–ও লোকটা অমন জানোয়ারের মত চেঁচায় কেন? ওরই বাচ্চা বুঝি?
–তাই বটে হুজুর। ওরই ছেলে বটে!
লম্বা লোকটা হঠাৎ রক্তমাখা মাংসপিণ্ডের উপর থেকে লাফিয়ে উঠলো, ছুটে এলো গাড়ির দিকে। দুই হাত মাথার উপর তুলে চিৎকার করে বললো–মেরে ফেলেছে! মরে গেছে আমার ছেলেটা? সে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো মার্কুইসের দিকে চোখে তার যেন বিজলীর ঝলক!
বহু লোক গাড়ির চারিপাশে। সবাই তাকিয়ে মাকুইসের দিকে কী তিনি। বলেন–শুনবার জন্য কান খাড়া করে আছে তারা; কী তিনি করেন–দেখবার। জন্য চোখে তাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। কিন্তু সে দৃষ্টিতে ক্রোধ নেই, মুখেও তাদের ভাষা নেই। মহান্ মাকুইস একবার সবাইয়ের দিকে একনজর দেখে নিলেন, নিছক তাচ্ছিল্য তার সে নজরে। অপরিসীম তাচ্ছিল্য–যেন গর্ত থেকে একপাল ইঁদুর বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়ে আছে তার সমুখে! টাকার থলে বার করলেন মার্কুইস! তারপর তার মুখ থেকে ধীরে ধীরে বেরুলো :
–আমি দেখে অবাক হয়ে যাই যে, তোদের নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার, বা ছেলেগুলোকে সাবধানে রাখার পর্যন্ত ক্ষমতা নেই। একটা-না-একটা সর্বদাই এসে। পড়ছে গাড়ির সমুখে! কী জানি আমার ঘোড়ার পা খোঁড়া হয়ে গেল কি না! নে, এইটে দে ওকে!
একটা মোহর থলে থেকে নিয়ে তিনি ভিড়ের ভিতর ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। সমস্তগুলো ঘাড় সেইদিকে ফিরলো, সমস্তগুলো চোখ দেখতে লাগলো–মোহরটা কী-রকম ঘুরপাক খেয়ে উপরে উঠে আবার ঘুরপাক খেয়ে নিচে নামতে লাগলো। শুধু লম্বা লোকটা আবার দু’হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠলো–মেরে ফেলেছে! মরে গেছে। ছেলেটা!
অনেকবার সে এইভাবে চিৎকার করেছে, আরও কতবার যে এইভাবে চিৎকার করতো–কে জানে! কিন্তু এই সময়ে আর একটি লোক জোর-পায়ে এসে হাজির। হল সেখানে। তাকে দেখে অন্য সবাই পথ ছেড়ে সরে গেল। লম্বা লোকটা এই আগন্তুকের কাঁধের উপর মাথা রেখে হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করলো এইবার। একটা আঙুল তুলে কেবল সে ফোয়ারার দিকে দেখাতে লাগলো–যেখানে এক রক্তমাখা মাংসপিণ্ড ঘিরে পাড়ার মেয়েরা ঘুরছে আর ফিরছে–নীরবে, মাথা নিচু করে।
আগন্তুক বললো–সব শুনেছি, সব জানি ভাই গ্যাসপার্ড। ভালোই হলো, বাচ্চাটার পক্ষে এ ভালোই হলো। যে-ভাবে মানুষ বাঁচে এ-দেশে, সে-ভাবে বেঁচে থাকার চাইতে মরে যাওয়াই ভালো গ্যাসপার্ড! বুক বাঁধো ভাই! বুক বাঁধো!
মাকুইসের বাঁকা-অধরে খেলে গেল মৃদু হাসি। সে হাসি নিছক অবজ্ঞার। বাঃ! তুমি তো জ্ঞানী লোক দেখছি! নাম কি তোমার?
–ডিফার্জ।
–কী করো?
–মহান্ মার্কুইস! আমি মদের দোকানী।
–জ্ঞানী ও মদের দোকানী! এই তোমার বকশিশ!–বলে মার্কুইস আর-একটা মোহর ছুঁড়ে মারলেন ডিফার্জের দিকে। তারপর হুকুম দিলেন–চালাও গাড়ি!
জনতার দিকে আর দ্বিতীয়বার দৃষ্টি না দিয়ে মহান্ মাকুইস গদীতে ঠেসান দিয়ে বসলেন। চলতে চলতে পায়ের গুঁতোয় একখানা মেটে বাসন ভেঙে ফেলেছেন যেন! দাম চুকিয়ে দিয়েছেন–আবার কী?–চালাও!
গাড়ি সবে চলতে শুরু করেছে, এমন সময়ে ঠং করে তারই ছুঁড়ে দেওয়া মোহর উড়ে এসে পড়লো গাড়ির পাটাতনের উপরে। চমকে উঠলেন প্রভু।
–রোখো! রোখো!–কে ছুঁড়লো মোহর?
মার্কুইস তাকিয়ে দেখলেন। মদের দোকানী জ্ঞানী ডিফার্জ আর সেখানে নেই। আছে আর একটি কালো শক্ত নারী, দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে বুনে চলেছে ছবির পর ছবি, সাদা কাপড়ে।
গলার স্বর এক পর্দাও না চড়িয়ে মার্কুইস বললেন–কুত্তা সব। কে ঐ ঢিল ছুঁড়েছে গাড়ির ভিতর, জানতে যদি পারতাম! তাকে গাড়ির চাকার নিচে ফেলে গুঁড়ো করে ফেলতাম আমি!
গাড়ি গড়গড় করে চলে গেল, ফোয়ারার জল তরতর করে বয়ে চললো। থরথর করে কাঁপতে-কাঁপতে ইঁদুরের দল ঢুকলো-যে যার গর্তে। একটা ছেলে মরে গেছে, সেটা বড় কথা নয়; বড় কথা এই যে মার্কুইস রেগেছেন! কাজেই কাঁপছে ইঁদুরেরা।
সেই রাত্রে।
নিজের প্রাসাদে নৈশ-ভোজনে বসেছেন মহান্ মার্কুইস। টেবিলে দু’জনের খাবার! খাচ্ছেন কিন্তু মার্কুইস একাই। ইংলন্ড থেকে তার ভ্রাতুস্পুত্রের আজ আসবার কথা। এখনও পৌঁছোননি তিনি! একাই খেতে বসেছেন মার্কুইস! রাজভোেগ! পরম পরিতোষের সঙ্গে ভোজন চলেছে প্রভুর!
পথে একটা ব্যাপার ঘটেছে যা মার্কুইস ঠিক বুঝতে পারেননি! গাড়ির তলা: লোহার কাঠামো ধরে ঝুলতে ঝুলতে একটা লম্বা লোক না-কি এসেছিল বহুদূর! সইস-কোচোয়ানেরা দেখতে পায়নি তাকে, কিন্তু পথচরেরা দেখেছিল। তাদেরই কানাকানি থেকে কথাটা প্রচার হয়ে পড়ে। মাকুইসের কানে যখন এলো এ-খবর, তখন আর গাড়ির তলার লম্বা লোকটাকে কোথাও পাওয়া গেল না; সে কোন্ ফাঁকে পালিয়ে গেছে!
অবশ্য, কোন ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাবার পাত্র মার্কুইস নন–তা সে ব্যাপার যত দুর্বোধ্যই হোক না কেন! তবে হ্যাঁ, খেতে-খেতে দু’তিনবার তিনি ভৃত্যদের বললেন জানলা খুলে দেখতে–বাইরে কোন অচেনা লোককে দেখা যায় কি না। নাঃ, সন্দেহজনক কিছু কোথাও নেই।
গাড়ির শব্দ!–ঐ বোধ হয় এলো তার ভ্রাতুস্পুত্র! আসবামাত্রই ভৃত্যেরা তাকে। জানালো যে মাকুইসের ঘরে তার খাবার দেওয়া হয়েছে। তিনি এলেন। কে তিনি? তাকে আমরা দেখেছি লন্ডনে। ওল্ড বেইলীর বিচারকক্ষে। তার নাম ছিল তখন, চার্লস্ ডার্নে।
খুবই ভদ্রভাবে ভাইপোকে ডেকে পাশে বসালেন মার্কুইস। কিন্তু সভ্যসমাজের যা রীতি, আপনজনের সঙ্গে দেখা হলে করমর্দন করা, কিন্তু তার জন্য হাত বাড়ালেন না কেউ।