প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রায় প্রত্যেক পরিণত উদ্ভিদ বছরে একবার বীজ উৎপাদন করে, এবং প্রাণীদের মধ্যে অতি অল্প কয়েকটি বছরে একবার সন্তান উৎপাদন করে না। অতএব আমরা নিশ্চিতভাবে দাবী করতে পারি, যে সমস্ত উদ্ভিদ ও প্রাণীরা গুণোত্তরীয় অনুপাতে বৃদ্ধির দিকে প্রবণতাযুক্ত হচ্ছে–যে যেখানেই অবস্থান করুক না কেন সেই অঞ্চলটিকে পূর্ণ করতে চেষ্টা করবে–যে জীবনের যে কোন সময়ে বিনাশের দ্বারা বৃদ্ধির এই গুণোত্তরীয় প্রবণতা নিশ্চয় নিয়ন্ত্রিত হবে। আমার মনে হয় গৃহপালিত প্রাণীদের সঙ্গে পরিচিতি আমাদের বিপথে পরিচালিত করতে উদ্যত হয়: এদের ব্যাপকভাবে বিনাশ আমরা লক্ষ্য করি না, অন্যদিকে এ-ও লক্ষ্য করি না যে খাদ্যের জন্য প্রতি বছর হাজারে-হাজারে এদের হত্যা করা হয় এবং প্রাকৃতিক পরিবেশেও সমসংখ্যক প্রাণী কোন না কোন প্রকারে শেষ হয়ে থাকে।
বছরে একবার হাজারে-হাজারে এবং অতি অল্প বীজ বা ডিম উৎপাদনকারী জীবদের মধ্যে একমাত্র পার্থক্যটি হচ্ছে অনুকূল পরিবেশে, যত বড়ই হোক না কেন, একটি জেলাকে পরিপূর্ণ করতে ধীরগতিতে বংশবৃদ্ধিকারীদের আরও কয়েক বছরের প্রয়োজন হবে। দক্ষিণ আমেরিকার বিশালাকায় শকুনরা কয়েক জোড়া ডিম পাড়ে ও উটপাখি এককুড়ি ডিম পাড়ে, তা সত্ত্বেও একই দেশে দুটির মধ্যে প্রথমোক্তটির সংখ্যা আরও বেশি হয়, ফুলমার পেট্রেল পাখিটি মাত্র একটি ডিম পাড়ে, তথাপি এটিকে পৃথিবীতে সবচেয়ে সংখ্যাবহুল পাখি বলে বলা হয়। একটি মক্ষিকা কয়েকশত ডিম পাড়ে, হিপ্নেবস্কার মত অন্য একটি কেবলমাত্র একটি ডিম পাড়ে; কিন্তু দুটি প্রজাতির কতগুলি একক এক জেলায় থাকতে পারবে, এই পার্থক্যটি তা নির্ধারণ করে না। অনিশ্চিত পরিমাণ খাদ্যের উপর নির্ভর করতে হয় বলে এইসব প্রজাতিদের অত্যধিক সংখ্যক ডিমের এত প্রয়োজন, কারণ এটি এদের দ্রুতহারে বৃদ্ধি ঘটায়। কিন্তু জীবনের কোন পর্যায়ে অত্যধিক বিনাশের ক্ষতিপূরণের জন্য অসংখ্য ডিম ও বীজের প্রকৃতই প্রয়োজন; এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি হয় জীবনের প্রাথমিক বয়সে। কোন প্রাণী যদি তার নিজের ডিম ও বাচ্চাদের রক্ষা করতে পারে, তাহলে অল্প সংখ্যায় এরা উৎপন্ন হতে পারে, এবং তা সত্ত্বেও গড় কুল সম্পূর্ণরূপে পূর্ণ থাকবে। কিন্তু যদি বহু ডিম বা বাচ্চাগুলি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, তাহলে নিশ্চয় অসংখ্য উৎপন্ন হবে বা প্রজাতিটি বিলুপ্ত হবে। গড়ে এক হাজার বছর বাঁচে এমন একটি বৃক্ষের পূর্ণসংখ্যা বজায় রাখার পক্ষে এটি যথেষ্ট হবে যদি এক হাজার বছরে কেবল একটি বীজ উৎপন্ন হত এবং এটি কখনও নষ্ট না হত ও উপযুক্ত স্থানে অঙ্কুরিত হত। অতএব, এইসব ক্ষেত্রে ডিম ও বীজগুলির গড় সংখ্যার ওপর যে কোন প্রাণী ও উদ্ভিদের গড় সংখ্যা নির্ভর করে।
প্রকৃতির দিকে লক্ষ্য করার সময় আগেকার আলোচনাগুলি মনে রাখা প্রয়োজন কখনও ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে প্রত্যেক জীব তার সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য প্রচণ্ড চেষ্টা করে বলে বলা হয়, প্রত্যেকে জীবনের কোন পর্যায়ে সংগ্রাম করেই বেঁচে থাকে, এবং হয় শৈশবে নয়তো পরিণত অবস্থায় প্রত্যেক বংশে বা মধ্যবর্তী যে কোন সময়ে ব্যাপক বিনাশ অনিবার্যরূপে ঘটে। প্রতিবন্ধকগুলিকে লঘুতর করলে, যত অল্পই হোক ধ্বংসের তীব্রতা হ্রাস করলে, প্রজাতির সংখ্যা প্রায় সঙ্গে সঙ্গে যে কোন পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে।
বৃদ্ধির নিয়ন্ত্রণের ধরণ
প্রত্যেক প্রজাতির বৃদ্ধির সাধারণ প্রবণতা দমনের কারণগুলি খুবই অস্পষ্ট। সবচেয়ে সবল প্রজাতিদের দিকে লক্ষ্য করুন, এরা সংখ্যায় যতই বৃদ্ধি পায়, ততধিক বৃদ্ধি পেতে প্রবণ হয়ে ওঠে। এমন কি একটি মাত্র উদাহরণে নিয়ন্ত্রণগুলি কী কী তা সঠিকভাবে আমরা জানি না। অথবা এটি কাউকেই আশ্চর্যান্বিত করবে না যিনি স্মরণ করেন এ বষয়ে আমরা কত অজ্ঞ, এমন কি মানুষ জাতি সম্পর্কেও, যদিও তুলনামূলকভাবে অন্যান্য প্রাণীদের তুলনায় বেশি পরিচিত। কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বৃদ্ধির নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি সম্পর্কে দক্ষতার সঙ্গে বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন এবং আমি আশা করি ভবিষ্যতের গবেষণায় এটি সুদীর্ঘভাবে আলোচনা করবো, আরও বিশেষ করে দক্ষিণ আমেরিকার বন্য প্রাণীদের সম্পর্কে। কয়েকটি প্রধান বিষয় পাঠকদের মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য এখানে আমি কয়েকটা কথা বলব। ডিম অথবা অতিশয় শিশু প্রাণীরাই সম্ভবতঃ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিন্তু এটি অপরিহার্য নয়। উদ্ভিদদের ক্ষেত্রে বীজগুলি অতিমাত্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, কিন্তু আমার কয়েকটি পর্যবেক্ষণ থেকে মনে হয় অন্যান্য উদ্ভিদ দ্বারা পরিপূর্ণ ভূমিতে অঙ্কুরোদগমের সময় চারাগাছগুলি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিভিন্ন শত্রুদের আক্রমণে চারাগাছগুলি অধিক সংখ্যায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। উদাহরণস্বরূপ, তিন ফুট লম্বা ও দু ফুট চওড়া একটি জায়গার মাটি খনন ও পরিষ্কার করার পর এবং যেখানে অন্য উদ্ভিদদের জন্মাতে দেওয়া হয়নি সেখানে জন্মানোর পর আমাদের দেশের দেশীয় আগাছাদের চারাগাছগুলিকে চিহ্নিত করেছিলাম আমি, এবং লক্ষ্য করেছিলাম ৩৫৭টির মধ্যে কম করেও ২৯৫টি চারাগাছ প্রধানতঃ স্থলচর শামুক ও অন্যান্য পতঙ্গদের দ্বারা ধ্বংস হয়েছিল। ঘাসগুলি কেটে দেওয়া হলে বা কোন চতুষ্পদ প্রাণীর দ্বারা খাওয়ালেও এমন ঘাসের চাপড়া যদি বাড়তে দেওয়া হয়, তাহলে অধিক সকল উদ্ভিদরা পূর্ণবয়স্ক উদ্ভিদ হলেও কম সকল উদ্ভিদদের ক্রমশঃ হত্যা করে; এভাবে কাটা ঘাস চাপড়ার ছোট প্লটে (তিন ফুট x চার ফুট) জন্মানো কুড়িটি প্রজাতির মধ্যে নয়টি প্রজাতি ধ্বংস হয়েছিল এবং অন্য প্রজাতিদের স্বাধীনভাবে বাড়তে দেওয়া হয়েছিল।