আমাদের মতো দাসসুলভ মানসিকতার দেশ ছাড়া যাদের সবল-সরস মাতৃভাষা বর্তমান, সেখানে তারা জ্ঞানবিজ্ঞান, সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন সবকিছুই নিজেদের মাতৃভাষা রচনা করেন। অন্য দেশে প্রকাশিত প্রয়োজনীয় বইপত্র, সে বিজ্ঞানই হোক আর সাহিত্যই হোক, নিজেদের ভাষায় অনুবাদ করে আত্মস্থ করেন।
আমাদের দেশে সম্প্রতিকালে নানা বিষয়ে মৌলিক গ্রন্থ রচনা ও অনুবাদ কিছু কিছু হলেও তার সংখ্যা এত নগণ্য যে আগামী একশ বছরেও আমাদের প্রয়োজন মিটবার কোন সম্ভাবনা দেখতে পাই না। এই কাজের জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠান অবশ্যই অনেক হয়েছে। কিন্তু প্রচার যত কাজ যে তুলনায় অতি নগণ্য।
বাস্তব এই অবস্থার মধ্যে উচ্চশিক্ষা ও আমাদের মতো সাধারণ মানুষ বিজ্ঞানের এক গুরুত্বপূর্ণ শাখার যুগান্তকারী জ্ঞানপাত্রের কানায় অন্ততঃ এই অনুদিত বইটির মাধ্যমে মুখ ছোঁয়াতে পারে। চার্লস ডারউইনের ‘Origin of Species’-এর অনুবাদ প্রকাশ করে অনুবাদক শ্রী শান্তিরঞ্জন ঘোষ ও প্রকাশক দীপায়ন উভয়েই আমাদের বিশেষভাবে অভিনন্দনযোগ্য হয়েছেন। প্রথমত এই ধরনের বিজ্ঞানগ্রন্থের যথার্থতা বজায় রেখে সাবলীল ও স্বচ্ছন্দ অনুবাদ খুবই দুরূহ। এই কাজটিই আন্তরিকতার সঙ্গে সমাধা করার জন্য অসীম ধৈৰ্য্য সহকারে যে অমানুষিক পরিশ্রম শান্তিরঞ্জন ঘোষ করেছেন সে কথা আমার অজানা নয়। এই কাজটি করার জন্য, আমি নিঃসন্দেহ যে, কেবলমাত্র জীববিজ্ঞান নয়, বিজ্ঞানের সব বিভাগের ছাত্র, শিক্ষক ও বিজ্ঞানপ্রিয় সব মানুষেরই কৃতজ্ঞতা-ভাজন হবেন তিনি। প্রকাশককেও আমাদের সহস্র ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রাখলাম। আজকের দিনে মাতৃভাষাকে অপমানিত করার জন্য হঠাৎ কেঁপে ওঠা একদল পরশ্রমভোজী মধ্যবিত্ত যাঁরা কাঞ্চনকৌলিন্য ব্যতিরেকে আর সব কিছুকেই নস্যাকরণে উঠে-পড়ে লেগেছেন এবং সেই সঙ্গে জ্ঞানবিজ্ঞানের বইয়ের কেনা ও পড়ার দিকে ও প্রকাশে বেশ বড় রকমের ভাটা লক্ষণীয়। এমনি এক অবস্থায় আর্থিক লাভালাভের বিষয়টি গৌণ করে বইখানি প্রকাশে যে ঝুঁকি প্রকাশক নিলেন তার জন্য অবশ্যই তিনি আমাদের ধন্যবাদার্হ। সেই সঙ্গে আমরা আশা করব এই বই কিনে পড়বার যথেষ্ট পাঠক, লাইব্রেরি প্রকাশক পাবেন, যার ফলে এই ধরনের প্রকাশের কাজে তিনি আরও উৎসাহিত হবেন।
এ তো গেল প্রারম্ভিক কিছু অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কথা। এই প্রসঙ্গে আরও কয়েকটি কথা বলার চেষ্টা করছি। হয়ত অনেকের কাছে আমার এই বক্তব্য অনধিকার চর্চা মনে হতে পারে, কারণ বিজ্ঞান নিয়ে নাড়াচাড়া করার কোন ছাপ আমার গায়ে নেই। তথাপি আলোচনা করছি তার প্রধান কারণ–আমি আমার সীমিত ক্ষমতানুসারে সমাজবিজ্ঞান নিয়ে নাড়াচাড়া করে থাকি এবং এই সমাজ পরিবর্তনের যে বৈপ্লবিক চিন্তার প্রয়োজন, চালর্স ডারউইন সেই জগতে বেশ জবরদস্ত জায়গা করে নিয়েছেন। এই সূত্র ধরেই কিছু কথা বলা দরকার মনে হওয়ায় কিছু লিখবার স্পর্ধা দেখালাম।
.
প্রসঙ্গ : চার্লস ডারউইন
অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডে ইরাসমাস ডারউইন একটি বিশেষ পরিচিত নাম। তিনি ছিলেন একাধারে বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, উদ্ভাবক, লেখক, অনুবাদক। নিজের লেখা ‘জুনোমিয়া’ নামে একটি বইতে এক জায়গায় তিনি লিখেছিলেন যে সব প্রাণীর রক্ত গরম তারা সবাই একই সূত্র থেকে এসেছে–এই ধারণাটা যে খুবই সাহসী ও নূতন। চিন্তার খোরাক যোগাবে, তাতে কোন সন্দেহ থাকার কারণ নেই। এই ঠাকুরদার নাতিই হলেন চার্লস ডারউইন। পিতার নাম রবার্ট ডারউইন। মাতার নাম সুসানা ওয়েউড। পেশায় রবার্ট ডারউইন ছিলেন চিকিৎসক। কাজ করতেন সপশায়ারের শিউসবেরিতে। রবার্ট-সুসানার ছয় সন্তানের পঞ্চম সন্তান ছিলেন চার্লস ডারউইন। জন্ম ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দের ১২ ফেব্রুয়ারি। পরিবারটি ছিল ধর্মভীরু গোঁড়া খ্রিস্টান। এই আবহাওয়াতেই গড়ে ওঠেন ডারউইন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত পিতৃভক্ত। চার্লস ডারউইনের জীবনী বলার কোন প্রয়োজনে এই কথার উল্লেখ করছি না। বলার উদ্দেশ্য একটিই, তা হল–যে খ্রিস্টীয় সৃষ্টিতত্তের বিশ্বাসের আওতায় তাকে মানুষ হতে হয়েছিল, তাঁর সারা জীবনের গবেষণা কর্মকাণ্ড সেই বিশ্বাসকেই সমূলে উৎপাটিত করেছে।
ডারউইনের বাবা চেয়েছিলেন পুত্র ডাক্তার হোক, সেই আশা ফলবতী না হওয়ায় চাইলেন অন্তত যাজক হোক। চার্লস ডারউইন তা-ও হননি, হলেন প্রকৃতিবিজ্ঞানী। ছোটবেলা থেকেই বাঁধাধরা লেখাপড়া ভাল লাগত না তার। ভাল লাগত প্রকৃতির মধ্যে ঘুরে বেড়াতে। সাবেক কালের বাঁধাধরা পড়াশোনা তাঁকে আকর্ষণ করতে পারত না। তার ঝোঁক ছিল নানা ধরনের নুড়িপাথর, মুদ্রা, নামলেখা মোহর, গাছপালা, লতাপাতা, পোকামাকড়, পাখির ডিম সংগ্রহ করে চিহ্নিত করে রাখার কাজে। এছাড়া রসায়নশাস্ত্রের প্রতি ছিল তার এক সহজাত আকর্ষণ। সাহিত্যের প্রতিও তার আকর্ষণ লক্ষণীয়। কেব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রাইষ্ট কলেজের যাজক হওয়ার ক্লাস করতে গিয়ে যাজক হওয়া তার হয়নি। কিন্তু এই সময়েই চলত তার দল বেঁধে শিকার করা, সেই সঙ্গে পোকামাকড় সংগ্রহ করে চিহ্নিত করার কাজ। এখানেই তিনি পরিচিত হন উদ্ভিদবিদ্যার অধ্যাপক জন সিভেন্স হেনস্লো-র সঙ্গে। তিনি হয়ে ওঠেন চার্লস ডারউইনের প্রেরণাদাতা। ঠাকুরদার লেখা ‘জুনোমিয়া’ বইটি আবার ভাল করে পড়লেন। পড়লেন লামার্কের লেখা। পড়লেন হাম্বোল্ড-এর ‘পার্সোন্যাল ন্যারেটিভ’, হারসেল-এর ‘ইনট্রোডাকশন টু দ্য স্টাডি অফ ন্যাচারাল ফিলজফি’। ডারউইনের নিজের ভাষায়, ‘প্রকৃতিবিজ্ঞান’ পঠনে এই দুটি লেখার অবদান আমাকে তখন উৎসাহ-উদ্দীপনার তুঙ্গে তুলে দিয়েছিল। অধ্যাপক হেনস্লো তাকে ভূতত্ত্ব পড়তে উৎসাহ যোগান।