ফরাসি বিপ্লবের বিরুদ্ধে তীব্র ধর্মীয় প্রতিক্রিয়া যদি মাথাচাড়া না দিত, তাহলে এমন কি ডারউইন-তত্ত্বের প্রকাশের পূর্বে উনিশ শতকের গোড়াতেই সকল প্রজাতির উদ্ভব যে এক সাধারণ উৎস থেকে, এই ধারণাটা সহজেই স্বীকৃত হয়ে যেত। কিন্তু তা হয়নি। বরং সতেরো শতকের Counter-Reformation-এর দিনগুলির চেয়েও প্রবল উৎসাহে বাইবেল-বর্ণিত নির্দিষ্ট দিনে প্রজাতি, প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্মকাহিনীকে আক্ষরিক সত্য বলে প্রচার করাটা উনিশ শতকের গোড়ায় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির কাছে অনেক বেশি জরুরী হয়ে পড়েছিল। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এই রহস্যবাদী ধারা উনিশ শতকের গোড়ায় গুরুতরভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। উনিশ শতকের গোড়ায় জার্মানির নাটুরফিলসফি (Naturphilosophie) ধারণা ছিল এর প্রতিভূ। হের্ডর ও শেলিং-এর মতো দার্শনিক, গয়টের মতো কবির প্রেরণায় এঁরা মগ্ন ছিলেন ঐশ্বরিক পরিকল্পনার মাঝে প্রকৃতির পরম ভাবের সন্ধানে। এই সন্ধানের সঙ্গে অচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত ছিল জার্মান জাতির পুনর্জাগরণ ও ‘ঘৃণিত’ ফরাসী গাণিতিক জড়বাদকে নির্মূল করার প্রয়াস। কাজেই পঞ্চাশ বছর ধরে অধিকাংশ প্রকৃতিবিদ অণুবীক্ষণে যে-চোখ লাগালেন, কার্যত তা ছিল অন্ধ। তারা প্রকৃতির অৎপর্য নিয়ে ভাবতে রাজী ছিলেন না।
এইখানেই ডারউইন-তত্ত্বের ঐতিহাসিক ও অপরিসীম গুরুত্ব। ১৮৫৯ সালে ‘অরিজিন। অফ স্পিসিস’ প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই পুস্তক গভীরভাবে অধ্যয়ন করলেন। ফ্রিডরিশ এঙ্গেলস। পরের বছর কার্ল মার্কস এই বইটি অধ্যয়ন করে ১৮৬০ সালের ১৯ ডিসেম্বর এঙ্গেলসকে লিখলেন, “আমাদের ধারণার প্রাকৃতিক ঐতিহাসিক বনিয়াদ সৃষ্টি করে দিয়েছে এই বইটি। ডারউইনের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ঋণ স্বীকারের উদ্দেশ্যে ‘ক্যাপিটাল’ গ্রন্থটি ডারউইনের নামেই উৎসর্গ করেছিলেন মার্কস। এঙ্গেলস তাঁর ডায়লেকটিস্ অফ নেচার’ পুস্তকে প্রকৃতিবিজ্ঞানের জগতে তিনটি ঘটনাকে চূড়ান্ত গুরুত্ব দিয়েছেন-জীবকোষের আবিষ্কার, শক্তির সংরক্ষণ ও তার রূপান্তরের নিয়ম আবিষ্কার আর ডারউইনের আবিষ্কার। মার্কস-এঙ্গেলসের চোখে চার্লস ডারউইনের আবিষ্কার ছিল এক প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এর পাশাপাশি এঙ্গেলস তার ‘ডায়লেকটিস্ অফ নেচার’-এ ডারউইন-তত্ত্বের কিছু সমালোচনাও করেছেন। অবশ্য অরিজিন অফ স্পিসিস-এর সঙ্গে ‘ডিসেন্ট অফ ম্যান’ গ্রন্থেরও সাহায্য নিয়েছেন তিনি। যে সমস্ত প্রশ্নগুলি এঙ্গেলস তুলেছে, সংক্ষেপে তা উল্লেখ করছি। অস্তিত্বরক্ষার জন্য সংগ্রামের ওপর একপেশেভাবে অতিরিক্ত জোর দিয়েছেন ডারউইন, যা এঙ্গেলসের দৃষ্টিভঙ্গিতে সঠিক বলে মনে হয়নি। প্রাকৃতিক নির্বাচন সম্বন্ধেও এঙ্গেলসের মতামত কিছুটা ভিন্ন, যথা একই প্রাণীগোষ্ঠীতে সদস্যসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে যে প্রতিযোগিতা দেখা দেয়, তাতে সব থেকে শক্তিশালীরাই প্রধানত টিকে থাকলেও অন্য অনেক দিকের বিচারে দুর্বলতমরাও টিকে থাকতে পারে। তিনি আরও বলেছেন যে অজৈব প্রকৃতির বিভিন্ন বস্তুগুলির মধ্যে শুধুমাত্র সংঘাতই থাকে না, সামঞ্জস্যও থাকে; জৈব প্রকৃতির বস্তুগুলির মধ্যে সচেতন ও অসচেতন সংগ্রামের পাশাপাশি সচেতন ও অসচেতন সহযোগিতাও অবস্থান করে। আর তাই এমন কি প্রকৃতির ক্ষেত্রেও শুধুমাত্র সংগ্রাম’ লিখে রাখাটা তার মতে নেহাতই একপেশে ধারণা। বিভিন্ন প্রজাতির পরিবর্তনশীলতার কারণ, পরিবেশের ভূমিকা, বিপাক ক্রিয়ার ভূমিকা–এ সব বিষয়েও কিছু প্রশ্ন তুলেছেন এঙ্গে লস। প্রশ্ন তুলেছেন ম্যালথাসের তত্ত্বের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কেও। এই সব সমালোচনার পাশাপাশি মানবদেহের শারীরস্থানবিদ্যা, তুলনামূলক শারীরস্থানবিদ্যা, ভূতত্ত্ব, প্রাণীবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা–সবকিছুর ভিত্তি হিসাবে এঙ্গেলস প্রজাতি তত্ত্বকেই চিহ্নিত করেছেন, অকৃত্রিম স্বাগত জানিয়েছেন ডারউইনের আবিষ্কারকে।
ডারউইন-তত্ত্বের অনেককিছুই আজ আধুনিক বিজ্ঞানের চর্চায় পরিত্যক্ত, সংশোধিত হচ্ছে। কিছু কিছু প্রশ্ন নিয়ে চলেছে গবেষণা, বিতর্ক। এটাই স্বাভাবিক, কারণ বিজ্ঞান এগিয়ে চলে নানা জনের নানা প্রয়াসের সমষ্ঠির রূপ নিয়ে, যদিও ডারউইনের মতো দিকপালদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। পৃথিবীর ইতিহাসে ডারউইন ও তাঁর বিবর্তন তত্ত্বের মৃত্যু নেই।
পরিশেষে উল্লেখ করতে চাই, “সংস্কৃতির কোন ক্ষেত্রেই দিকপাল মানুষরা স্বয়ম্ভর নন, বিজ্ঞানে তো ননই। কেননা বিজ্ঞানের যে কোন আবিষ্কারের পশ্চাতে থাকে গৌণ ও কল্পনা-দীন শতশত বিজ্ঞানীর প্রস্তুতিমূলক কাজ। এই সব বিজ্ঞানীরা প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত সঞ্চয় করে চলেন। বেশিরভাগ সময়েই না বুঝে সঞ্চিত সেই তথ্য-ভাণ্ডার নিয়েই দিকপাল বিজ্ঞানী তার কর্ম সমাধা করেন।”
“মানুষের মনের গঠন যে কত রকমের হয় তার ইয়ত্তা নেই। বিজ্ঞানে মৌলিক অবদান রাখার সম্ভাবনা অল্প কয়েকজনের মধ্যেই থাকে যদিও অতীতের তুলনায় আজ অনেক বেশি মানুষ সে সুযোগ পাচ্ছেন এবং ভবিষ্যতে আরো বেশি লোক তা পাবেন। যাঁরা বিজ্ঞানের কাজ করার জন্য নির্বাচিত হন বা নিজেদের নির্বাচিত করেন, তাঁদের মধ্যেও বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ ছাড়া আর সব ব্যাপারে পার্থক্য থাকাটাই স্বাভাবিক। এর ফলে বিজ্ঞানে যেমন বিপুল বৈচিত্র্যের সঞ্চার ঘটে, তেমনি সমাজ আরোপিত নিয়ন্ত্রণের মারফৎ প্রয়োজনীয় একটি ঐক্যও সাধিত হয়। সে নিয়ন্ত্রণ সচেতনভাবে অথবা অচেতনভাবে আরোপিত হতে পারে। সমাজ-আরোপিত এই ঐক্যের সুবাদেই বিজ্ঞান মানুষের পরিবেশকে অনুধাবন করে তাকে বদলানোর এক সমবায়িকা যৌথ প্রয়াসকে উপলব্ধি করে যে সব দিকপাল বিজ্ঞানী বিজ্ঞানের নিত্যনতুন আলোকে সমাজের অগ্রগমনের পথকে আলোকিত করছেন, চার্লস ডারউইন তাঁদেরই অন্যতম এক অগ্রণীপুরুষ বলেই আত্মজীবনীতে বলতে পেরেছেন, “আমি জানি, ভবিষ্যতে এ বিষয়ে আরও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা হবে–মানুষের উদ্ভব আর মানবজাতির ইতিহাসের উপর এসে পড়বে আরও উজ্জ্বল আলোকরশ্মি।”