পাখিদের মধ্যে লড়াই প্রায়শই আরও শান্তিপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের হয়। এ বিষয়ে যাঁরা মনোনিবেশ করেছেন তাঁরা সকলেই বিশ্বাস করেন যে সঙ্গীতের দ্বারা স্ত্রীদের আকর্ষণ করার জন্য অনেক প্রজাতির পুরুষদের মধ্যে ভয়ানক প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। গিয়ানার পাহাড়ি গ্রাস, স্বর্গ উদ্যানের পাখিরা এবং অন্যরা একত্রে জড়ো হয় এবং অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে ও সবচেয়ে ভালভাবে পর্যায়ক্রমে পুরুষরা তাদের চমৎকার পালকসমূহ প্রদর্শন করে; এভাবে তারা দর্শক হিসাবে উপস্থিত স্ত্রীদের সম্মুখে বিচিত্র সঙের অভিনয় প্রদর্শন করে এবং অবশেষে সবচেয়ে আকর্ষণীয় সঙ্গিনীকে পছন্দ করে। আটক অবস্থায় পাখিদের যাঁরা পুত্থানুপুঙ্খভাবে লক্ষ্য করেছেন তারা জানেন যে এদেরও নিজস্ব পছন্দ ও অপছন্দ থাকে। কেমন করে একটি চিত্রবিচিত্র ময়ূর তার সকল ময়ূরীদের নিকট আকর্ষণীয় হয়েছিল স্যার আর. হিরণ তার একটি বর্ণনা দিয়েছেন। আমি এখানে বিশদ বিবরণ দিতে পারছি না, কিন্তু তার নিজস্ব সৌন্দর্য্যের মান অনুযায়ী মানুষ যদি তার গৃহপালিত। লড়িয়ে মোরগদের স্বল্প সময়ে সৌন্দর্য্য ও সুন্দরভাবে দাঁড়ানোর ভঙ্গি প্রদান করতে পারে, তাহলে আমি সন্দেহ করার উপযুক্ত যুক্তি খুঁজে পাই না যে স্ত্রী পাখিরা তাদের সৌন্দর্য্যের মান অনুযায়ী কয়েক সহস্র বংশ ধরে সবচেয়ে সুরেলা কণ্ঠস্বরবিশিষ্ট ও সুন্দর পুরুষদের নির্বাচন করে উল্লেখযোগ্য ফল উৎপাদন করে থাকবে। তরুণদের পালকদের তুলনায় পুরুষ ও স্ত্রী পাখিদের পালকের বিষয়ে সুপরিচিত কয়েকটি নিয়মকে বিভিন্ন বয়সে সংঘটিত পরিবৃত্তির ওপর যৌন নির্বাচনের কর্মশীলতার মাধ্যমে অংশত ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, এবং ঐ পরিবৃত্তিগুলি কেবল পুরুষদের অথবা উভয় লিঙ্গের সমরূপ বয়সে বংশগতভাবে প্রেরিত হয়; কিন্তু স্থানাভাবে এখানে আমি এ বিষয়ে বিস্তৃত ব্যাখ্যায় যাব না।
আমি বিশ্বাস করি বিষয়টি এমন হয় যে যখন কোন প্রাণীর পুরুষ ও স্ত্রীদের জীবনের সাধারণ স্বভাবসমূহ একই থাকে, কিন্তু দেহকাঠামো, রঙ ও অলংকরণ ভিন্ন হয়, তখন এ সব পার্থক্য প্রধানতঃ যৌন নির্বাচন দ্বারাই সংঘটিত হয়েছে। অর্থাৎ কোন পুরুষ বংশধরে বংশগতভাবে প্রেরিত এদের হাতিয়ারে, আত্মরক্ষায় উপায়ে বা আকর্ষণ করার ক্ষমতায় একক পুরুষদের পর্যায়ক্রমিক বংশে অন্য পুরুষদের ওপর অল্প সুবিধাজনক অবস্থানে থাকার দরুণ এটি ঘটে। তথাপি সকল যৌন পার্থক্যই যে এর মাধ্যমে ঘটে, তা আমি বলতে চাই না, কারণ আমাদের গৃহপালিত প্রাণীদের লক্ষ্য করলে আমরা দেখি যে বৈশিষ্ট্যগুলি পুরুষ লিঙ্গে উদ্ধৃত হয় ও সংশ্লিষ্ট হয়, যা আবার আপাততঃ মানুষের নির্বাচনের মাধ্যমে বৃদ্ধি পায় না। বন্য টার্কি মোরগের স্তনের লোমগুচ্ছ কোন কাজে লাগে না এবং এটি সন্দেহজনক যে স্ত্রী পাখির চোখে সৌন্দৰ্য্যবর্ধনের জন্য এটি সৃষ্টি হয়েছে কিনা। বাস্তবিকপক্ষে এই লোমগুচ্ছ গৃহপালনাধীন অবস্থায় আবির্ভূত হলে একে অঙ্গবিকৃতি বলা যেতে পারত।
প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়া বা যোগ্যতমের উদ্বর্তনের উদাহরণসহ ব্যাখ্যা
আমার বিশ্বাস মত কেমন করে প্রাকৃতিক নির্বাচন কার্যকরী হয়, তা পরিষ্কার করে বলার জন্য একটি বা দুটি কল্পনামূলক উদাহরণ দেওয়ার অনুমতি চেয়ে নিচ্ছি আমি। নেকড়ে বাঘের কথাই ধরুন। এরা বিভিন্ন প্রাণীদের শিকার করে-কেউ চাতুর্যের দ্বারা, কেউ ক্ষমতা বা শক্তির দ্বারা, কেউ দ্রুতগামীতার দ্বারা; এবং ধরুন আমরা মনে করি যে দেশটির কোন পরিবর্তনের ফলেই দ্রুতগামী শিকার, উদাহরণস্বরূপ, হরিণের সংখ্যা দ্রুতহারে বৃদ্ধি পেয়েছিল বা অন্য শিকারের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছিল। বছরটি ঐ ঋতুতে নেকড়েদের খাদ্যের যখন ভয়ানক প্রয়োজন, সেরূপ অবস্থায় সবচেয়ে দ্রুতগামী ও কৃশকায় নেকড়েরা বেঁচে থাকার ভাল সুযোগ পাবে এবং এইরূপে সংরক্ষিত বা নির্বাচিত হয়ে থাকবে–সর্বদা যদি বছরের একই সময়ে বা অন্য কোন সময়ে এরা শিকার করার শক্তি বজায় রাখত তাহলে এরা অন্য প্রাণীদের শিকার করতে বাধ্য হত। যত্ন সহকারে ও নিয়মানুগ নির্বাচনের দ্বারা অথবা জাতটির রূপান্তরের কোন চিন্তা ছাড়াই প্রত্যেক মানুষের সেরা কুকুর রাখার চেষ্টাপ্রসূত ঐ ধরনের অচেতন নির্বাচন দ্বারা মানুষ তার গ্রে হাউন্ড কুকুরের দ্রুতগামীতার উন্নতিসাধন করায়, তখন আমি সন্দেহ করার আর কোন যুক্তি দেখি না যে এটিই হবে তার ফল। আমি যোগ করতে পারি যে ইউনাইটেড স্টেটস-এর ক্যাটস্কিল পর্বতমালায় দুই ধরনের নেকড়ে বসবাস করে, একটির ধরন হচ্ছে গ্রে হাউন্ডের মত যারা শিকারের জন্য হরিণকে অনুসরণ করে এবং অন্যটি হচ্ছে আরও স্থূলকায়, যারা প্রায়শই মেষপালকের মেষের পালকে আক্রমণ করে।
লক্ষ্য করা উচিত এই উদাহরণে আমি সবচেয়ে কৃশকায় নেকড়ের কথা বলেছি, সংরক্ষিত হয়েছে এমন কোন স্পষ্টচিহ্নিত পরিবৃত্তির কথা বলিনি। এই বইটির পূর্বতন সংস্কারগুলিতে কোন কোন সময় আমি বলেছিলাম যে পরের বিকল্পটি বারংবার সংঘটিত হয়েছিল। এককীয় পার্থক্যদের বিরাট গুরুত্বের বিষয়টি আমি লক্ষ্য করেছিলাম। মানুষের দ্বারা অচেতন নির্বাচনের ফলাফলের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে এটি আমাকে প্ররোচিত করেছে, অচেতন নির্বাচন কমবেশি সব মূল্যবান এককদের সংরক্ষণের ও নিকৃষ্টদের ধ্বংসের ওপর নির্ভর করে। আমি এ-ও লক্ষ্য করেছিলাম যে প্রাকৃতিক অবস্থায় দেহকাঠামোর কোন আকস্মিক বিচ্যুতি, যথা একটি অঙ্গবিকৃতি, বিরল ঘটনা হবে; আরও লক্ষ্য করেছিলাম যে প্রথমেই যদি এটি সংরক্ষিত হয়, তাহলে সাধারণ এককদের সঙ্গে পরবর্তী আন্তঃসঙ্করণের মাধ্যমে এটি হারিয়ে যাবে। তা সত্ত্বেও নর্থ ব্রিটিশ রিভিউ’ পত্রিকায় (১৮৬৭) একটি মূল্যবান প্রবন্ধ না পড়া পর্যন্ত আমি উপলব্ধি করিনি যে যতই অল্প ও স্পষ্টচিহ্নিত হোক না কেন, কেমন করে একটিমাত্র পরিবৃত্তি ক্কচিৎ চিরস্থায়ী হয়ে থাকতে পারত। উক্ত লেখক এক জোড়া প্রাণীর বিষয় নিয়েছেন। এরা এদের সমগ্র জীবৎকালে দুই শত বংশধর উৎপাদন করেছে, যার মধ্যে, বিভিন্ন কারণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার পর, গড়ে কেবলমাত্র দুটি নিজের মত সন্তান উৎপাদনের জন্য বেঁচে থাকে। বরং উচ্চতর প্রাণীদের অধিকাংশের ক্ষেত্রে এটি একটি চূড়ান্ত হিসেব, কিন্তু নিম্নতর জীবদের অধিকাংশের ক্ষেত্রে এটি কোন মতেই প্রযোজ্য নয়। এর পর তিনি দেখিয়েছেন যে যদি কেবলমাত্র একটি এককের জন্ম হত, যা কোনভাবে পরিবর্তিত হত, অন্য এককদের তুলনায় যদি এর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা দুগুণ হত, তথাপি বেঁচে থাকার বিরুদ্ধ-সম্ভাবনাগুলি প্রবল হবে। মনে করা যাক যে এরা বেঁচে থাকে ও সন্তান উৎপাদন করে এবং এর অর্ধসংখ্যক তরুণরা অনুকূল পরিবৃত্তি। বংশগতভাবে প্রাপ্ত হয়েছে, তবুও পূর্বের আলোচনাকারী দেখিয়েছেন যে তরুণের বেঁচে থাকার ও সন্তান উৎপাদন করার কেবল অল্প সম্ভাবনা থাকবে এবং এই সম্ভাবনা পরবর্তী বংশপরম্পরায় ক্রমশঃ হ্রাস পেতে থাকবে। আমি মনে করি এইসব মন্তব্যের নায্যতা খণ্ডন করা যেতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ, কোন এক ধরনের একটি পাখি যদি ঠোঁট বাঁকিয়ে সহজভাবে খাদ্য সংগ্রহ করতে পারত এবং ভয়ানকভাবে বাঁকা ঠোঁট নিয়ে যদি কেউ জন্মাত এবং ফলস্বরূপ সতেজে বেড়ে উঠত, তা সত্ত্বেও সাধারণ আকারকে বর্জন করে এই একটি এককের নিজের রূপ চিরস্থায়ী করার সম্ভাবনা খুব অল্প হবে; গৃহপালন অবস্থায় যা ঘটে তা দেখে এটির বিচার-বিশ্লেষণ করে কিন্তু কোন সন্দেহ থাকতে পারে না যে খুব শক্ত ঠোঁটওয়ালা বিরাট সংখ্যক এককদের বহু বংশ ধরে সংরক্ষণ ও আরও বিরাট সংখ্যক সোজা ঠোঁটওয়ালাদের ধ্বংসসাধন থেকে এই ফলাফল ঘটবে।