আর একটি উদাহরণ দেওয়ার জন্য আমি প্রলুব্ধ হচ্ছি, যা দেখায় প্রকৃতির মানদণ্ডে যথেষ্ট ব্যবধানবিশিষ্ট উদ্ভিদ ও প্রাণীরা জটিল সম্পর্কের জালে কেমন করে আবদ্ধ থাকে। এর পর আমি দেখানোর সুযোগ পাব যে কীটপতঙ্গরা কখনই আমার বাগানে আসে না যেখানে লোবিয়েলা ফুজেস গাছ আছে, এবং ফলস্বরূপ এর অদ্ভুত গঠন থাকা সত্ত্বেও কখনও এর বীজ হয় না। এদের পরাগপুঞ্জ অপসারণের জন্য আমাদের প্রায় সমস্ত অর্কিড জাতীয় উদ্ভিদগুলিতে কীটপতঙ্গের পরিদর্শন একান্ত দরকার এবং এর ফলে এরা নিষিক্ত হয়। পরীক্ষার মাধ্যমে আমি আবিষ্কার করেছি যে হার্টসিজ উদ্ভিদদের (ভায়োলা ট্রাইকালার) নিষিক্তকরণের জন্য ভ্রমর-মৌমাছিদের একান্ত প্রয়োজন, কারণ অন্য মৌমাছিরা এই ফুল পরিদর্শন করে না। আমি আরও লক্ষ করেছি যে কোন কোন ক্লোভার উদ্ভিদ নিষিক্তকরণের জন্য মৌমাছিদের আসা প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, ডাচ ক্লোভারের (ট্রাইফোলিয়াম রিপেন্স) ২০টি পুষ্পমঞ্জরী ২২৯০টি বীজ উৎপাদন করেছিল, কিন্তু মৌমাছিদের থেকে সংরক্ষিত অন্য ২০টি পুষ্পমঞ্জরী একটিও বীজ উৎপাদন করেনি। তা ছাড়া লাল ক্লোভারের (ট্রাইফোলিয়াম প্যাটেন্স) ১০০টি পুষ্পমঞ্জরী ২৭০০টি বীজ উৎপাদন করেছিল, কিন্তু সমসংখ্যক সংরক্ষিত পুষ্পমঞ্জরী একটিও বীজ উৎপাদন করেনি। কেবল ভ্রমর-মৌমাছিরাই লাল ক্লোভার উদ্ভিদে আসে, কারণ অন্য মৌমাছিরা এর মধু সংগ্রহ করতে পারে না। মনে করা হয় যে মথ পতঙ্গরা ক্লোভার ফুলগুলিকে নিষিক্ত করতে পারে; কিন্তু লাল ক্লোভারের ক্ষেত্রে এরা এইরূপ করতে পারে কিনা সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে, কারণ এদের ভর যথেষ্ট নয় যা ফুলের পক্ষযুক্ত পাপড়িগুলিকে চাপ দিয়ে নত করতে পারে। অতএব যতদূর সম্ভব আমরা। সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে যদি ভ্রমর-মৌমাছির সমগ্র গণটি ইংল্যান্ডে অবলুপ্ত বা অতিশয় বিরল হয়, তাহলে হার্টসিজ ও লাল ক্লোভার উদ্ভিদরা অতিশয় বিরল ও সামগ্রিকভাবে অদৃশ্য হবে। যে কোন জেলায় ভ্রমর-মৌমাছির সংখ্যা মেঠো ইঁদুরের। সংখ্যার উপর দারুণভাবে নির্ভর করে, কারণ এরা এই মৌমাছিদের জাল ও বাসা নষ্ট করে ফেলে, এবং “সমগ্র ইংল্যান্ডে এদের দুই-তৃতীয়াংশেরও অধিক এভাবে ধ্বংস হয়েছে”-এই অভিমত ব্যক্ত করেন কর্ণেল নিউম্যান, যিনি ভ্রমর-মৌমাছিদের স্বভাব সম্বন্ধে দীর্ঘদিন ধরে অনুসন্ধান করেছেন। প্রায় সকলেই জানে যে বিড়ালদের সংখ্যার উপর ইঁদুরের সংখ্যা বহুলাংশে নর্ভর করে; এবং কর্ণেল নিউম্যান অভিমত ব্যক্ত করেন, “অন্য জায়গার তুলনায় গ্রাম ও ছোট শহরে ভ্রমর-মৌমাছিদের আরও বেশি সংখ্যক বাসা আমি দেখেছি, বিড়ালদের সংখ্যার জন্য এটি হয় বলেই মনে করি আমি; কারণ এরা ইঁদুর ধ্বংস করে।” অতএব এটি সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য যে একটি জেলায় একটি বিড়াল জাতীয় প্রাণীর বিরাট সংখ্যায় উপস্থিতি ঐ জেলায় প্রথমে ইঁদুর ও তারপর মৌমাছিদের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে কোন কোন উদ্ভিদের বারংবার ফুল ফোঁটা নির্ধারণ করে থাকবে।
প্রত্যেক প্রজাতির ক্ষেত্রে, জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে এবং বিভিন্ন ঋতুতে ও বছরে ক্রিয়াশীল হয়ে অনেক ভিন্ন ভিন্ন নিয়ন্ত্রণ সম্ভবতঃ কার্যকরী হয়; কেউ নিয়ন্ত্রণ করে অল্প, কেউ-বা সাধারণতঃ খুব শক্তিশালী হয়; কিন্তু প্রজাতিদের গড় সংখ্যা বা এমনকি তাদের অবস্থান নির্ধারণ করতে সকলেই একমত হবে। কতিপয় ক্ষেত্রে এটি দেখানো যেতে পারে যে ব্যাপকভাবে ভিন্ন ভিন্ন নিয়ন্ত্রণ বিভিন্ন জেলায় একই প্রজাতির ওপর কার্যকরী হয়। ঘেরা জায়গায় উদ্ভিদ ও ঝোঁপগুলি যখন আমরা লক্ষ্য করি, তখন এদের আনুপাতিক সংখ্যা ও ধরনগুলি হঠাৎ ঘটে বলে অভিহিত করতে প্রলোভিত হই। কিন্তু এই মতবাদটি একেবারেই ভুল: প্রত্যেকে শুনেছে যে আমেরিকার অরণ্য কেটে ফেলার পরবর্তী সময়ে ভিন্ন ধরনের বনানী আবির্ভূত হয়; কিন্তু লক্ষ্য করা গেছে যে দক্ষিণ ইউনাইটেড স্টেটস-এর প্রাচীন ইন্ডিয়ান ধ্বংসাবশেষের জায়গায় যেখানে বৃক্ষরাজি কেটে ফেলা হয়েছিল, সেখানে এখন পার্শ্ববর্তী স্বাভাবিক আদিম অরণ্যের মত একই রকম মনোরম বৈচিত্র্যে ভরা অরণ্যের আবির্ভাব ঘটেছে। প্রতিবছর হাজারে হাজারে বীজ উৎপাদনকারী কয়েক ধরনের বৃক্ষের মধ্যে বহু শতাব্দী ধরে কি তীব্র সংগ্রামই হয়ে। থাকবে। কীটপতঙ্গের মধ্যে সংগ্রাম, কীটপতঙ্গ, শামুক ও অন্য প্রাণীদের সঙ্গে পাখি এবং শিকারি পশু-পাখিদের মধ্যে সংগ্রাম-সকলের একটাই চেষ্টা, সেটা হচ্ছে বৃদ্ধি। সকলে পরস্পরকে খাদ্য হিসেবে ভক্ষণ করে, অথবা বৃক্ষ, তাদের বীজ ও চারাগুলিকে খায় অথবা অন্য উদ্ভিদগুলিকে খায়, যারা প্রথম ভূমিকে পূর্ণ করেছিল এবং এইভাবে গাছের বৃদ্ধি রোধ করেছিল। কিছু পালক উড়িয়ে দিন, দেখবেন সকলে নির্দিষ্ট নিয়মে মাটিতে পড়ে। কিন্তু সমস্যাটি কত সরল, যেখানে অসংখ্য প্রাণী ও উদ্ভিদের ক্রিয়া ও প্রক্রিয়ায় ঐগুলির তুলনায় প্রত্যেকে পতিত হবে, যারা কয়েক শতাব্দী ধরে পুরনো ইন্ডিয়ান ধ্বংসাবশেষের ওপর এমন বাড়ন্ত বৃক্ষদের আনুপাতিক সংখ্যা ও ধরন নির্ধারণ করেছে।
পরজীবীরা যেমন তাদের শিকারের ওপর বেঁচে থাকে, তেমনি একটি জীবও অন্য জীবের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে এবং এই নির্ভরশীলতা সাধারণতঃ প্রকৃতির। মানদণ্ডে যথেষ্ট ব্যবধানবিশিষ্ট জীবদের মধ্যেই গড়ে ওঠে। কোন কোন সময় এটি সেই ঘটনার মত হয়, যাকে সঠিকভাবে বললে বলা যেতে পারে বাঁচার জন্য পরস্পরের মধ্যে সংগ্রাম, যেমন পঙ্গপাল ও তৃণভোজী চতুম্পদ প্রাণীদের ক্ষেত্রে ঘটে। কিন্তু একই প্রজাতির এককগুলির মধ্যে সংগ্রাম প্রায় অনিবার্যভাবে কঠোর হবে, কারণ এরা একই জেলায় নিয়মিত জন্মায়, এদের একই খাদ্যের প্রয়োজন হয়, এরা একই বিপদের সম্মুখীন হয়। একই প্রজাতির ভ্যারাইটিদের ক্ষেত্রে সংগ্রাম সাধারণতঃ প্রায় সমভাবে কঠোর হবে এবং কোন কোন সময় আমরা লক্ষ্য করি সংগ্রামটি মীমাংসিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, গমের কয়েক ধরনের ভ্যারাইটিকে যদি একত্রে বোনা হয় এবং মিশ্রিত বীজ যদি আবার বোনা হয়, তাহলে মাটি ও আবহাওয়ার পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত বা স্বভাবতই সবচেয়ে উর্বর এমন ভ্যারাইটিদের কয়েকটি অন্যদের পরাজিত করবে ও আরও বীজ উৎপাদন করবে এবং পরিণতিতে কয়েক বছরের মধ্যে অন্য ভ্যারাইটিদের স্থানচ্যুত করবে। বিভিন্ন রঙের মিষ্টি মটরের মত, এমন কি অতি নিকটতর ভ্যারাইটিদের মিশ্রিত কুল সংরক্ষিত করে রাখতে প্রত্যেক বছর এদের আলাদা করে চাষ করা উচিত এবং তারপর বীজদের সঠিক অনুপাতে মেশানো উচিত, অন্যথায় দুর্বলতর আকারগুলি নিয়মিতভাবে সংখ্যায় হ্রাস পাবে এবং অদৃশ্য হবে। ভেড়াদের ভ্যারাইটিদের ক্ষেত্রেও এইরূপ হয়। জোরের সঙ্গে বলা হয়েছে যে কোন কোন পর্বতবাসী ভ্যারাইটি অন্য পর্বতবাসী ভ্যারাইটিদের অনশনে রাখবে, সেইজন্য এদের একত্রে রাখা যেতে পারে না। ভেষজ জোঁকের বিভিন্ন ভ্যারাইটিদের একত্রে রাখলেও একই ফল পাওয়া যায়। প্রাকৃতিক পরিবেশে একইভাবে যদি এদের সংগ্রাম করতে দেওয়া হত এবং বীজ বা শিশুদের যদি সঠিক অনুপাতে প্রতিবছর সংরক্ষণ না করা হত, তাহলে আমাদের গৃহপালিত উদ্ভিদ ও প্রাণীদের যে কোনটির ভ্যারাইটিদের একই ক্ষমতা, স্বভাব ও জৈবিক সংগঠন যথাযথভাবে বজায় থাকতো কিনা যাতে করে আধ ডজন বংশপর্যায় পর্যন্ত একটি মিশ্রিত কুলের (যাদের সংকরণ বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে) আদি অনুপাত বজায় রাখা যেতে পারে, তাতে সন্দেহের অবকাশ আছে।