এখন মধুভক্ষণকারী পতঙ্গদের বিষয়ে আসা যাক। আমরা ধরে নিতে পারি উদ্ভিদটি একটি সাধারণ বা সুলভ উদ্ভিদ, অনবরত নির্বাচনের মাধ্যমে যার মধু আমরা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি করেছি এবং কোন কোন পতঙ্গ খাদ্যের জন্য এই মধুর ওপর নির্ভর করে। অসংখ্য উদাহরণ দিয়ে আমি দেখাতে পারতাম যে মৌমাছিরা সময় বাঁচাতে ব্যর্থ হয়: উদাহরণস্বরূপ, কোন ফুলের গোড়ায় গর্ত তৈরি ও মধুশোষণ করার স্বভাবের জন্য এরা মুখের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করতে পারে। এ সব ব্যাপার মনে রেখে বিশ্বাস করা যেতে পারে যে কোন কোন পরিস্থিতিতে শুড়ের দৈর্ঘ্য বা বক্রতা এবং অন্য অনেক ব্যাপারে ধর্তব্যের মধ্যে নয় এমন অতি অল্প এককীয় পার্থক্য মৌমাছি বা অন্য পতঙ্গদের উপকারে লাগতে পারে, যাতে করে অন্যদের তুলনায় কোন কোন একক তাড়াতাড়ি তাদের খাদ্য সংগ্রহ করতে সমর্থ হবে; এবং এভাবে এদের অন্তর্ভুক্ত সম্প্রদায়গুলি প্রবলভাবে বেড়ে উঠবে এবং ঝক সৃষ্টি করবে যারা একই বৈশিষ্ট্য বংশগতভাবে লাভ করবে। সাধারণ লাল ও ইনকারনোট ক্লোভার উদ্ভিদদের (ট্রাইফোলিয়াম প্যাটেন্স ও ট্রাইফোলিয়াম কানেক্টাম) ফুলের দলমণ্ডলের নলগুলিকে একনজরে দেখলেও দৈর্ঘ্যে ভিন্ন হয় বলে মনে হয় না; তথাপি মধু-মৌমাছি ইনকারনেট ক্লোভারের মধু সহজেই শুষে নিতে পারে, কিন্তু লাল ক্লোভার ফুলগুলির মধু শুষে নিতে পারে না, সেখানে কেবল ভ্রমর-মৌমাছিরা (হাম্বল-বি) আসে; অতএব লাল ক্লোভারের। সমগ্র খেত মধুমৌমাছিদের মূল্যবান মধুর প্রচুর যোগান দেওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে। এটা নিশ্চিত যে মধুমৌমাছিরা এই মধু খুবই পছন্দ করে; কারণ কেবল শরৎকালে আমি বারংবার দেখেছি যে নলের গোড়ায় ভ্রমর-মৌমাছিদের দ্বারা তৈরি গর্ত থেকে মধুমৌমাছিরা মধু শোষণ করছে। দু’ধরনের ক্লোভারের দলমণ্ডলের দৈর্ঘ্যের পার্থক্য অতিশয় তুচ্ছ হয়, যা আবার মধুমৌমাছির পরিদর্শন নির্ধারণ করে; কারণ আমাকে নিশ্চিতরূপে জানানো হয়েছে যে লাল ক্লোভারদের কেটে ফেলার পর দ্বিতীয়বারের ফুলগুলি কিছুটা ছোট হয় এবং তখন অনেক মধুমৌমাছি এদের পরিদর্শন করতে আসে। এই বক্তব্যটি সঠিক কিনা জানি না, অথবা অন্য একটি প্রকাশিত বক্তব্যে বিশ্বাস করা যেতে পারে কিনা তা-ও আমার জানা নেই। সেটি হচ্ছে–মধুমৌমাছির সাধারণভাবে বিবেচিত একটি ভ্যারাইটি এবং যার সঙ্গে অবাধে সঙ্করিত হয় এমন লিগুরিয়ান মৌমাছিরা লাল ক্লোভারে পৌঁছাতে ও মধু শোষণ করতে সমর্থ হয়। অতএব যে দেশে এই জাতীয় ক্লোভার প্রচুর জন্মায়, সেখানে অল্প দীর্ঘতর বা ভিন্নভাবে গঠিত একটি শুড় মধুমৌমাছির পক্ষে প্রভূত সুবিধাজনক হয়ে থাকবে। বিপরীতক্রমে, যেহেতু এই। ক্লোভারের উর্বরতা ফুলগুলিতে আসা মৌমাছিদের ওপর নির্ভর করে, সেহেতু কোন দেশে মধুমৌমাছিরা বিরল হলে একটি খবর ও গভীরভাবে বিভক্ত দলমণ্ডল থাকা উদ্ভিদটির পক্ষে বিরাট সুবিধা হয়ে থাকবে যাতে করে মধু মৌমাছিরা এর ফুলগুলিকে শোষণ করতে সমর্থ হবে। অতএব আমি বুঝতে পারি কেমন করে একটি ফুল ও একটি মৌমাছি পরস্পরের নিকট অনুকূল দেহকাঠামোর অল্প বিচ্যুতিগুলি সৃষ্টিকারী সমস্ত এককদের হয় যুগপৎ নয়তো একের পর এক ভাবে অনবরত সংরক্ষণের দ্বারা সবচেয়ে নিখুঁত উপায়ে পরস্পরের সঙ্গে ধীরে ধীরে রূপান্তরিত এবং অভিযোজিত হয়ে থাকবে।
আমি সম্পূর্ণভাবে অবগত যে ওপরের কল্পিত উদাহরণের দ্বারা ব্যাখ্যাত প্রাকৃতিক নির্বাচনের এই তত্ত্বটি যে ধরনের আপত্তির সম্মুখীন হয়, সেইরকম ভূবিদ্যা দ্বারা ব্যাখ্যামূলক পৃথিবীর আধুনিক পরিবর্তনগুলির ওপর স্যার চার্লস লিয়েলের মহৎ মতবাদের বিরুদ্ধেও প্রথমে আপত্তি তোলা হয়েছিল; কিন্তু আমরা এখন মাধ্যমগুলি সম্পর্কে কদাচিৎ শুনি, যেগুলি এখনও কাজ করে চলেছে এবং যাদের অতি তুচ্ছ বা অকিঞ্চিৎকর বলা হয়। গভীরতম উপত্যকাদের খননকার্য বা আন্তর্দেশীয় পাহাড়দের গঠন ব্যাখ্যা করতে এই মাধ্যমগুলি ব্যবহৃত হয়। প্রত্যেক সংরক্ষিত জীবের পক্ষে উপকারী ছোট ছোট আনুবংশিক রূপান্তরগুলির সংরক্ষণ ও সঞ্চয়নের দ্বারা কেবল প্রাকৃতিক নির্বাচন কার্যকরী হয়; এবং যেমন আধুনিক ভূবিদ্যা একমাত্র একটি প্লাবন তরঙ্গের মাধ্যমে একটি বিরাট উপত্যকা সৃষ্টির মতবাদকে প্রায় সম্পূর্ণরূপে নির্বাসিত করেছে, তেমনি প্রাকৃতিক নির্বাচন নূতন জীব ও এদের দেহকাঠামোর যে কোন বিরাট ও আকস্মিক রূপান্তরের অনবরত সৃষ্টির বিশ্বাসটিকে নির্বাসিত করবে।
এককদের আন্তঃসঙ্করণ
এখানে আমি একটি ছোট্ট অসাম্প্রদায়িক বিষয় উত্থাপন করব। ভিন্ন লিঙ্গসমূহ সম্বলিত প্রাণী ও উদ্ভিদদের ক্ষেত্রে এটি সুস্পষ্ট যে প্রত্যেক জন্মের জন্য দুটি একক নিশ্চয় সর্বদা মিলিত হবে (অপুংজনির অদ্ভুত ও অজানা বিষয়গুলি ছাড়া); কিন্তু উভলিঙ্গীদের ক্ষেত্রে এটি মোটেই স্পষ্ট নয়। তা সত্ত্বেও বিশ্বাস করার কারণ আছে যে সমস্ত উভলিঙ্গীদের ক্ষেত্রে দুটি একক হয় আকস্মিকভাবে নয়তো স্বভাবগতভাবে নিজেদের মত সন্তান উৎপাদনের জন্য মিলিত হয়। অনেক আগে এই মতবাদের পক্ষে প্রেনজেল, নাইট ও কোয়েলরয়টার সন্দেহজনকভাবে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। বর্তমানে এটির প্রয়োজনীয়তা আমরা দেখব। কিন্তু বিষয়টি অতিসংক্ষেপে আমি নিশ্চিয় আলোচনা করব, যদিও বিস্তৃত আলোচনার জন্য আমার কাছে যথেষ্ট উপাদান রয়েছে। সমস্ত মেরুদণ্ডী প্রাণীরা, সকল পতঙ্গরা এবং অন্য সব বড় গোষ্ঠীর প্রাণীরা প্রত্যেকে সন্তান উৎপাদনের জন্য মিলিত হয়। আধুনিক গবেষণা কল্পিত উভলিঙ্গীদের সংখ্যা ও প্রকৃত উভলিঙ্গীদের বিরাট সংখ্যক জোড়ার বিরাটভাবে হ্রাস করেছে; অর্থাৎ দুটি একক সন্তান উৎপাদনের জন্য নিয়মিত মিলিত হয়, এগুলি আমাদের দুশ্চিন্তায় ফেলে। কিন্তু এখনও অনেক উভলিঙ্গী প্রাণী আছে যারা নিশ্চয়ই স্বাভাবিকভাবে মিলিত হয় না এবং বিরাট সংখ্যক উদ্ভিদরা উভলিঙ্গী। প্রশ্ন উঠতে পারে, এইসব ক্ষেত্রে মনে করার কি যুক্তি রয়েছে যে দুটি একক সন্তান উৎপাদনের জন্য কখনও মিলিত হয়? বিস্তৃত ব্যাখ্যায় যাওয়া অসম্ভব বলে আমি কেবল কয়েকটি সাধারণ বিবেচনার ওপরেই আস্থা রাখব।