অস্তিত্বের সংগ্রাম পদটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত
আমার গোড়ায় উল্লেখ করা উচিত যে একটির ওপর অন্যটির নির্ভরশীলতা এবং শুধু এককটির জীবন নয় বরং বংশধর উৎপাদনে সক্ষম এই দুটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে ব্যাপক ও আলংকারিক অর্থে এই পদটি ব্যবহার করেছি আমি। সঠিকভাবে বলা যেতে পারে যে অভাবের সময় দুটি কুকুরসদৃশ প্রাণী খাদ্য ও বাঁচার জন্য পরস্পরের সঙ্গে সংগ্রাম করে। মরুভূমির প্রান্তে একটি উদ্ভিদ খরার বিরুদ্ধে বাঁচার জন্য পরস্পরের সঙ্গে সংগ্রাম করে বলা হয়, কিন্তু সঠিকভাবে বললে বলা উচিত যে এরা আর্দ্রতার উপর নির্ভরশীল। একটি উদ্ভিদ প্রতি বছর হাজার হাজার বীজ উৎপাদন করে, এদের মধ্যে গড়ে কেবলমাত্র একটিই পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়। আরও সঠিকভাবে বললে বলা যেতে পারে যে এরা একই ধরনের ও অন্য ধরনের উদ্ভিদদের সঙ্গে সংগ্রাম করে, যারা ইতিমধ্যে জমিকে পূর্ণ করে রেখেছে। মিটো উদ্ভিদ আপেল ও অন্য অল্প কয়েকটি গাছের উপর নির্ভরশীল, কিন্তু কষ্টকল্পিতভাবে বলা যেতে পারে যে এরা এইসব বৃক্ষের সঙ্গে সংগ্রাম। করে। আসল কারণ হচ্ছে এইসব পরজীবীরা যদি অসংখ্যভাবে একই বৃক্ষের সঙ্গে সংগ্রাম করে। আসল কারণ হচ্ছে এইসব পরজীবীরা যদি অসংখ্যভাবে একই বৃক্ষের ওপর জন্মায়, তবে এরা নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং মারা যায়। কিন্তু আরও সঠিকভাবে বললে বলা যেতে পারে যে একই শাখায় কাছাকাছি একত্রে জন্মানো কয়েকটি চারা মিটো উদ্ভিদ পরস্পরের সঙ্গে সংগ্রাম করে। যেহেতু পাখিরা মিটো উদ্ভিদের বীজ ইতস্ততঃ ছড়িয়ে দেয়, সেহেতু এর অস্তিত্ব পাখিদের ওপর নির্ভর করে। এবং নিয়মানুসারে বলা যেতে পারে যে এরা অন্য ফল-উৎপাদক উদ্ভিদের সঙ্গে সংগ্রাম করে, ফল গিলে খাওয়ার জন্য পাখিদের প্রলোভিত করে এবং এভাবে এরা ইতস্ততঃ ছড়িয়ে পড়ে। পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এই রকম কয়েকটি অর্থে সুবিধার জন্য অস্তিত্বের সংগ্রামের সাধারণ পদটি ব্যবহার করেছি আমি।
বৃদ্ধির গুণোত্তরীয় অনুপাত
সমস্ত জীবনের উচ্চ হারে বৃদ্ধির প্রবণতা থেকেই অস্তিত্বের সংগ্রাম গড়ে ওঠে। নিজেদের সাধারণ জীবৎকালে কয়েকটি ডিম বীজ উৎপাদন করে এমন প্রত্যেকটি জীব তার জীবনের কোন পর্যায়ে ও কোন ঋতুতে অথবা আকস্মিক কোন বছরে নিশ্চয় ধ্বংসের সম্মুখীন হয়, পক্ষান্তরে গুণোত্তরীয় বৃদ্ধির নিয়মানুসারে এদের সংখ্যা শীঘ্রই এত অত্যধিক বৃদ্ধি পাবে যে কোন দেশ উৎপাদনগুলিকে প্রতিপালন করতে পারবে না। অতএব যেহেতু বেঁচে থাকার তুলনায় আরও অনেক বেশি এককদের জন্ম হয়, সেহেতু হয় একই প্রজাতির একটি এককের সঙ্গে অন্যটির, না হয় ভিন্ন প্রজাতির এককদের সঙ্গে, অথবা জীবনের ভৌতিক পরিবেশের সঙ্গে প্রত্যেক ক্ষেত্রে নিশ্চয় বাঁচার সংগ্রাম চলবে। এটাই হচ্ছে ম্যালথাসের তত্ত্ব যা সমগ্র প্রাণী ও উদ্ভিদজগতে প্রচণ্ড জোরের সঙ্গে প্রয়োগ করা হয়, কারণ এক্ষেত্রে খাদ্যের কোন কৃত্রিম বৃদ্ধি হতে পারে না এবং কোন বিচক্ষণ ব্যক্তি বিবাহ করা থেকে নিবৃত্ত হতে পারে না। যদিও এখন কয়েকটি প্রজাতি কিছুটা দ্রুতহারে সংখ্যায় বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু সকলে এরূপ করতে পারে না, কারণ পৃথিবী এদের ধারণ করতে পারবে না।
নিয়মটির কোন ব্যতিক্রম নেই যে প্রত্যেক জীব স্বাভাবিকভাবে এত দ্রুতহারে বৃদ্ধি পায় যে যদি না তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, তাহলে পৃথিবী এক জোড়া বংশধর দ্বারা শীঘ্রই পূর্ণ হবে। এমনকি মন্থরভাবে প্রজননক্ষম মানুষ পঁচিশ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে, এবং এক হাজার বছরের কম সময়ের মধ্যে আক্ষরিক অর্থে এই হারে এদের বংশধরদের দাঁড়াবার কোন জায়গা থাকবে না। লিনিয়াস গণনা করেছেন যে একটি একবর্ষজীবী উদ্ভিদ যদি কেবলমাত্র দুটি বীজ উৎপাদন করে–এভাবে এত অনুর্বর উদ্ভিদ যদি না থাকে–এবং যদি এদের চারাগাছগুলি পরের বছর দুটি উৎপাদন করে এবং যদি এইভাবে চলে, তবে কুড়ি বছরে দশ লক্ষ উদ্ভিদ জন্মাবে। সমস্ত প্রাণীদের মধ্যে হাতি হচ্ছে সবচেয়ে কম প্রজননক্ষম, এবং এদের স্বাভাবিক বৃদ্ধির সম্ভবপর সর্বনিম্ন হার আমি কষ্ট করে হিসেব করেছি। মোটামুটিভাবে ধরে নেওয়া যেতে পারে যে হাতিরা ত্রিশ বছরের হলে সন্তান উৎপাদনক্ষম হয় এবং নব্বই বছর পন্ত বেঁচে থাকে। যদি এভাবে চলতে থাকে তাহলে : ৭৪০ থেকে ৭৫০ বছরপরে প্রায় এক শত নব্বই লক্ষ হাতি বেঁচে থাকবে, যারা প্রথম। জোড়ার বংশধর।
কিন্তু গেবল তত্ত্বগত গণনার তুলনায় এ বিষয়ে আমাদের কাছে ভাল সাক্ষ্যপ্রমাণ রয়েছে। যেমন, পরপর দুই বা তিনটি ঋতুপরিবর্তনের সময় যখন পারিপার্শ্বিক অবস্থা অনুকূল হয়, তখন প্রাকৃতিক পরিবেশে বিভিন্ন প্রাণীদের আশ্চর্যজনকভাবে দ্রুত বৃদ্ধির অসংখ্য নথিভুক্ত ঘটনা রয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়া অনেক ধরনের গৃহপালিত প্রাণীদের মধ্যে অধিকতর চিত্তাকর্ষক সাক্ষ্যপ্রমাণ রয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকায় এবং পরবর্তী সময়ে অস্ট্রেলিয়ায় মন্থর প্রজননক্ষম গোমহিষাদি ও ঘোড়াদের বৃদ্ধির হারের বক্তব্যগুলি সত্য বলে যদি প্রমাণিত না হয়, তবে এটি অবিশ্বাস্য হবে। উদ্ভিদের ক্ষেত্রেও এমন হয়। প্রবর্তিত উদ্ভিদের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, যারা সমগ্র দ্বীপের সর্বত্র দশ বছরের কম সময়ের মধ্যে সহজলভ্য হয়েছে। উদ্ভিদদের মধ্যে কয়েকটি, যেমন কার্টুন ও লম্বা থিসল, ইউরোপ থেকে লা-প্লাটায় প্রবর্তিত হয়েছিল, যারা পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ এখন সেখানে সহজলভ্য হয়েছে এবং অন্য প্রত্যেক উদ্ভিদকে বিতাড়িত করে কয়েক বর্গমাইল এলাকা দখল করেছে। ডঃ ফ্যালকনারের কাছ থেকে আমি শুনেছি আমেরিকা থেকে আমদানীকৃত কিছু উদ্ভিদ ভারতের কন্যাকুমারী থেকে হিমালয় পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। এ রকম আরও অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। এসব ক্ষেত্রে কেউ মনে করে না যে প্রাণী বা উদ্ভিদের প্রজননক্ষমতা যুক্তিগ্রাহ্য পরিমাণে হঠাৎ এবং সাময়িকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা হচ্ছে-জীবন-পরিবেশ অতিশয় অনুকূল হয়েছে এবং ফলে নবীন ও প্রবীণদের কম বিনাশ হয়েছে এবং প্রায় সকল নবীনরা সন্তান উৎপাদনে সক্ষম হয়েছে। নূতন বাসস্থানে অস্বাভাবিক দ্রুত বৃদ্ধি ও ব্যাপকভাবে ব্যাপ্তির বিষয়টি এদের গুণোত্তরীয় হার থেকে সরলভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, যার ফলাফল কখনও ব্যর্থ হয় না।