এই সরল বিষয়টি থেকে আমরা অসংখ্য কলাকৌশল দেখতে পারি, যেগুলি একই উদ্দেশ্যে এবং মূলতঃ একই পদ্ধতিতে কার্যকরী হয়, কিন্তু এটি অনিবার্যরূপে ফুলের প্রত্যেক অংশের পরিবর্তন ঘটায়। মধু বিভিন্ন আকারের পুষ্পধারে সঞ্চিত হতে পারে, সঙ্গে সঙ্গে পুংকেশর ও গর্ভকেশর বিভিন্নভাবে রূপান্তরিত হতে পারে, কোন কোন সময় ফাঁদের মতো কৌশল সৃষ্টি করতে পারে এবং কোন কোন সময় উত্তেজনা অথবা স্থিতিস্থাপকতার জন্য সুন্দরভাবে উপযোগী স্পন্দনে সমর্থ হতে পারে। এরূপ গঠনগুলি থেকে আমরা অগ্রসর হতে পারি, যতক্ষণ না আমরা অসাধারণ অভিযোজনের এমন ঘটনার সাক্ষাৎ পাই যা পরবর্তীকালে কোরিয়ানথেসদের ক্ষেত্রে ডঃ ক্রুগার বর্ণনা করেছেন। এই অর্কিডের ল্যাবেলাম বা অধরদল অথবা নিচের ওষ্ঠটির কিছু অংশ লম্বা গর্ত হয়ে একটি বিরাট পাত্রের মতো জিনিস সৃষ্টি করে; এর ওপরে অবস্থিত রস নিঃসরণকারী দুটি হর্ন থেকে এর মধ্যে অনবরত প্রায় বিশুদ্ধ জলের বিন্দু পড়তে থাকে, এবং পাত্রটি যখন অর্ধপূর্ণ হয়, তখন একদিকের ছিদ্র নল দ্বারা জল উপচিয়ে পড়ে। ল্যাবেলামের পাদদেশ পাত্রটির ওপরে অবস্থিত, এবং এটি নিজে গর্ত হয়ে দুটি পার্শ্ব প্রবেশদ্বার সমেত একটি প্রকোষ্ঠের মতো পাত্র তৈরি করে; এই প্রকোষ্ঠের মধ্যে রসালো খাঁজ থাকে। কী কী ঘটে তা লক্ষ্য না করে একজন দক্ষ বুদ্ধিমান মানুষ এইসব অংশগুলি কী কী উদ্দেশ্যসাধন করে তা কখনও কল্পনা করতে পারত না। কিন্তু মিঃ ক্রুগার লক্ষ্য করেছিলেন যে দলে দলে ভ্রমররা এই বিরাট অর্কিড ফুলে আসত, এরা আসত মধু সংগ্রহের জন্য নয়, বরং পাত্রের ওপরে প্রকোষ্ঠটির খাঁজগুলিকে অনবরত কামড়াতে; এটি করার সময় এরা বারবার পরস্পরকে পাত্রের মধ্যে ঠেলে ফেলে দিত এবং ডানাগুলি এভাবে সিক্ত হওয়ার ফলে এরা উড়ে যেতে পারত না, কিন্তু ছিদ্রনল অথবা উপছানোর দ্বারা সৃষ্ট প্রবেশদ্বারের মধ্য দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বের হতে বাধ্য হত। ডঃ ক্রুগার ভ্রমর-মৌমাছিদের অনবরত মিছিল দেখতেন যারা অনৈচ্ছিক স্নানের পর হামাগুড়ি দিয়ে বের হত। পথটি সঙ্কীর্ণ এবং তার ছাদ স্তম্ভ দ্বারা তৈরি, সুতরাং একটি মৌমাছি জোরে বের হওয়ার সময় আঠালো গর্ভমুণ্ডে তার পিছনটা ঘষে দেয় এবং তারপর পরাগপুঞ্জের আঠালো গ্রন্থিগুলিতেও পিছনের শরীর ঘষে দেয়। পরাগরেণুগুলি এবার মৌমাছির পিছনের আঠায় লেগে যায়। পরবর্তীকালে মৌমাছিরা সম্প্রসারিত একটি ফুলের পথটির মধ্য দিয়ে প্রথমে হামাগুড়ি দিয়ে বের হয় এবং এরূপে পরাগরেণুগুলি বাহিত হয়। ডঃ কুঁগার মদের স্ফিরিটে ডোবানো অবস্থায় একটি মৌমাছি সমেত একটি ফুল আমাকে পাঠিয়েছিলেন, হামাগুড়ি দিয়ে বের হবার পূর্বে মৌমাছিটিকে তিনি হত্যা করেছিলেন এবং তখনও মৌমাছিটির পিছনে পরাগরেণু লেগেছিল। এরূপ অবস্থায় যখন মৌমাছিটি অন্য ফুলে অথবা দ্বিতীয়বার একই ফুলে উড়ে যায় এবং সহযোদ্ধাদের ঠেলাঠেলির দ্বারা পাত্রটিতে পড়ে ও পথটির মধ্য দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বের হয়, তখন পরাগরেণুগুলি অবশ্যম্ভাবীরূপে আঠালো গর্ভমুণ্ডের সংস্পর্শে আসে ও তাতে লেগে যায়, এবং ফুলটি নিষিক্ত হয়। এখন অন্ততঃ আমরা ফুলটির প্রত্যেক অঙ্গের সম্পূর্ণ ব্যবহার দেখি, যথা জল নিঃসরণকারী শুঙ্গের, জল দ্বারা পরিপূর্ণ পাত্রটির, যারা মৌমাছিদের উড়ে পালাতে বাধা দেয়, এবং ছিদ্রনলের মধ্য দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে যেতে এবং সঠিকভাবে স্থাপিত আঠালো পরাগরেণুগুলি ও আঠালো গর্ভমুণ্ডটিকে শরীর দ্বারা ঘষতে বাধ্য করে।
আর একটি নিকট সম্বন্ধীয় অর্কিড অর্থাৎ ক্যাটাসেটাম-এর ফুলের গঠনকৌশল বহুলাংশে ভিন্ন, যদিও তা একই উদ্দেশ্য সাধন করে; এবং সমভাবে বিস্ময়কর। করিয়ানথেস-এর মতো এক্ষেত্রেও অধরদলটিকে কামড়িয়ে ক্ষয় করার জন্য মৌমাছিরা এইসব ফুলগুলিতে আসে, কাজটি সম্পাদন করতে এরা অনিবার্যরূপে একটি লম্বা, ক্রমশ সরু, অভিক্ষিপ্ত অঙ্গ স্পর্শ করে, যাকে আমি শুঙ্গ বা অ্যান্টেনা বলেছি। স্পর্শের পর এই শুঙ্গটি কোন একটি ঝিল্লিতে অনুভূতি বা সংবেদন অথবা স্পন্দন প্রেরণ করে, যার ফলে তৎক্ষণাৎ এটি বিদীর্ণ হয়; এটি একটি স্প্রিংকে মুক্ত করে, যার দ্বারা পরাগরেণু তীরের মতো সঠিক দিকে সবেগে নিক্ষিপ্ত হয় এবং পরাগপুঞ্জগুলি তাদের আঠালো প্রান্ত দ্বারা মৌমাছির পেছনে আটকিয়ে যায়। পুরুষ ফুলের পরাগরেণু (কারণ এই অর্কিড ফুলের লিঙ্গ আলাদা) এরূপে স্ত্রী-ফুলে ধাবিত হয়, তারপর এটি গর্ভমুণ্ডের সংস্পর্শে আসে, যা কোন স্থিতিস্থাপক নরম সূত্র ভাঙ্গতে ও পরাগরেণুকে ধরে রাখতে যথেষ্ট আঠালো এবং নিষেকক্রিয়া এভাবে কার্যকরী হয়।
পূর্ববর্তী এবং অন্য অসংখ্য উদাহরণে, একই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য জটিলতার ক্রমিক মাত্রা এবং অসংখ্য উপায় কেমন করে সৃষ্টি হল তা আমরা কীভাবে জানতে পারি–এ প্রশ্ন উঠতে পারে। উত্তর হচ্ছে, যেমন ইতিমধ্যে বলা হয়েছে, যে কোন অল্পমাত্রায় পরস্পরের থেকে ইতিমধ্যেই ভিন্ন দুটি আকার যখন পরিবর্তিত হয়, তখন। পরিবর্তনশীলতাটি ঠিক একই প্রকৃতির হবে না এবং ফলস্বরূপ একই সাধারণ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রাপ্ত ফলগুলিও এক হবে না। স্মরণ রাখা উচিত যে অতিশয় উন্নত প্রত্যেক জীব অনেক পরিবর্তন অতিক্রম করেছে; এবং প্রত্যেক রূপান্তরিত দেহগঠন বংশানুসৃতি অনুযায়ী প্রেরিত হতে চেষ্টা করে, যাতে কোরে প্রত্যেক রূপান্তর সহজেই সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হবে না, কিন্তু পুনঃ পুনঃ পরিবর্তিত হতে থাকবে। অতএব যে উদ্দেশ্যই সাধন করুক না কেন, প্রত্যেক প্রজাতির প্রত্যেক অঙ্গের গঠন হচ্ছে। বংশগতভারে প্রাপ্ত অনেক পরিবর্তনের যোগফল, যার মাধ্যমে প্রত্যেক প্রজাতি পর্যায়ক্রমিক অভিযোজনের সময় পরিবর্তিত স্বভাব ও জীবন-পরিবেশ অতিক্রম করেছে।