১৮৩১ খ্রিস্টাব্দ। ভবিষ্যতের চার্লস ডারউইন তখন ২২ বছরের যুবক। হেশ্লোর। সুপারিশেই প্রকৃতিবিজ্ঞানী হিসাবে এইচ. এম. বিল্ল’ জাহাজের দীর্ঘ অভিযানের শরিক হন তিনি। ১৮৩১-এর ২৭শে ডিসেম্বর তারিখে প্লিমাউথ বন্দর থেকে বিলের যাত্রা শুরু হয়। দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার নানা দেশ, আন্দিজ পর্বতাঞ্চল, গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ-সহ নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া পরিভ্রমণ করে, কেপটাউন, সেন্ট হেলেনা হয়ে, ১৮৩৬-এর ২রা অক্টোবর ফলমাউথ বন্দরে ফিরে আসে বিল। বিল্ল জাহাজের অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলভাগের মানচিত্র তৈরির কাজে সাহায্য করা, সেই সঙ্গে সঠিকভাবে দ্রাঘিমারেখা নির্ধারণ করা।
কিন্তু প্রকৃতিবিজ্ঞানী ডারউইন পৃথিবীর গহনতম এই সব অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করলেন প্রচুর উদ্ভিদ, কীটপতঙ্গ, মথ, প্রজাপতি, শামুক, পাথর, জীবাশ্ম, সেই সঙ্গে বিপুল অভিজ্ঞতা। দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলের প্রচুর জীবাশ্ম এবং গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের বহু বিচিত্র প্রজাতিগুলিকেই ডারউইনের যাবতীয় চিন্তাভাবনার মূল উৎস হিসাবে চিহ্নিত করা যায়।
গ্যালাপাগোসের মতো বিচ্ছিন্ন দ্বীপপুঞ্জে বিরল সমস্ত প্রজাতির বিস্তারণ (Distribution) লক্ষ্য করেই তিনি ভেবেছিলেন, ঐসব প্রজাতি একদা মূল ভূখণ্ডের পূর্বপুরুষদের মধ্য থেকেই এসেছিল এবং পরে কোন কারণে অন্যরকম হয়ে উঠেছে–কিন্তু কেমন করে এবং কেন? এমন কি হতে পারে যে জীবনযাত্রার পরিস্থিতির সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক রয়েছে–যা, সম্ভবত কতকগুলি বৈশিষ্ট্যেরই অনুকূল, অন্যগুলির নয়? তিনি তৎকালীন ইংল্যান্ডের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ধ্যানধারণার দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হন। ভাবলেন, মানুষের অর্থনৈতিক জীবনে প্রতিযোগিতার যে পরিস্থিতি বিদ্যমান তা হয়ত জীবজগতেও ক্রিয়াশীল, আর পুঁজিতান্ত্রিক শোষণকে ন্যায্য প্রমাণ করার জন্য যাজক ম্যালথাস-এর তত্ত্ব তো হাতের কাছেই ছিল। যাজক ম্যালথাসের মতে জীবন একটা যুদ্ধ, সে যুদ্ধে কেবল যোগ্যতমরাই জয়লাভ করে, সে যুদ্ধে নৈতিক উৎকর্ষের পুরস্কার হিসাবে জোটে সম্পদ ও সন্মান। জনসংখ্যার চাপ যাতে খাদ্যের যোগানকে ছাপিয়ে না ওঠে তারই জন্য যুদ্ধ, মহামারী, প্রাকৃতিক বিপর্যয়। ডারউইন ভাবতে লাগলেন প্রাণীসমাজেও যদি তাই ঘটে? তা যদি হয় তাহলে পরিবেশের পক্ষে আরো উপযোগী হয়ে ওঠার পথে যারা নিজেদের এতটুকুও বদলে নিতে পারল তারা সেই সুবিধাটুকু তাদের উত্তরপুরুষের মধ্যে সঞ্চার করে দেবে, এই ভাবে ধীরে ধীরে প্রজাতির বর্তমান চেহারার উদ্ভব হবে। এই চিন্তা ডারউইনের আগেই করা চলছিল। এদের মধ্যে সবচেয়ে মৌলিক ছিল লামার্কের (১৭৪৪-১৮২৯) বক্তব্য। ফরাসী এই উদ্ভিদবিদ ১৮০৯ সালে সাহসের সঙ্গে এক তত্ত্ব উপস্থাপন করলেন যে পরিবেশের সঙ্গে আরও মানিয়ে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে জন্ম নেয় যোগ্য হয়ে ওঠার এক প্রক্রিয়া, এবং এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই পূর্ববর্তীকালের প্রজাতি থেকে ক্রমে আজকের প্রজাতির উদ্ভব। উঁচু গাছের পাতা খাবার আকাঙ্ক্ষা থেকে জন্ম নেয় যোগ্য হয়ে ওঠার এক প্রক্রিয়া, এবং এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই পূর্ববর্তীকালের প্রজাতি থেকে ক্রমে আজকের প্রজাতির উদ্ভব। উঁচু গাছের পাতা খাবার আকাঙ্ক্ষায় জিরাফ তার গলা বাড়িয়েছিল, সেই গলা-বাড়ানোর উত্তরাধিকার বর্তায় তার পরবর্তী প্রজন্মের উপর। এই ভাবনাকে মনে হয়েছিল দূরকল্পিত, সমর্থনের অযোগ্য। কিন্তু ইতিমধ্যে জমতে শুরু করেছিল সাক্ষ্যপ্রমাণ–কেবল জীবিত প্রাণী সম্পর্কিত চর্চার ফলেই নয়, জীবাশ্ম সম্পর্কিত চর্চার ফলও এর সঙ্গে যুক্ত হল। আর এই কাজটি অতি সাফল্যের সঙ্গেই সমাধা করেন চার্লস ডারউইন। ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের ক্ষেত্রে ১৮৪০-এর বিশ্বব্যাপী বুভুক্ষু দশক ছিল এরকম একটা পর্যবেক্ষণের পক্ষে একান্তই উপযোগী সময়।
‘Origin of Species & Natural Selection’ সংক্রান্ত যে চিন্তাভাবনা ও সিদ্ধান্তে। ডারউইন পৌঁছন, তার ২০ বছর পর পুস্তকাকারে তার আবিষ্কার ও সিদ্ধান্ত ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত হল। এই সময়ের মধ্যে বহু ঘটনার সমাবেশ, যার উল্লেখ করার প্রয়োজন বোধ করছি না।
পৃথিবীর জ্ঞানভাণ্ডারে সংযোজিত হল এক ঐতিহাসিক সম্পদ–অরিজিন অফ স্পিসিস। প্রজাতির বিবর্তন, তার ইতিহাস, রূপান্তর–সব কিছুর প্রধান উৎস হিসাবে চিহ্নিত হল প্রাকৃতিক নির্বাচন। কোপারনিকাস, গ্যালিলিওর সময় থেকে ঊনবিংশ শতকের ষাটের। দশকে পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে খানিকটা অগ্রসর হওয়া সত্ত্বেও তার ধ্যানধারণা এক তুমুল দীর্ঘস্থায়ী বিবাদের জন্ম দিল। এ বিবাদ ছিল মূলত ধর্মতাত্ত্বিক বা রাজনৈতিক প্রশ্নকে ঘিরে, বিশুদ্ধ বৈজ্ঞানিক প্রশ্নকে ঘিরে নয়। কেবলমাত্র জীববিদ্যা সংক্রান্ত বিজ্ঞানে নয়, এ তত্ত্ব কোপারনিকাস, গ্যালিলিওর তত্ত্বেরই সমগ্র সামাজিক চিন্তার ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে পরিবর্তন করে দেওয়ার প্রতীকরূপে গৃহীত হতে পারে। ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠলেন সারা দেশের ধর্মগুরুরা। এই তত্ত্ব বাইবেলোক্ত সৃষ্টিতত্ত্বের বিরোধী–এই বলে আক্রমণ করা হল ডারউইন-তত্ত্বকে। শুধু সভা-সমিতিতে নয়, কার্যক্ষেত্রে নানা ভাবে ডারউইনকে হেয় করার চেষ্টা হল। মানুষকে বানরের মতো করে কার্টুন আঁকা হল, Monkey law-র নামে আমেরিকার বিভিন্ন প্রদেশে ডারউইন-তত্ত্ব পড়ানো নিষিদ্ধ হল। শুধু সেইসময়ে কেন, মাত্র কয়েকমাস আগেও আমেরিকার কানসাস প্রদেশে ডারউইন-তত্ত্ব পড়ানোর উপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এর কারণ কী?