ডার্নে বললেন–আপনি এই এলেন প্যারী থেকে?
–হ্যাঁ। আর তুমি?
–সোজা লন্ডন থেকে!
–অনেক দিন থেকেই আসবার কথা শুনছিলাম তোমার।
–একটু দেরি হয়ে গেল! কাজ ছিল–
–তা তো বটেই!
ভৃত্যেরা যতক্ষণ কক্ষে রইলো, এইরকমই মামুলী আলাপ চললো দু’জনের ভিতর। তারপর ভোজন শেষ হয়ে গেল, কফি পরিবেশন করে ভৃত্যেরা চলে গেল ঘর থেকে। তখন ডার্নে বললেন :
যে-কাজের জন্য ঘুরছি কিছুদিন থেকে আপনি তা জানেন। তারই দরুন আসতে হল আবার! এ-রকম যাতায়াত খুবই বিপজ্জনক। এর জন্য বৃটিশ সরকারের সন্দেহভাজন হয়ে পড়েছি আমি। মাঝখানে রাজদ্রোহের মামলায় পড়েছিলাম। অতি কষ্টে প্রাণে বেঁচেছি! অবশ্য, প্রাণ গেলেও দুঃখ ছিল না। যে পবিত্র কাজ মাথায় তুলে নিয়েছি, তার জন্য হাসিমুখে মরতেও পারি আমি।
পিতৃব্য একটুও ব্যস্ত না হয়ে বললেন–আরে না, না, মরতে হবে কেন?
ভ্রাতুস্পুত্র উত্তর করলেন–অবশ্য, আমি মরতে বসলেও যে আপনি আমার রক্ষার জন্য কোন চেষ্টা করতেন না, তা আমি বিলক্ষণ জানি।
পিতৃব্য হাত নেড়ে একটা প্রতিবাদেরই ভঙ্গি করলেন অবশ্য, কিন্তু সে-প্রতিবাদ যে আন্তরিক নয়, তা বুঝতে কষ্ট হল না ডার্নের। তিনি যেন স্পষ্ট কথা শোনাবার জন্যই এসেছেন আজ; পিতৃব্যকে সোজা শুনিয়ে দিলেন–আপনার ক্ষমতা থাকলে আপনি বরং আমার বিপক্ষেই দুচারটা জোরালো প্রমাণ যুগিয়ে দিতেন, তা আমি বুঝি।
আশ্চর্য মানুষ এই মাকুইস! একটুও বিরক্ত বা ক্রুদ্ধ না হয়ে মিষ্টস্বরে বললেন– আরে, না–না! বলো কি?
ডার্নে সে-কথায় কান না দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন–আমার কাজে বাধা দেবার শক্তি থাকলে আপনি কি তা দিতেন না?
মাকুইসের অধরে চকিতের জন্য ক্ষীণ হাসি দেখা দিয়ে তা মিলিয়ে গেল। তিনি উত্তর করলেন–তা যে দিতাম, সে কথা তো আগেই বলেছি!
–সম্ভব হলে আপনি আমাকে ব্যাস্টিলে আবদ্ধ করতেন। বলুন, এ কথা সত্য কিনা!
–খুবই সত্য! ব্যাস্টিলে কিছুদিন রাখতে পারলে তোমার উপকার হতো। নির্জন কারাবাসে চিন্তার সময় পাওয়া যায়। আর চিন্তাতেই মানুষের স্বভাব শোধরায়।
ডানে হেসে বললেন–তাহলে বলতে হয় যে, এ-দেশের বর্তমান শাসক যাঁরা, তাদের সঙ্গে আপনার সদ্ভাব নেই বলেই আমি এখনো স্বাধীন আছি?
তিক্তকণ্ঠে মাকুইস বললেন–কী যে হল দেশটার! অল্পদিন আগেও আমরা যা খুশি তাই করেছি। যাকে দরকার ব্যাস্টিলে পাঠিয়েছি, যাকে ইচ্ছে ফাঁসিতে লটকেছি! কিন্তু সেভাবে চলতে গেলে এখন যেন সুবিধে হবে না বলে মনে হয় মাঝে-মাঝে! এ টেস্ অব সিটীজ একটা নতুন কথা শুনতে পাই এখন। জনগণের স্বাধীনতা! হাঃ হাঃ- কী গেরো বল দেখি! হতাশভাবে মার্কুইস এক টিপ নস্য নাকে খুঁজে দিলেন।
ডানে উত্তর করলেন–সেইভাবে চলে-চলে যা অবস্থা দাঁড়িয়েছে–ছিঃ ছিঃ! আমাদের এই বংশকে যতটা অভিশাপ দেয় এ-দেশের লোক, এমন আর বোধ হয় কাউকে নয়!
মার্কুইস যেন খুশি হয়ে বললেন–তাই তো চাই! যে অভিশাপ দেয়, বুঝতে হবে যে প্রতিহিংসা নেবার শক্তি তার নেই!
এ-কথার উত্তরে ডার্নে নতমুখে তাকিয়ে রইলেন টেবিলের দিকে। উদ্বেগ আর নৈরাশ্য তার বসার ভঙ্গি থেকেই ফুটে বেরুচ্ছিলো যেন। আর মাকুইস? তিনি যখন কথা কইলেন আবার, তা থেকে ফুটে বেরুলো শুধু অসহ্য দম্ভ। বলে চললেন– যত দিন এই প্রাসাদের উপর ছাদ বজায় থাকবে, ততদিন চাবুকের চোটে কুকুরের দলকে ঠাণ্ডা রাখবো বৎস! নিজেকে বড় করে রাখার সহজ পথ দুনিয়ায় চিরদিনই একটি মাত্র–সে হচ্ছে, অত্যাচার!
ডার্নে বললেন–অন্যায় করলেই সাজা পেতে হয় তার জন্য। আমরা অন্যায় করেছি, তারই সাজা আসছে কিস্তিতে কিস্তিতে। প্রথম কিস্তি এই অভিশাপ।
–আমরা অন্যায় করেছি?–মার্কুইস জিজ্ঞাসা করলেন–আমরা কারা?
–আমরা অভিজাতেরা! সে অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্তের জন্যই আমার ইংলন্ডে থাকা। মা আমায় আদেশ করে গিয়েছেন মৃত্যুকালে–এ জমিদারীর সঙ্গে সংস্রব না-রাখতে! অত্যাচারিত প্রজাদের মাথায় নতুন অত্যাচারের বোঝ আমি যেন কোনদিন না চাপাই, মা আমায় মিনতি করে গিয়েছেন বারবার।
মার্কুইস ব্যঙ্গের সুরে বললেন–জমিদারী আগে পাও তো, তারপর সে-কথা। আমি তো আজই মরছি না!
ডার্নে বললেন–না, সে কামনা আমি করি না। আপনি আরও দীর্ঘ দিন বাঁচুন!–তবে আপনার দেহান্ত ঘটলে এ-সম্পত্তি যদি আমার হয়, হবেই অবশ্য, আমি এর পরিচালনার নতুন ব্যবস্থা করবো। গরীব প্রজার দুর্গতি যাতে দূর হয়, তারা যাতে পেট ভরে খেতে পায়, পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করতে পায় সত্যিকার মানুষের মত, তা আমি করবো সেদিন।
–এবং তুমি নিজে উপবাস করবে–প্রজাদের ভরপেট খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে–এই তো?–বিদ্রূপ করে উঠলেন মার্কুইস।
উত্তেজিত হয়ে ডানে বললেন,”উপবাস? উপবাস কেন করবো? এখন কি আমি উপবাস করে আছি? যে খেটে খেতে পারে, তাকে কখনো উপবাস করতে হয় না। শুধু আমি কেন, বহু ফরাসী-ভদ্রলোকই এই অভিশপ্ত দেশ ত্যাগ করে ইংলন্ডে গিয়েছেন–নিজের চেষ্টায় নিজের জীবিকা অর্জন করবার জন্য।
আবার বিদ্রুপের হাসি ফুটে উঠলো মার্কুইসের মুখে। বহু ফরাসী-ভদ্রলোক? তার ভিতর বোভেয়াবাসী এক ডাক্তার আছেন বোধ হয়? চেনো সে ডাক্তারকে? ডাক্তার ম্যানেট?
মাকুইসের হাসির কারণ বুঝতে না পেরে বিস্মিত ডার্নে সংক্ষেপে বললেন– চিনি।