যে নিজের সুখের চিন্তা পরাজিত হতে বাধ্য, তা আগে থাকতেই বুঝতে পেরেছেন তিনি। বুঝতে পেরে ভয়ও পেয়েছেন; সে-ভয়ের ছায়া তার মুখেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। এইবার তিনি ধীরে ধীরে বললেন–ডার্নে, এমন আন্তরিকতার সুর, এতখানি উদারতার পরিচয় তোমার কথার ভিতর দিয়ে ফুটে বেরুচ্ছে বৎস, যে, তোমায় ধন্যবাদ না দিয়ে আমি পারি না। লুসী তোমায় ভালোবাসে বলে কি তোমার মনে হয়?
–এখন পর্যন্ত, কই, সে-রকম কিছু মনে করবার কোন কারণ দেখতে পাইনি আমি।
–আমার অনুমতি পেলে, তুমি কি এখনই লুসীর কাছে কথা তুলতে চাও?
–না, তাও না। কবে যে সাহস করে তাকে এ-কথা বলতে পারবো, তা। আমি জানি না! হয়তো কয়েক সপ্তাহের ভিতরও সে সাহস আমি সঞ্চয় করে উঠতে পারবো না।
–তুমি কি আমার কাছে পরামর্শ চাও?
–যদি দয়া করে দেন—
–কোন প্রতিশ্রুতি চাও আমার কাছে?
–চাই। আর বেশি কিছু নয়, লুসী নিজে যদি কখনো আপনার কাছে পরামর্শের জন্য আসেন এই ব্যাপারটি নিয়ে, তাহলে আপনি আমার বিপক্ষে কিছু বলবেন না, এইটুকু ভিক্ষা আমি চাই আপনার কাছে।
–সে অনুরোধ আমি রক্ষা করবো তোমার! তোমার বিরুদ্ধে আমি কখনো কিছু বলবো না–যদি বুঝি যে লুসীর সুখের জন্য তোমার সঙ্গে তার বিবাহ দেওয়া একান্ত আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি জানি না তোমার প্রকৃত মা, তোমার পারিবারিক ইতিহাস–না, না, এখন সে-সব বলবার প্রয়োজন নেই। কিন্তু এ কথা আমি তোমায় বলছি–তোমার নাম বা পারিবারিক ইতিহাস শুনে তোমার উপর যদি আমার দারুণ বিরাগও জন্মে কোনদিন, তাহলে সে বিরাগও আমি দমন করবো লুসীর মুখ চেয়ে। আমার নিজের আপত্তির জন্য লুসীর সুখের পথে বাধা হবো না আমি।