রূপক হিসেবে বলা যেতে পারে যে প্রাকৃতিক নির্বাচন সমগ্র পৃথিবীব্যাপী অল্পতম পরিবৃত্তিগুলিকে প্রতিদিন ও প্রতিঘণ্টায় খুঁটিয়ে বা সযত্নে পরীক্ষা করছে, খারাপগুলিকে বাতিল করছে, ভালগুলিকে সংরক্ষণ ও বৃদ্ধি করছে; এর জৈবিক ও অজৈবিক জীবনাবস্থাদের সম্পর্কে প্রত্যেক জীবের উন্নতিসাধনে যখন ও যেখানেই সুযোগ উপস্থিত হয়, নীরবে ও অচেতনভাবে কাজ করছে সে। দীর্ঘসময় অতিবাহিত না-হওয়া পর্যন্ত অগ্রগমনের এইসব মন্থর পরিবর্তন আমরা দেখতে পাই না, এবং তারপর দীর্ঘসময় পূর্বে অতিবাহিত ভূতাত্ত্বিক যুগগুলি সম্বন্ধে আমাদের পর্যবেক্ষণ এত ত্রুটিপূর্ণ যে পূর্বের অবস্থার তুলনায় জীবনাকারগুলি এখন অনেক ভিন্ন, এটিই আমরা দেখি।
একটি প্রজাতির যে কোন বিরাট পরিমাণ রূপান্তর হতে গেলে, একসময়ে সৃষ্ট একটি ভ্যারাইটি দীর্ঘসময় ব্যবধানে পুনরায় নিশ্চয় পরিবর্তিত হবে বা পূর্বের মত অনুকূল প্রকৃতির এককীয় পার্থক্যগুলো উপস্থিত করবে; এবং এগুলি নিশ্চয় পুনরায় সংরক্ষিত হবে এবং ধাপে ধাপে অগ্রসর হবে। একই প্রকার এককীয় পার্থক্য পুনঃ পুনঃ ঘটতে দেখে একটি অনধিকার ধৃষ্টতা হিসেবে এটিকে কদাচিৎ বিবেচনা করা যেতে পারে। কিন্তু এটি সত্য কিনা, প্রকল্পটি কতখানি প্রকৃতির সাধারণ ঘটনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং কেমন ব্যাখ্যা উপস্থিত করে, তা দেখেই আমরা বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারি। বিপরীতক্রমে, সাধারণ বিশ্বাস হচ্ছে যে সম্ভবপর পরিবৃত্তির পরিমাণ কঠোরভাবে সীমায়িত। এটিও একটি সরল ধারণা।
প্রাকৃতিক নির্বাচন যদিও প্রত্যেক জীবের ভিতর দিয়ে ও মঙ্গলের জন্যই কেবল কাজ করতে পারে, তথাপি আমাদের বিবেচনায় অতি তুচ্ছ গুরুত্বের বৈশিষ্ট্য ও দেহগঠনের ওপরও ক্রিয়াশীল হতে পারে। আমরা যখন লক্ষ্য করি পাতা-ভক্ষণকারী পতঙ্গরা সবুজ, গাছের ছাল-ভক্ষণকারীরা বহুবর্ণে চিহ্নিত ধূসর, শীতে উচ্চ গিরিশৃঙ্গের টারমাইগানরা সাদা, লাল-গ্রাউসের রং হেদার গুল্মের মতো, তখন আমাদের নিশ্চয় বিশ্বাস করা উচিত যে এইসব রং ঐ সব পাখিদের ও পতঙ্গদের বিপদ থেকে আত্মরক্ষা করতে সাহায্য করে। জীবনের কোন পর্যায়ে এদের যদি ধ্বংস করা না হয়, তাহলে গ্রাউসরা (এক ধরনের বুনো হাঁস) সীমাহীনভাবে বৃদ্ধি পাবে। এরা সাধারণত শিকারি পাখি দ্বারা বহুলাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এটা জানা গেছে; বাজপাখিরা দৃষ্টিশক্তির কারণে শিকারের সন্ধান পায়-মহাদেশের মানুষদের সাদা পায়রা না পোষার জন্য সতর্ক করে দেওয়া হয়, কারণ এরা সবচেয়ে বেশি ধ্বংসযোগ্য। অতএব প্রত্যেক প্রকার/ধরনের গ্রাউসকে সঠিক রং প্রদানের জন্য প্রাকৃতিক নির্বাচন কার্যকরী হবে এবং একবার অর্জন করার পর রংটিকে সঠিক ও স্থায়ী রাখতেও প্রাকৃতিক নির্বাচন কার্যকরী হবে। অথবা আমাদের এমন চিন্তা করা উচিত হবে না যে কোন বিশেষ রঙের একটি প্রাণীর আকস্মিক ধ্বংসসাধন অল্প ফল উৎপাদন করবে: আমাদের স্মরণে রাখা উচিত যে এক পাল ভেড়ার মধ্যে যদি একটি শিশু ভেড়ার রং কালো হয় তাহলে তাকে নষ্ট করা কত প্রয়োজনীয়। আমরা দেখেছি ভার্জিনিয়াতে ‘রং-করা শিকড় খাওয়ানো হয় এমন শূকরদের শরীরের রং তাদের বাঁচা-মরা নির্ধারণ করে। উদ্ভিদদের ক্ষেত্রে, ফলের নরম রোম ও শাঁসের রংকে উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা অতি তুচ্ছ গুরুত্বের বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচনা করেন: তথাপি বিখ্যাত উদ্যানবিদ্ ডাউনিং-এর কাছ থেকে আমরা শুনি যে ইউনাইটেড স্টেট-এ নরম রোমযুক্ত ফলগুলির তুলনায় মসৃণ চামড়াযুক্ত ফলগুলি কারকিউলিও নামে গুবরে পোকার দ্বারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়; আরও শুনি যে হলদে প্লামের তুলনায় বেগুনি প্লামগুলি কোন বিশেষ রোগের দ্বারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়; কিন্তু পক্ষান্তরে, অন্য রঙের শাঁসসমেত পিচফলগুলির তুলনায় হলদে শাঁসের পিচফলগুলিকে অন্য ধরনের রোগ আক্রমণ করে। যাবতীয় দক্ষতার সঙ্গে কতিপয় ভ্যারাইটিকে চাষ করতে গিয়ে যদি এইসব অল্প পার্থক্য একটি বিরাট পার্থক্যে পরিণত হয়, তবে সেখানে বৃক্ষের ও অন্য অনেক শত্রুর সঙ্গে সংগ্রাম করতে হয়, প্রাকৃতিক অবস্থায় মসৃণ বা সূক্ষ্ম রোমযুক্ত, হলদে বা বেগুনি শাঁসযুক্ত ফলের যে কোন ভ্যারাইটি কৃতকার্য হবে কিনা তার ওপর এইরূপ পার্থক্যের ব্যাপারটির সফল সমাধান হবে।
প্রজাতিদের মধ্যে আপাতভাবে সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় অনেক ছোট ছোট পার্থক্যের বিষয় লক্ষ্য করে আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে জলবায়ু, খাদ্য ইত্যাদি নিঃসন্দেহেই কিছু প্রত্যক্ষ ফল উৎপাদন করেছে। এটিও স্মরণে রাখা উচিত যে যখন একটি অঙ্গ পরিবর্তিত হয় এবং পরিবর্তনগুলি যখন প্রাকৃতিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সঞ্চিত হয়, তখন পারস্পরিক সম্পর্কের নিয়মানুযায়ী অন্য রূপান্তরসমূহ প্রায় অপ্রত্যাশিতভাবেই আবির্ভূত হবে।
আমরা লক্ষ্য করি যে পরিবৃত্তগুলি গৃহপালিত অবস্থায় জীবনের কোন বিশেষ বয়সে আবির্ভূত হয়। বংশধরের একই বয়সে ঐগুলির পুনরাবির্ভাবের সম্ভাবনা থাকে। যেমন, আমাদের রন্ধন ও চাষযোগ্য উদ্ভিদের অসংখ্য ভ্যারাইটিদের বীজগুলির আকার, আয়তন ও স্বাদগন্ধে; রেশম কীটের ভ্যারাইটিদের গুটি ও শুয়োপোকার বিভিন্ন ধাপে বা স্তরে; পক্ষিশালার ডিমগুলিতে ও তাদের ছানার পালকের রঙে; আমাদের প্রায় পূর্ণবয়স্ক ঘোড়া ও গোমহিষাদির শিঙে। অতএব প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রাকৃতিক নির্বাচন ঐ একই বয়সে ফলদায়ক পরিবৃত্তিগুলিকে সঞ্চয়ের মাধ্যমে এবং সমরূপ বয়সে এদের বংশধরে প্রেরণের মাধ্যমে যে কোন বয়সে জীবকে পরিবর্তিত ও জীবের ওপর ক্রিয়া করতে সমর্থ হবে। যদি কোন গাছের বীজগুলি বায়ুর দ্বারা ব্যাপকভাবে বিস্তারে লাভবান হয়, তাহলে নির্বাচনের মাধ্যমে তার তুলগাছের গুঁটির রোমগুলির উন্নতি ও বৃদ্ধি করতে তুলাচাষীর অবদানের তুলনায় প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে এটি সম্পাদন করায় আমি কোন অসুবিধা দেখি না। একটি পতঙ্গের লার্ভাকে রূপান্তরিত ও অভিযোজিত করতে প্রাকৃতিক নির্বাচনের বহু সম্ভাবনা থাকতে পারে, যা আবার পূর্ণবয়স্ক পতঙ্গের তুলনায় সামগ্রিকভাবে ভিন্ন এবং পারস্পরিক সম্পর্কের নিয়মের মাধ্যমে রূপান্তরগুলি লার্ভার গঠনকে প্রভাবিত করতে পারে। বিপরীতক্রমে এভাবে বয়স্কদের রূপান্তরগুলি লার্ভার গঠনকে প্রভাবিত করতে পারে। কিন্তু সব ক্ষেত্রে যে এরা ক্ষতিকর হবে না তা প্রাকৃতিক নির্বাচনই নিশ্চিত করবে, কারণ তা না হলে প্রজাতিটি বিলুপ্ত হবে।