মানুষের নির্বাচন শক্তির অনুকূল পরিবেশ
মানুষের নির্বাচন শক্তির অনুকূল বা প্রতিকূল পরিবেশ সম্পর্কে আমি কয়েকটি কথা বলব। অধিক পরিবৃত্তি স্পষ্টতঃই অনুকূল হয়, কারণ এটি নির্বাচনের জন্য উপাদান অবাধে প্রদান করে। আকাঙ্খিত যে কোন দিকে বিপুল পরিমাণ রূপান্তরের পুঞ্জীভবনের জন্য এককীয় পার্থক্যসমূহ যথেষ্ট নয়। কিন্তু যেহেতু মানুষের কাছে উপকারী ও মানুষকে সন্তুষ্টকারী পরিবৃত্তিগুলি কেবল অনিয়মিতভাবে আবির্ভূত হয়, সেহেতু অসংখ্য একক রাখলে এদের আবির্ভাবের সম্ভাবনা অত্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। অতএব সংখ্যাই হচ্ছে সাফল্যের জন্য অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। এই পদ্ধতিটির উপর ভিত্তি করে ইয়র্কশায়ারের কোন অঞ্চলের ভেড়াদের সম্পর্কে মার্শাল মন্তব্য করেছিলেন, “যেহেতু এরা দরিদ্র মানুষের অধিকারভুক্ত ও সংখ্যায় অল্প, তাই কখনও এদের উন্নত করা যেতে পারে না।” অন্যদিকে, একই উদ্ভিদের বিরাট সংখ্যক এককদের রক্ষণাবেক্ষণ করে মালীরা সাধারণতঃ অপেশাদারদের তুলনায় নূতন ও মূল্যবান ভ্যারাইটির উদ্ভব ঘটাতে আরও বেশি সাফল্য লাভ করে। একটি প্রাণী ও উদ্ভিদের বিরাট সংখ্যক এককদের লালনপালন করা যেতে পারে কেবলমাত্র সেখানেই, যেখানে বংশবৃদ্ধির পরিবেশ অনুকূল। যখন এককগুলি অপ্রচুর, তখন এদের বংশবৃদ্ধি ঘটতে দিলে, এদের বৈশিষ্ট্যমূলক গুণ যা-ই হোক, এরা সার্থকভাবে নির্বাচন প্রতিরোধ করবে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটি হচ্ছে উদ্ভিদ বা প্রাণীদের এত উচ্চ মূল্য দেবার জন্য মানুষ তাদের গুণ বা দেহের অল্পতম বিচ্যুতির প্রতি গভীর মনোযোগ দেয়। যদি এভাবে মনোযোগ না দেওয়া হয়, কোন কিছুই ঘটানো যেতে পারে না। গুরুগম্ভীরভাবে বলতে শুনেছি যে স্ট্রবেরী গাছ পরিবর্তিত হতে শুরু করে তখনই যখন বাগানবিদরা গাছটির দিকে নজর দেয়। সন্দেহ। নেই যে স্ট্রবেরী গাছের চাষ শুরুর সময় থেকেই সর্বদা পরিবর্তিত হতে শুরু করেছিল, কিন্তু অল্পতম ভ্যারাইটিগুলিকে অবহেলা করা হয়েছিল। তবে যখনই বাগানবিদরা অল্প বড় আকারে, ভাল ফল সমেত এই উদ্ভিদগুলিকে তোলেন, এদের থেকে চারাগাছ তৈরী করেন এবং পুনরায় উৎকৃষ্টতম চারাগাছ তোলেন, এদের বংশবৃদ্ধি (স্বতন্ত্র প্রজাতির সঙ্গে সঙ্করণের সাহায্যে) ঘটান, তখন থেকেই স্ট্রবেরী গাছের ঐ সব বিস্ময়কর ভ্যারাইটিদের উদ্ভব হয়েছিল যা গত অর্ধশতাব্দীতেই ঘটেছে।
প্রাণীদের ক্ষেত্রে, নূতন জাত সৃষ্টিতে সঙ্করণ প্রতিরোধ করাই হচ্ছে একটি প্রধান উপাদান–অন্ততঃ একটি দেশে যেখানে অন্যান্য জাত অধিক সংখ্যায় পরিপূর্ণ, এ ব্যাপারে কোন অঞ্চলের সীমাবেষ্টনী একটি ভূমিকা পালন করে। আদিম অসভ্য ও মুক্ত সমতলের অধিবাসীদের কাছে একটি প্রজাতির একটি জাতের বেশি জাত কদাচিৎ থাকে। পায়রাদের মিলন ঘটানো যেতে পারে, এবং এটি পাখিরসিকদের পক্ষে খুব সুবিধাজনক, কারণ একই পক্ষিশালায় মিশ্রিত থাকে এমন অনেক জাতকে উন্নত ও বিশুদ্ধ অবস্থায় রাখা যেতে পারে; এবং এই পরিবেশ নূতন জাত সৃষ্টিতে নিশ্চয়ই অনুকূল হয়ে থাকবে। আমি যোগ করতে পারি যে পায়রাদের অধিক সংখ্যায় এবং দ্রুত হারে বংশবৃদ্ধি করা যেতে পারে এবং নিকৃষ্টদের সহজেই বাতিল করা যেতে পারে ও হত্যার পর এদের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। অন্যদিকে, বিড়ালদের ক্ষেত্রে, যাদের মতো রাত্রিতে ইতস্ততঃ ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাসবিশিষ্ট জুড়ি খুঁজে বার করা যায় না এবং যাদের মহিলা ও শিশুরা খুব পছন্দ করে, একটি স্বতন্ত্র জাত দীর্ঘদিন ধরে টিকে রয়েছে এমনটা আমরা কদাচিৎ লক্ষ্য করি। আমরা অনেক সময় দেখি যে এইসব জাত অন্য দেশ থেকে আমদানী করা হয়েছে। যদিও আমি সন্দেহ করি না যে কয়েকটি গৃহপালিত প্রাণী অন্যদের তুলনায় কম হারে পরিবর্তিত হয়, তথাপি বিড়াল, গাধা, ময়ূর, রাজহাঁস প্রভৃতির স্বতন্ত্র জাতদের বিরলতা বা অনুপস্থিতির জন্য বলা যেতে পারে যে নির্বাচন পদ্ধতিটি বহুলাংশে তার ভূমিকা পালন করে না; বিড়ালদের ক্ষেত্রে এদের মিলন ঘটানোর অসুবিধা; গাধাদের ক্ষেত্রে, দরিদ্র মানুষরা কয়েকটিকে পোষে ও তাদের বংশবৃদ্ধিতে কদাচিৎ মনোযোগ দেয়; সম্প্রতিকালে স্পেন ও ইউনাইটেড স্টেক্স-এর কোন কোন অঞ্চলে যত্নসহকারে নির্বাচন দ্বারা এই প্রাণীটি বিস্ময়করভাবে রূপান্তরিত ও উন্নত হয়েছে; ময়ূরদের ক্ষেত্রে, এদের সহজেই পালন করা যায় না ও অধিক সংখ্যায় বৃদ্ধি করা যায় না; রাজহাঁসরা কেবলমাত্র দুটি বিষয় অর্থাৎ খাদ্য ও পালকের জন্য মূল্যবান এবং বিশেষ করে স্বতন্ত্র জাতগুলি প্রদর্শন করিয়েও কোন আনন্দানুভূতি উদ্রেক করে না; কিন্তু গৃহপালনাধীন পরিবেশে রাজহংসীদের দেহগঠন অদ্ভুতভাবে অনমনীয়, তা সত্ত্বেও আমি অন্যত্র বর্ণনা করেছি যে এরা অল্পমাত্রায় পরিবর্তিত হয়।
কয়েকজন লেখক দৃঢ়ভাবে মত পোষণ করেন যে আমাদের গৃহপালিত উৎপাদনসমূহে পরিবৃত্তির পরিমাণ শেষ সীমায় পৌঁছেছে এবং এগুলি কখনই এই সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারে না। নিশ্চিত করে বললে বেশি হঠকারিতা হবে যে, যে কোন একটি ক্ষেত্রে শেষ সীমায় পৌঁছানো গিয়েছে; কারণ আমাদের সব প্রাণী ও উদ্ভিদের অধিকাংশই সম্প্রতিকালে অনেক বিষয়ে দারুণভাবে উন্নত হয়েছে এবং এটি পরিবৃত্তির ইঙ্গিত দেয়। আরও নিশ্চিতভাবে বললে একইরকম হঠকারিতা হবে যে প্রায় শেষ সীমায় পৌঁছানো বর্তমানে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত বৈশিষ্ট্যগুলি, অনেক শতাব্দী ধরে স্থির থাকার পর জীবনের নূতন পরিবেশে পুনরায় পরিবর্তিত হতে পারত না। মিঃ ওয়ালেসের মতানুসারে–যাঁর মতের যথেষ্ট সত্যতা আছে–কোন সন্দেহ নেই যে অন্ততঃ একটি সীমায় পৌঁছানো যাবে। উদাহরণস্বরূপ যে কোন স্থলচর প্রাণীর দ্রুতগামিতার বৈশিষ্ট্য নিশ্চয় থাকবে, কারণ ঘর্ষণকে কাটিয়ে ওঠা, শরীরের ভার বহনের ক্ষমতা ও মাংসপেশীর সংকোচনের দ্বারা এটি নির্ধারিত হবে, কিন্তু যে বিষয়টি আমাদের ভাবিত করে তা হচ্ছে–একই প্রজাতির গৃহপালিত ভ্যারাইটিগুলি একই গণের ভিন্ন প্রজাতিদের তুলনায় প্রায় সমস্ত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে পরস্পরের থেকে আরও বেশি ভিন্ন হয়, যে বৈশিষ্ট্যগুলোতে মানুষ বেশি মনোযোগ দেয় ও নির্বাচিত করে। ইসিডোরে জিওফ্রয় সেন্ট হিলারে আকার, বর্ণ, সম্ভবতঃ লোমের ক্ষেত্রেও এটি প্রমাণ করেছেন। দ্রুতগামিতার ক্ষেত্রে বলা যায় এটি অনেক শারীরিক বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভরশীল, কারণ। অতিশয় দ্রুতগামী এবং একই গণের অন্তর্গত যে কোন দুটি প্রাকৃতিক প্রজাতির তুলনায় ভারী ঠেলাগাড়ি-টানা ঘোড়া তুলনামূলকভাবে বেশি শক্তিশালী। উদ্ভিদের ক্ষেত্রে, বিন অথবা ভূট্টার বিভিন্ন ভ্যারাইটিদের বীজগুলি একই দুটি গোত্রের যে কোন একটি গণের ভিন্ন প্রজাতিদের বীজগুলির তুলনায় আকারে সম্ভবতঃ আরও বেশি ভিন্ন হয়। এটি কুলগাছের কয়েকটি ভ্যারাইটির ফল সম্পর্কেও খাটে, এবং তরমুজ জাতীয় গাছের ক্ষেত্রে আরও বেশিভাবে এবং সদৃশ অনেক ক্ষেত্রেও ঘটে।