-বেশ, বেশ। ম্যানেটের এক মেয়ে আছে না? তোমার এ নতুন মতবাদের মূলে কি সেই ম্যানেটের মেয়ে? যাকগে, ঘুম পাচ্ছে আমার! কাল আবার কথা হবে বৎস। শুভরাত্রি!
এই বলে মার্কুইস ঘণ্টা বাজালেন। ভৃত্যেরা আলো নিয়ে এলো ডার্নেকে তার শয়নকক্ষে নিয়ে যাবার জন্য। মার্কুইসও নিজের ঘরে প্রবেশ করলেন গিয়ে। কিন্তু আজ কেন চোখে ঘুম আসে না?
সুকোমল সুগন্ধি রাজশয্যায় শুয়ে মাকুইসের নয়নে তবু নিদ্রা নেই। চোখের সামনে ছবির পর ছবি ভেসে ওঠে। ঘরের ভিতর অন্ধকার; কিন্তু সে অন্ধকারের বুক থেকে ফুটে ওঠে রক্তরাঙা সব ছবি। প্যারীর রাজপথ, রাজপথের কোণে ফোয়ারা, গাড়ির চাকার নিচে দলিত মাংসপিণ্ড…মুমূর্ষ চিৎকার করছে…অন্ধকারে রক্তবিন্দু ঝরে পড়ছে শিশিরের মতন।
এমন সময় অকস্মাৎ একটা ঘ-ঘস্ শব্দ ঘরের ভিতর! মাকুইস চকিত হয়ে ওঠেন, কিন্তু ভৃত্যদের ডাকবার আগেই একখানা ছোরা আমূল বিঁধে যায় তার হৃদয়ে। প্রায়শ্চিত্তের পালা শুরু হয়েছে এবার।
***
সেই গ্যাসপার্ড! যে একদিন লাল মদ দিয়ে দেওয়ালের গায়ে লিখেছিল–”রক্ত? রক্ত!” যে একদিন কেঁদে ভাসিয়ে দিয়েছিল পুত্রকে মাকুইসের গাড়ির তলায় চাপা পড়তে দেখে! সেই গাড়ির নিচেকার লৌহদণ্ড ধরে ঝুলতে-ঝুলতে মাকুইসের অনুসরণ করেছিল।
গ্যাসপার্ড কিন্তু ধরা পড়লো! পালাতে পারলো না। মাকুইসের প্রাসাদের পায়ের তলায় মাথা গুঁজে পড়ে আছে যে গরীবদের গ্রাম, সেইখানে হলো তাঁর ফাঁসি। চল্লিশ ফুট উঁচুতে তুলে ফাঁসি দেওয়া হল তাকে। সেই চল্লিশ ফুট উঁচুতে ঝুলতে থাকলে তার দেহ, যতদিন না পচে গলে খসে পড়লো তার হাত-পাগুলো–চল্লিশ ফুট নিচের গ্রামের ভিতর। জমিদার খুন? এ-পাপের এমনি চরম দণ্ড না দিলে দেশে শান্তি রক্ষা হবে কি করে?
দিন যায়। অত বড় দাপট যে মাকুইসের, তিনি আর নেই! যিনি চাবুকের চোটে শায়েস্তা রাখতে চেয়েছিলেন দেশের লোককে, তিনি হঠাৎ-ই, দেশকে অভিভাবকশূন্য করে চলে গেলেন পরলোকে। তাঁর ভ্রাতুস্পুত্র–যিনি বিশ বৎসরের ভিতর জমিদারী হাতে পাবার প্রত্যাশা করেননি, তিনি হঠাৎ প্রভাতে শয্যাত্যাগ করেই দেখতে পেলেন–জমিদারী পেয়ে গেছেন তিনি। গ্যাবেলকে ডেকে পাঠালেন।
এ টেস্ অব দ্যু সিটীজ গ্যাবেল হল মাকুইসের তহশীলদার। খাজনাপত্র সেই আদায় করে। এখন থেকে আর কোন খাজনা আদায় হবে না প্রজাদের কাছে, বরং উলটে সকল রকমে তাদের সাহায্য করা হবে জমিদারীর সঞ্চিত অর্থ থেকে, এই সোজা আদেশ দিয়ে ডার্নে প্রস্থান করলেন লন্ডনে। এই অভিশপ্ত জমিদারীতে বাস করবেন না তিনি, পাছে সংক্রামক ব্যাধির মত তার মনেও ক্ষমতার মোহ সঞ্চারিত হয়।
ডার্নে চলে গেলেন, গ্যাবেল নতুন নিয়মে জমিদারী চালাবার জন্য প্রস্তুত হল। কিন্তু সে প্রস্তুত হবার আগেই একদিন মাকুইসের প্রাসাদে আগুন লাগলো! গ্রামের লোকে হাত গুটিয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো সেই আগুন। এ ওকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলো–আগুনটা চল্লিশ ফুট উঁচুতে উঠেছে কি না!
সেই একই রাত্রে ও-অঞ্চলের প্রত্যেক জমিদারবাড়িই আগুনে ছাই হয়ে গেল! প্রায়শ্চিত্তের দ্বিতীয় কিস্তি!
০৫. ভালো ও মন্দ
শত্রুরা ম্যানেটকে ব্যাস্টিল কারাগারে আটক করবার আগে চিকিৎসক হিসাবে তার খুব নাম ছিল। আঠারো বছর নির্জন কারায় বাস করে তিনি যখন স্বাধীনতা ফিরে পেলেন আবার, তখন তিনি পাগল বললেই হয়। ওঁর অবস্থা দেখে মেয়ে লুসী, বা বন্ধু লরী, কেউই আশা করতে পারেননি যে, এই পাগলের মাথা আবার ঠিক হয়ে আসবে, তিনি আবার আগের মতই ভালো চিকিৎসক হয়ে বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে চমৎকার চিকিৎসা করতে পারবেন।
কিন্তু যা আশা করা যায়নি, সেই ব্যাপারও সত্যই ঘটলো। সেই জড়তার আবরণ–ম্যানেটের দেহ-মন যার নিচে একেবারেই চাপা পড়ে গিয়েছিল, ভালোবাসার পরশ পেয়ে ধীরে ধীরে তা সরে যেতে লাগলো, যেন রৌদ্রের তাপে বরফ গলে যাচ্ছে। ম্যানেটের মনুষ্যত্ব লোপ পেয়েছিল একেবারে, তার প্রতিভা পড়েছিল ঘুমিয়ে। লুসী আর লরী–দু’জন দু’ভাবে তাদের জাগিয়ে তুললেন আবার। পাঁচ বৎসরের ভিতর লন্ডন-নগরের বড়লোক-মহলে ডাক্তার ম্যানেট সুবিজ্ঞ চিকিৎসক বলে বিখ্যাত হয়ে উঠলেন। তাঁর জ্ঞানও অসাধারণ, আবার রোগীর জন্য তিনি খাটেনও খুব বেশি; কাজেই তার উপার্জনও হয় প্রচুর।
একদিন তার সঙ্গে দেখা করতে এলেন, চার্লস ডার্নে। লন্ডনে ইনি ফরাসী ভাষা শিক্ষা দেন, ইংরেজ তরুণ-তরুণীদের। এঁরও আয় ভালো। মাঝে মাঝে কেমব্রিজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে নিজেও পড়াশুনা করেন।
ম্যানেট-পরিবারের সঙ্গে তিনি এখন খুবই মেলামেশা করেন। সেই মামলার পর থেকেই ঘনিষ্ঠতা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। আর একজনও ম্যানেট-পরিবারের বাড়িতে আনাগোনা করে থাকেন–ঐ একই সময় থেকে। ইনি অবশ্য ঘনিষ্ঠ হতে পারেননি, কিন্তু এঁকে দেখলেও বাড়ির লোকেরা খুশি হন, আদর করেই এঁকে গ্রহণ করেন। ইনি সেই মক্কেলশূন্য উকিল সিডনী কার্টন–কোর্টে গিয়ে যিনি তাকিয়ে থাকেন ছাদের দিকে, ডার্নের সঙ্গে যাঁর চেহারার মিল একদা ডানের প্রাণটাই বাঁচিয়ে দিয়েছিল।
সে-কথা যা। আমরা বলছিলাম–ডার্নে যে দিন ম্যানেটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছেন সেই দিনের কথা। ডাঃ ম্যানেট তখন অধ্যয়ন করছিলেন। ডার্নেকে দেখে বই রেখে দিয়ে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন–এসো ডার্নে! তিন চারদিন থেকেই ভাবছি তুমি এইবার আসবে, কারণ, কেমব্রিজে একটানা বেশিদিন থাকা তো তোমার অভ্যেস নয়! তুমি বসো! লুসী কী-সব কেনা-কাটা করতে গেছে। আসবে এখনই!