একই প্রজাতির একক ও ভ্যারাইটিদের মধ্যে জীবন-সংগ্রামের তীব্রতা
যেহেতু একই গণের প্রজাতিরা–যদিও আদৌ অপরিবর্তনীয় নয়–স্বভাবে ও গঠনবিন্যাসে এবং দেহকাঠামোয় সর্বদা সদৃশকার হয়, যদি এরা পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা শুরু করে, তাহলে ভিন্ন গণগুলির প্রজাতিদের মধ্যেকার সংগ্রামের তুলনায় এদের মধ্যে সংগ্রাম মূলতঃ আরও তীব্র হবে। ইউনাইটেড স্টেটস-এর বিভিন্ন অংশে সাম্প্রতিককালে সোয়ালো পাখির একটি প্রজাতির বিস্তার আমরা লক্ষ্য করি, যা আবার অন্য একটি প্রজাতির সংখ্যা বৃদ্ধি এবং গায়ক গ্লাস পাখির সংখ্যা হ্রাস করেছে। আমরা প্রায়শই শুনি কেমন করে ইঁদুরের একটি প্রজাতি ভিন্ন আবহাওয়ায় অন্য প্রজাতির স্থান দখল করেছে। রাশিয়াতে এশীয় আরশোলারা তাদের সমগোত্রীয়দের সর্বত্র বিতাড়িত করেছে। অস্ট্রেলিয়ায় বহিরাগত মধুমৌমাছি ছোট কাটাহুলহীন স্থানীয় মৌমাছিদের দ্রুত ধ্বংস করেছে। জানা গেছে যে চার্লকের একটি প্রজাতি অন্য প্রজাতিদের স্থানচ্যুত করে; এবং অন্য সব ক্ষেত্রেও এরূপ হয়। কেন সমগোত্রীয় আকারদের মধ্যে প্রতিযোগিতা অতিশয় তীব্র হলে আমরা তা অস্পষ্টভাবে দেখতে পারি, যারা আবার প্রাকৃতিক সংগঠনের একই স্থান পূর্ণ করে। কিন্তু সম্ভবতঃ কোন একটি ক্ষেত্রেও আমরা যথাযথভাবে বলতে পারি না বিরাট জীবনসংগ্রামে কেন একটি প্রজাতি অন্য একটি প্রজাতির ওপর বিজয়ী হয়।
উপরোক্ত মন্তব্যগুলি থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুসিদ্ধান্ত করা যেতে পারে, যথা–প্রত্যেক জীবের দেহকাঠামো অন্য সব জীবের দেহকাঠামোর সঙ্গে অপরিহার্যভাবে বা গুপ্তভাবে সম্পর্কযুক্ত, খাদ্য ও বাসস্থানের জন্য সে যাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামে, অথবা যাদের হাত থেকে পালাতে চায়, অথবা যাদেরকে সে শিকার করে। বাঘের দাঁত, পা ও নখগুলির বক্রাকার গঠনে এটি স্পষ্ট; বাঘের শরীরের লোমে আটকে থাকা পরজীবীদের ক্ষেত্রেও এটি স্পষ্ট। কিন্তু ড্যানডেলিওন উদ্ভিদের সুন্দর পালক সমেত বীজের এবং জল-বিটলের চেপ্টা ও লোমাবৃত পায়ের সম্পর্কটি প্রথমে মনে হয় বায়ু ও জলের সঙ্গে সম্পর্কিত। তথাপি পালক সমেত বীজের সুবিধাটি অন্য উদ্ভিদ দ্বারা পরিপূর্ণ জমির সঙ্গে নিঃসন্দেহেই গভীরভাবে সম্পর্কিত, যাতে করে বীজগুলি ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করতে পারে ও ফাঁকা জমিতে পড়তে পারে। জল-বিটলের পায়ের গঠন সাঁতারের জন্য এত নিখুঁতভাবে অভিযোজিত যে নিজের শিকার খোঁজার জন্য ও অন্য প্রাণীর হাত থেকে পালানোর জন্য অন্য জলজ কীটপতঙ্গদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে পারে এরা।
অনেক উদ্ভিদের বীজের মধ্যে রক্ষিত পুষ্টিকর খাদ্যের ভাণ্ডারের সঙ্গে প্রথমে মনে। হয় অন্যান্য উদ্ভিদের কোন সম্পর্ক নেই। যখন মটর ও বিনের বীজ লম্বা ঘাসের মধ্যে বপন করা হয়, তখন বীজগুলি থেকে উৎপন্ন নতুন চারাগাছের বিপুল বৃদ্ধি থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে বীজের মধ্যে পুষ্টিকর খাদ্যের প্রধান ব্যবহার হচ্ছে। চারাগাছগুলিকে বাড়তে সাহায্য করা, তার পাশাপাশি যখন চতুর্দিকে বিপুলভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত অন্যান্য উদ্ভিদের সঙ্গে এদের সংগ্রাম করতে হয়।
একটি উদ্ভিদের বিস্তার লক্ষ্য করুন, কেন এরা দ্বিগুণ বা চতুগুণ হয় না? আমরা জানি এরা আর একটু বেশি তাপ, শৈত, আদ্রর্তা অথবা শুষ্কতা ভালভাবে সহ্য করতে পারে, সেইজন্য অন্য কোথাও এরা অল্প বেশি তাপ অথবা ঠাণ্ডা, আদ্রর্তা অথবা শুষ্কতা সম্বলিত জেলাগুলিতে বিস্তৃত হয়। এক্ষেত্রে আমরা স্পষ্টভাবে দেখতে পারি যে যদি আমরা এদের সংখ্যাবৃদ্ধির ক্ষমতা প্রদান করার কল্পনা করতে ইচ্ছা করি, তবে প্রতিযোগীদের বা এদের ভক্ষণকারী প্রাণীদের থেকে এদের কিছু সুযোগসুবিধা দেওয়া উচিত। এদের ভৌগোলিক বিস্তারের মধ্যে, আবহাওয়ার জন্য গঠনবিন্যাসের একটি পরিবর্তন আমাদের উদ্ভিদটির পক্ষে স্পষ্টত লাভজনক হবে; কিন্তু বিশ্বাস করার সঙ্গ ত কারণ আছে যে কেবল কতিপয় উদ্ভিদ বা প্রাণী এতদূর বিস্তৃত হয় যে কেবল আবহাওয়ার তীব্রতার জন্যই ধ্বংস হয়। মেরু অঞ্চল এবং মরুভূমির প্রান্তদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত এমন জীবন আমরা দেখি না যেখানে প্রতিযোগিতা স্তব্ধ। দেশটি অতিশয় ঠাণ্ডা অথবা শুষ্ক হলেও উষ্ণতম বা অতিশয় আর্দ্রস্থানের জন্য কতিপয় প্রজাতি অথবা একই প্রজাতির এককদের মধ্যেও প্রতিযোগিতা হয়।
অতএব আমরা লক্ষ্য করতে পারি যখন একটি উদ্ভিদ বা প্রাণী নূতন দেশ ও নূতন প্রতিযোগীদের মধ্যে এসে পড়ে, তখন আবহাওয়া প্রাক্তন বাসস্থানের মত একইরূপ থাকলেও এদের জীবন-পরিবেশ সাধারণতঃ প্রয়োজনানুগভাবে পরিবর্তিত হবে। নূতন বাসস্থানে যদি এদের গড় সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হয়, তাহলে নিজ দেশে যেমনভাবে এদের রূপান্তর ঘটেছে, নূতন বাসস্থানে এদের ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে রূপান্তরিত হওয়া উচিত; কারণ ভিন্ন প্রকার প্রতিযোগী ও শত্রুদের ওপর এদের কিছু সুযোগ-সুবিধা পাওয়া উচিত।
একটি প্রজাতিকে অন্য প্রজাতির তুলনায় বেশি সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার চেষ্টার কল্পনা করার ফল ভাল হয়। কী করা উচিত এ বিষয়ে সম্ভবতঃ একটিও উদাহরণ আমরা জানি না। সমস্ত জীবের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক সম্বন্ধে আমাদের অজ্ঞতার বিষয়ে আরও বেশি দৃঢ় প্রত্যয় জন্মাতে সাহায্য করে। এই দৃঢ় প্রত্যয় যেমন প্রয়োজন, এটি অর্জন করাও তেমনি কষ্টকর। আমরা যা করতে পারি তা হচ্ছে দৃঢ়ভাবে মনের মধ্যে রাখা যে প্রত্যেক জীব গুণোত্তরীয় অনুপাতে বৃদ্ধির চেষ্টা করছে। জীবনের যে কোন পর্যায়ে, বছরের যে কোন ঋতুতে, প্রত্যেক বংশে বা মধ্যবর্তী সময়ে, প্রত্যেক জীবকে অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম করতে হয় এবং ধ্বংসেরও সম্মুখীন হতে হয়। এই সংগ্রাম সম্বন্ধে যখন আমরা স্মরণ করি, তখন পূর্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে আমরা নিজেদের সান্ত্বনা দিতে পারি যে প্রকৃতির সংগ্রাম অবিরাম নয়, কোন আশঙ্কা অনুভূত হয় না, মৃত্যু সাধারণত সক্রিয় এবং সবল, স্বাস্থ্যবান ও সুখীরা বেঁচে থাকে ও সংখ্যাবৃদ্ধি করে।
০৪. প্রাকৃতিক নির্বাচন অথবা যোগ্যতমের উদ্বর্তন
চতুর্থ অধ্যায় – প্রাকৃতিক নির্বাচন অথবা যোগ্যতমের উদ্বর্তন