খাদ্যের পরিমাণ নিশ্চয়ই প্রত্যেক প্রজাতির বৃদ্ধির চূড়ান্ত সীমা নির্ধারণ করে দেয় যার মধ্যে তারা বৃদ্ধি পেতে পারে; কিন্তু এটি প্রায়শই খাদ্য প্রাপ্তির জন্য হয় না, বরং অন্য প্রাণীদের শিকারের জন্য ব্যবহৃত হয়, যেটি আবার একটি প্রজাতির গড় সংখ্যা নির্ধারণ করে। সন্দেহ করার অবকাশ নেই যে, যে কোন বড় এস্টেটে তিতির ও গ্রাউস পাখি এবং শশকদের কুল মূলত কীটমূষিকাদির ধ্বংসের উপর নির্ভর করে। পরবর্তী কুড়ি বছরে ইংল্যান্ডে যদি একটিও প্রাণীকে হত্যা করা না হয় এবং এই সময়ে যদি কোন। পোকামাকড় ধ্বংস না হয়, তাহলে বর্তমানের তুলনায় খুব সম্ভবতঃ শিকারযোগ্য প্রাণী কম থাকবে, যদিও এখন শত সহস্র শিকারি পশুরা হাতিকে ধ্বংস করতে পারে না, কারণ এমনকি ভারতবর্ষেও বাঘেরা বাচ্চা হাতিদের আক্রমণ করার সাহস দেখায় এমন ঘটনা প্রায় বিরল।
কোন প্রজাতির গড় সংখ্যা নির্ধারণ করতে জলবায়ু একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, এবং ভয়ানক ঠাণ্ডা ও খরার পর্যায়ক্রমিক ঋতুপরিবর্তন সম্ভবতঃ সমস্ত নিয়ন্ত্রকগুলির মধ্যে সবচেয়ে ফলপ্রদ। আমি হিসেব করেছিলাম (বসন্তকালে মূলতঃ পাখির বাসার ক্রমহ্রাসমান সংখ্যা থেকে) যে ১৮৫৪-৫৫ সালের শীতকাল আমার, নিজের জমির পাখিদের মধ্যে তিন-চতুর্থাংশকে ধ্বংস করেছে; এবং এই ধ্বংসকার্য ভয়ানক, যখন আমরা স্মরণ করি যে মানুষের ক্ষেত্রে মহামারী হলে দশ শতাংশ মৃত্যুই ভয়ানক। জলবায়ুর প্রক্রিয়াকে প্রথম দর্শনে অস্তিত্বের সংগ্রাম থেকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ বলে মনে হয়। কিন্তু জলবায়ুর প্রক্রিয়া যতখানি খাদ্য উৎপাদন হ্রাস করে, তখন একই সময়ে যারা একই ধরনের খাদ্যে জীবনধারণ করে, একই বা ভিন্ন প্রজাতির এককদের কঠোর সংগ্রামে উদ্দীপ্ত করে এই প্রক্রিয়া। উদাহরণস্বরূপ, এমন কি যখন জলবায়ু অত্যধিক ঠাণ্ডা হয় তখন যদি এটি প্রত্যক্ষভাবে ক্রিয়াশীল হয়, তাহলে কম সবল অথবা শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে যারা কম পরিমাণ খাদ্য খায় এমন এককরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমরা যখন দক্ষিণ থেকে উত্তরে বা আর্দ্র থেকে শুষ্ক অঞ্চলে ভ্রমণ করি, তখন কিছু প্রজাতি ক্রমশঃ বিরল থেকে বিরলতর এবং অবশেষে অদৃশ্য হয় এটা আমরা অনিবার্যরূপে লক্ষ্য করি; এবং আবহাওয়ার পরিবর্তন এত স্পষ্ট যে সমগ্র ফলাফলটিকে তারই প্রত্যক্ষ কাজ বলে চিহ্নিত করতে প্রলোভিত হই আমরা। কিন্তু এটি ঠিক নয়। আমরা ভুলে যাই যে প্রত্যেক প্রজাতি, এমনকি অতি সুলভ প্রজাতিও একই খাদ্য ও স্থানের জন্য শত্রু ও প্রতিযোগীদের দ্বারা জীবনের যে কোন পর্যায়ে ব্যাপকভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে; আবহাওয়ার কোন অল্প পরিবর্তনের জন্য এই শত্রু ও। প্রতিযোগীরা যদি সামান্য মাত্রায় প্রভাবিত হয়, তাহলে এদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে; এবং যেহেতু প্রত্যেক অঞ্চল ইতিমধ্যে অধিবাসীদের দ্বারা পরিপূর্ণ, সেহেতু অন্য প্রজাতিরা নিশ্চয় হ্রাস পাবে। আমরা দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হলে লক্ষ্য করি একটি প্রজাতি সংখ্যায়। ক্রমশঃ হ্রাস পাচ্ছে; আমরা নিশ্চয় অনুভব করতে পারি এর মূল কারণটি হচ্ছে সেই প্রজাতিরা আনুকূল্য পায়, যেমন এক্ষেত্রে অন্য একটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ব্যাপারটা একইরূপ হয় যখন আমরা উত্তর দিকে অগ্রসর হই, কিন্তু কিছুটা কম মাত্রায়, কারণ সমস্ত ধরনের প্রজাতিদের সংখ্যা এবং প্রতিযোগীদের সংখ্যাও উত্তর দিকে হ্রাস পায়, অতএব উত্তরদিকে অগ্রসর হওয়া বা পর্বতে ওঠার সময় জলবায়ুর প্রত্যক্ষ ক্ষতিকর প্রক্রিয়ার জন্য আমরা প্রায়শই খর্বাকৃতি আকারের সাক্ষাৎ পাই, যেটা আমরা দক্ষিণদিকে যাওয়া বা পর্বত থেকে নামার সময় দেখি না। আমরা যখন মেরুঅঞ্চলে বা বরফাচ্ছাদিত পর্বতশীর্ষে কিংবা প্রকৃত মরুভূমিতে যাই, তখন দেখি কেবল উপাদানগুলির সঙ্গে প্রায়শই অস্তিত্বের সংগ্রাম ঘটছে।
অন্য প্রজাতিদের প্রতি আনুকূল্য প্রদর্শন করে জলবায়ু যে অপ্রত্যক্ষভাবে কাজ করে, তা আমরা বাগানের অসংখ্য উদ্ভিদের ক্ষেত্রে স্পষ্টভাবে দেখি। আমাদের বাগানের উদ্ভিদরা আমাদের জলবায়ুকে দক্ষতার সঙ্গে সহ্য করতে পারে, কিন্তু এরা কখনও পরিবেশানুগ (ন্যাচারালাইজ) হয় না, কারণ এরা আমাদের দেশজ উদ্ভিদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারে না বা আমাদের দেশীয় প্রাণীদের দ্বারা বিনাশপ্রাপ্ত হওয়াকে প্রতিরোধ করতে পারে না।
অতিশয় অনুকূল পরিবেশের জন্য যখন একটি প্রজাতি একটি ছোট এলাকায় অবাধে, সংখ্যাতীতভাবে বৃদ্ধি পায়, তখন মহামারী দেখা দেয়–অন্ততঃ শিকারি প্রাণীদের ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটতে দেখা যায়; এবং এখানে অস্তিত্বের সংগ্রাম নিরপেক্ষ সীমিত নিয়ন্ত্রণ থাকে। কিন্তু তথাপি এই তথাকথিত মহামারী পরজীবী কৃমির জন্য হয় বলে মনে হয়, যেখানে সম্ভবতঃ অংশত দলবদ্ধ প্রাণীদের মধ্যে ব্যাপ্তির সুবিধা থেকে কিছু কারণের জন্য সামঞ্জস্যহীনভাবে আনুকূল্য প্রদর্শন করা হয়েছে: এবং পরজীবী ও তার শিকারির মধ্যে কিছু পরিমাণ সংগ্রাম এখানে পরিলক্ষিত হয়।
পক্ষান্তরে, অনেক ক্ষেত্রে সংরক্ষণের জন্য শত্রুদের সংখ্যার আপেক্ষিক অনুপাতে একই প্রজাতির এককদের বিরাট সংখ্যা প্রয়োজন হয়। এইরূপে আমরা আমাদের জমিতে অনায়াসে প্রচুর শস্য ও রেপসিড ইত্যাদি উৎপাদন করতে পারি, কারণ পাখিদের সংখ্যার তুলনায় পাখিদের খাদ্যবীজের পরিমাণ অনেক বেশি; অথবা এক ঋতুতে অত্যধিক পরিমাণ খাদ্যের যোগান থাকা সত্ত্বেও বীজ সরবরাহের অনুপাতে পাখিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পারে না, কারণ এদের সংখ্যা শীতকালে নিয়ন্ত্রিত হয়; কিন্তু যিনি এ ব্যাপারে চেষ্টা করেছেন তিনি জানেন যে একটি বাগানে কিছু গম ও এরূপ অন্য গাছ থেকে বীজ পাওয়া কতখানি কষ্টসাধ্য কাজ : এক্ষেত্রে আমি প্রত্যেক বীজ নষ্ট করেছি। সংরক্ষণের জন্য একই প্রজাতির এককদের বিরাট সংখ্যার প্রয়োজনীয়তার এই ধারণাটি প্রকৃতির কিছু অদ্ভুত বিষয়কে ব্যাখ্যা করে, যেমন কিছু জায়গায় অবস্থিত অতি বিরল উদ্ভিদ কোন কোন সময় সংখ্যায় প্রচুর হয় এবং কয়েকটি সামাজিক উদ্ভিদ এমন কি তাদের বিস্তারের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত সামাজিক থাকে অর্থাৎ এককগুলি সংখ্যায় প্রচুর হয়। কারণ এসব ক্ষেত্রে আমরা বিশ্বাস করতে পারি যে একটি উদ্ভিদ কেবল সেখানেই অবস্থান করতে পারে যেখানে জীবনধারণের উপাদানসমূহ এত অনুকূল যে অনেক সংখ্যায় একত্রে অবস্থান করতে পারে এবং এভাবে প্রজাতিটিকে চরম বিনাশের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। এখানে আমার আরও বলা উচিত যে আন্তঃসঙ্করণের ভাল ফল ও নিকট আন্তঃপ্রজননের খারাপ ফল নিঃসন্দেহে এ-সবের অনেক ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। কিন্তু এখানে আমি বিষয়টি নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করছি না।