প্রাণী ও উদ্ভিদের জাতগুলির উৎপত্তি সম্বন্ধে সংক্ষেপে মূল কথা হল–জীবনের পরিবর্তিত পরিবেশ জীবদেহে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করে এবং অপ্রত্যক্ষভাবে জননতন্ত্রকে প্রভাবিত করে, উভয় উপায়েই পরিবৃত্তি ঘটাতে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। এটি বিশ্বাসযোগ্য নয় যে প্ৰকারণ সকল অবস্থায় একটি সহজাত ও প্রয়োজনীয় আকস্মিক উপাদান। বংশগতি ও পূর্বাবস্থায় প্রত্যাবর্তনের কম বা বেশি ক্ষমতা পরিবৃত্তিসমূহ স্থায়ী হবে কিনা নির্ধারণ করে। পরিবর্তনশীলতা (প্রকারণ) অনেক অজানা নিয়ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, যার মধ্যে পারস্পরিক সম্বন্ধযুক্ত ক্রমিকবৃদ্ধি সম্ভবতঃ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। জীবনের পরিবেশের নির্দিষ্ট প্রভাবের উপর কিছুটা আরোপ করা যেতে পারে, কিন্তু কতখানি তা আমরা জানি না। অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ব্যবহার বা অব্যবহারেরও কিছু প্রভাব থাকে, সম্ভবতঃ বেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবই থাকে, এটি বলা যেতে পারে। সর্বশেষ ফলাফল অত্যন্ত জটিল। কয়েকটি ক্ষেত্রে, আমাদের জাতগুলি সৃষ্টি করতে আদিম ভিন্ন প্রজাতিদের আন্তঃসঙ্করণ বোধ হয় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যখন কয়েকটি জাত একবার কোন দেশে উদ্ভূত হয়, তখন নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের আকস্মিক আন্তঃসঙ্করণ নিঃসন্দেহেই নূতন উপজাত সৃষ্টিতে বহুলাংশে সাহায্য করেছে; কিন্তু প্রাণী ও বীজ দ্বারা বংশবৃদ্ধি করা উদ্ভিদের উভয় ক্ষেত্রে সঙ্করণের প্রয়োজনীয়তাকে অতিশয় অতিরঞ্জিত করা হয়েছে। সাময়িকভাবে কর্তিত অংশ, কুঁড়ি ইত্যাদি দ্বারা বংশবৃদ্ধি করতে অত্যন্ত উদ্ভিদদের ক্ষেত্রে সঙ্করণের প্রয়োজনীয়তা অসীম; কারণ চাষীরা সঙ্কর, বর্ণসঙ্কর উভয়েরই অত্যধিক পরিবর্তনশীলতা (প্রকারণ)-কে এবং সঙ্করদের বন্ধ্যাত্বকে এখানে অবজ্ঞা করে; বীজ দ্বারা বংশবৃদ্ধি করে না এমন উদ্ভিদগুলি আমাদের কাছে অল্প গুরুত্বের, কারণ এদের স্থায়িত্বকাল ক্ষণস্থায়ী। পরিবর্তনের এইসব কারণগুলির মধ্যে নিয়মানুগভাবে এবং দ্রুতহারে প্রয়োগ হোক বা না হোক, অথবা অচেতনভাবে ও মন্থরভাবে কিন্তু আরও দক্ষতার সঙ্গে নির্বাচনের সঞ্চয়কারক প্রক্রিয়াটি সম্ভবতঃ সর্বাধিক শক্তিমান।
০২. প্রাকৃতিক পরিবৃত্তি
দ্বিতীয় অধ্যায় – প্রাকৃতিক পরিবৃত্তি
বিভিন্নতা–এককের ভিন্নতা–সন্দেহজনক প্রজাতিরা ব্যাপকভাবে বিস্তৃত, অতিশয় পরিব্যাপ্ত–সাধারণ প্রজাতিরা সর্বাধিক পরিবর্তনশীল–প্রত্যেক দেশের বৃহত্তর গণের প্রজাতিরা ক্ষুদ্রতর গণের প্রজাতিদের তুলনায় প্রায়শই বেশি পরিবর্তনশীল–বৃহত্তর গণের অনেক প্রজাতি সম্ভবতঃ পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, কিন্তু সীমাবদ্ধ বিস্তারের ভ্যারাইটিরা পরস্পরের সঙ্গে অসমভাবে সম্পর্কযুক্ত।
আগের অধ্যায়ে উপনীত সিদ্ধান্তগুলো প্রাকৃতিক পরিবেশে জীবদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কিনা তা আলোচনার পূর্বে প্রাকৃতিক পরিবেশে জীবরা পরিবর্তনশীল কিনা এটা আমাদের আলোচনা করে নেওয়া উচিত। বিষয়টি উপযুক্তভাবে আলোচনা করতে নীরস তথ্যগুলির একটি দীর্ঘ তালিকা দেওয়া উচিত; তাহলে ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য এই তথ্যগুলি সংরক্ষিত করে রাখব। প্রজাতি পদটি সম্বন্ধে যে বিভিন্ন সংজ্ঞা দেওয়া হয় তা আমি এখানেও আলোচনা করব না। যে কোন একটি সংজ্ঞা সব প্রকৃতিবিজ্ঞানীকে সন্তুষ্ট করে না; তথাপি প্রজাতি বলতে কী অর্থ বোঝাতে চান তা প্রত্যেক প্রকৃতিবিজ্ঞানীর কাছেই অস্পষ্ট। সৃষ্টির একটি দূরবর্তী প্রক্রিয়ার অজানা উপাদান সাধারণতঃ পদটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ভ্যারাইটি (প্রকার) পদটির সংজ্ঞা নিরূপণ করাও প্রায় সমভাবে কষ্টকর; কিন্তু এখানে এটির প্রায় সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত অর্থ হচ্ছে বংশ সম্প্রদায়, যদিও এটি কদাচিৎ প্রমাণ করা যেতে পারে। আমরা যাদের বিকৃতাঙ্গ উদ্ভিদ ও প্রাণী বলি তা-ও আছে, কিন্তু এরা ক্রমে ক্রমে ভ্যারাইটিতে (প্রকারে) পরিণত হয়। আমি ধরে নিই একটি বিকৃতাঙ্গের অর্থ দেহগঠনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিচ্যুতি, যা সাধারণতঃ প্রজাতির পক্ষে ক্ষতিকর, বা হিতকর নয়। কয়েকজন বিশেষজ্ঞ পেশাগত অর্থে ‘পরিবৃত্তি’ পদটি ব্যবহার করে, যার অর্থ প্রত্যক্ষভাবে জীবনের ভৌতিক পরিবেশের জন্যই রূপান্তর ঘটে; এই অর্থে ‘পরিবৃত্তিগুলি’ মনে হয় আনুবংশিক হয় না; কিন্তু বাল্টিক সাগরের ঈষৎ লোনা জলের শম্বুক প্রাণীদের খর্বাবস্থা, অথবা আলপাইন পর্বতশৃঙ্গের উদ্ভিদদের খর্বাকৃতি, অথবা আরও উত্তরদিকের প্রাণীদের ঘনতর লোম, এদের কয়েকটি ক্ষেত্রে অন্ততঃ কয়েক বংশপরম্পরায় বংশগতভাবে প্রেরিত হবে না কে বলতে পারে? এবং এক্ষেত্রে আমি সত্য বলে মনে করি যে আকারটিকে একটি ভ্যারাইটি (প্রকার) বলা উচিত।
আমাদের গৃহপালিত উৎপাদনগুলির ক্ষেত্রে, ও আরও বিশেষ করে উদ্ভিদের ক্ষেত্রে, দেহগঠনের আকস্মিক ও বিশেষ পরিমাণ বিচ্যুতি প্রাকৃতিক পরিবেশে কখনও স্থায়ীভাবে বংশবৃদ্ধি করেছে কিনা, তা সন্দেহজনক। প্রত্যেক জীবের প্রায় প্রত্যেকটি অঙ্গ তার জীবনের জটিল অবস্থার সঙ্গে এত সুন্দরভাবে সম্পর্কযুক্ত যে এটি অসম্ভব বলে হয় যে কোন একটি অঙ্গ নিখুঁতভাবে হঠাৎ উদ্ভূত হয়েছে, যেমন মানুষ কি কখনও একটি নিখুঁত জটিল যন্ত্র আবিষ্কার করেছে? গৃহপালনাধীন অবস্থায় বিকৃতাঙ্গদের উদ্ভব ঘটে যা ব্যাপকভাবে ভিন্ন প্রাণীদের স্বাভাবিক দেহগঠনের মতো হয়। এভাবে প্রায়শই শুড়ের মতো অঙ্গ সমেত শূকরছানা জন্মায়, এবং যদি একই গণের যে কোন বন্য প্রজাতির স্বাভাবিকভাবে একটি শুড় থাকত, তাহলে এখানে যুক্তি দেখানো যেতে পারত যে। বিকৃতাঙ্গ রূপে এটি আবির্ভূত হয়েছিল; কিন্তু পরিশ্রমসাধ্য অনুসন্ধানের পরেও প্রায় সম্বন্ধযুক্ত আকারদের স্বাভাবিক দেহের সদৃশ বিকৃতাঙ্গগুলি আবিষ্কার করতে আমি এখনও পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছি। যদি এই প্রকারের বিকৃতাঙ্গগুলি কখনও প্রাকৃতিক অবস্থায় আবির্ভূত হয় ও জননে সমর্থ হয় (যা সব সময় ঘটে না), যেহেতু এগুলি বিরল ও এককভাবে ঘটে, এদের সংরক্ষণ অসাধারণ অনুকূল অবস্থার ওপর নির্ভর করবে। এরা প্রথম ও পরবর্তী বংশসমূহে সাধারণ আকারের সঙ্গে সঙ্করিত হবে, এবং এরূপে এদের। অস্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যসমূহ প্রায় অনিবার্যভাবে লুপ্ত হবে। একক বা আকস্মিক পরিবৃত্তিসমূহের সংরক্ষণ ও স্থায়িত্বের বিষয়টি নিয়ে পরবর্তী একটি অধ্যায়ে আলোচনা করব আমি।