পরিশেষে, পায়রাদের সকল জাতের সঙ্কর ও বর্ণসঙ্কররা যে জননশক্তি সম্পন্ন হয়, সবচেয়ে স্বতন্ত্র জাতগুলির উপর আমি যে উদ্দেশ্যমূলকভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলাম তার উপর ভিত্তি করে তা আমি নিশ্চিতরূপে বলতে পারি। বর্তমানে প্রাণীদের দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রজাতির সঙ্কররা সম্পূর্ণরূপে উর্বর হয়, এমন কোন ঘটনার কথা কদাচিৎ নিশ্চিতরূপে জানা যায়। কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করেন যে দীর্ঘদিন গৃহপালনাধীনে থাকার ফলে প্রজাতির বন্ধ্যা হওয়ার এই শক্তিশালী প্রবণতা অপসারিত হয়। কুকুর এবং অন্য কয়েকটি গৃহপালিত প্রাণীর ইতিহাস দেখলে বোঝা যায় যে এই সিদ্ধান্ত নিকট সম্বন্ধযুক্ত প্রজাতিদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হলে সম্ভবতঃ সম্পূর্ণ সঠিকই হবে। এখনকার গিরাবাজ, লোটন, পাউটার এবং লক্কা পায়রাদের থেকে উৎসগতভাবে স্বতন্ত্র প্রজাতিরা। সম্পূর্ণ উর্বর বংশধর উৎপাদন করে, এটা তর্কের খাতিরে স্বীকার করা চরম হঠকারিতা।
এইসব কারণগুলির কয়েকটি, যথা, পায়রাদের সাত বা আটটি কল্পিত প্রজাতির গৃহপালনাধীনে অবাধে প্রজনন করানোর ব্যাপারে মানুষের অক্ষমতা; এইসব কল্পিত প্রজাতিদের বন্যাবস্থায় অবস্থানের বিষয়টি সম্পূর্ণ অজানা এবং গৃহপালনাধীন বন্দীদশা। থেকে মুক্ত হয়ে কোথাও বন্য অবস্থায় ফিরে যাওয়া; কলাম্বিডি গোত্রের অন্য সব প্রজাতির তুলনায় এইসব প্রজাতিদের অতি অস্বাভাবিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ধারণ করা, যদিও এরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাহাড়ি পায়রাদের সদৃশ হয়; উভয়কেই যখন বিশুদ্ধ অবস্থায় রাখা হয় ও যখন সঙ্করিত হয় তখন সব জাতে নীল রঙ ও বিভিন্ন কালো দাগগুলির হঠাৎ পুনরাবির্ভাব হওয়া, এবং পরিশেষে বর্ণসঙ্কর বংশধরদের সম্পূর্ণ উর্বর হওয়া–এইসব কারণগুলোকে একত্র করে আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে আমাদের সমস্ত গৃহপালিত জাতগুলি পাহাড়ি পায়রা অথবা তার ভৌগোলিক উপ-প্রজাতি সমেত কলাম্বিয়া লিভিয়া থেকে উদ্ভূত হয়েছে।
এই মতবাদের সমর্থনে আমি আরও কিছু যোগ করতে পারি। প্রথমতঃ, বন্য। কলাম্বিয়া লিভিয়া পায়রাটি ইউরোপে ও ভারতবর্ষে পোষ মানতে সমর্থ বলে দেখা গেছে, এবং এরা স্বভাবে ও শরীরগঠনের অনেক বিষয়ে সমস্ত গৃহপালিত জাতের সঙ্গে। মিলে যায়। দ্বিতীয়তঃ, যদিও একটি ইংলিশ গিরাবাজ বা একটি ছোট মুখওয়ালা লোটন পায়রা পাহাড়ি পায়রাদের থেকে কোন কোন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে ভীষণভাবে ভিন্ন হয়, তবুও এই দুটি জাতের কয়েকটি উপজাত, বিশেষ করে দূরবর্তী দেশগুলিতে আনীত উপ-জাতগুলির তুলনা করে পাহাড়ি পায়রা ও এদের মধ্যে প্রায় নিখুঁত একটি শ্রেণী আমরা তৈরি করতে পারি; এভাবে অন্য কয়েকটি ক্ষেত্রেও, অবশ্য সব জাতগুলির ক্ষেত্রে নয়, এরূপ শ্রেণী তৈরি করতে পারি আমরা। তৃতীয়তঃ, প্রত্যেক জাতে প্রধানত স্বাতন্ত্র-নির্দেশক বৈশিষ্ট্যগুলির প্রতিটিই বিশেষভাবে পরিবর্তনশীল, যেমন গিরাবাজ পায়রার মাথার ঝুঁটি ও ঠোঁটের দৈর্ঘ্য, লোটন পায়রার ঝুঁটি ও ঠোঁটের হ্রস্বতা এবং লক্কা পায়রার লেজের পালকের সংখ্যা; নির্বাচনের বিষয়টি আলোচনার সময় এই বিষয়টি স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করা হবে। চতুর্থতঃ, অনেক মানুষ অতি যত্ন সহকারে ও মনোযোগ দিয়ে পায়রাদের পর্যবেক্ষণ ও পালন করে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে কয়েক হাজার বছর ধরে গৃহপালিত হয়েছে এরা; পায়রার সবচেয়ে পুরানো রেকর্ড হচ্ছে প্রায় ৩০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে ইজিপ্টের পঞ্চম রাজবংশের রাজত্বকালে, যেটি অধ্যাপক লেপসিয়াস আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন; কিন্তু মিঃ বাৰ্চ, আমাকে অবহিত করেছেন যে পূর্ববর্তী রাজবংশের রাজত্বকালে পায়রাদের যাতায়াতের জন্য ভাড়া দেওয়া হত। যেমন আমরা প্লিনির লেখা থেকে জানতে পারি যে রোমানদের রাজত্বের সময় পায়রাদের জন্য অর্থ ব্যয় করা হত; “শুধু তাই নয়, এটি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে এরা এদের কুলজি ও জাত বিচার করতে পারে।” ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ভারতবর্ষের আকবর খান। পায়রাদের অত্যন্ত মূল্য দিতেন, তাঁর রাজসভায় কখনও ২০০০-এর কম পায়রা রাখা হত না। “ইরান ও তুরানের সম্রাটরা তাঁকে কয়েকটি বিরল জাতের পায়রা পাঠিয়েছিলেন, এবং রাজসভার ঐতিহাসিকরা আরও বলেন, “জাতগুলির মধ্যে সঙ্করণের দ্বারা সম্রাট এদের বিস্ময়করভাবে উন্নত করেছিলেন। প্রায় একই সময়ে পায়রাদের সম্বন্ধে প্রাচীন রোমানদের মত ওলন্দাজরাও খুব আগ্রহী ছিল। পায়রাদের প্রচণ্ড পরিমাণ পরিবৃত্তি ব্যাখ্যা করতে এগুলো বিবেচনার গুরুত্ব স্পষ্টতর হবে যখন আমরা নির্বাচনের বিষয়টি আলোচনা করব। তখন আমরা এ-ও দেখব যে কেমন করে কয়েকটি জাত প্রায়শই কিছু পরিমাণ বিকৃত বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। ভিন্ন জাত সৃষ্টির পক্ষে সবচেয়ে অনুকূল অবস্থাটি হচ্ছে যাতে করে সহজেই বংশধর উৎপাদনের জন্য পুরুষ ও স্ত্রী পায়রারা মিলিত হতে পারে; এবং সেইজন্য বিভিন্ন জাতগুলোকে একত্রে একই পক্ষীশালায় রাখা যেতে পারে।
গৃহপালিত পায়রাদের সম্ভবপর উৎপত্তি সম্বন্ধে আমি কিছুটা অপর্যাপ্তভাবে আলোচনা করেছি; কারণ কেমন করে এরা সদৃশ বংশধর উৎপাদন করে তা ভালভাবে অবগত হয়ে আমি যখন প্রথম এদের পালন ও কয়েক প্রকার জাতকে পর্যবেক্ষণ করেছিলাম, তখন আমি বিশ্বাস করতে অতিশয় অসুবিধা বোধ করেছিলাম যে যেহেতু এরা গৃহপালিত হয়েছিল, সেজন্য এরা একটি সাধারণ পিতামাতা থেকে যাত্রা শুরু করেছিল, যেমন প্রাকৃতিক পরিবেশে ফিঞ্চ পাখির অনেক প্রজাতি বা অন্য গোষ্ঠীর পাখিদের সম্পর্কে যে কোন প্রকৃতিবিজ্ঞানী একই সিদ্ধান্তে পৌঁছাত। একটি ঘটনা আমাকে অতিশয় আশ্চর্যান্বিত করেছে, যথা, যাদের সঙ্গে আমি আলোচনা করেছি বা যাদের লেখা আমি পড়েছি এমন বিভিন্ন গৃহপালিত প্রাণীর প্রায় সব প্রজননকারী ও কৃষকরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে কয়েকটি জাত অনেক আদিম ভিন্ন প্রজাতি থেকে উদ্ভূত হয়েছে। যেমন, আমি যদি একজন বিখ্যাত হেরেফোর্ড গো-মহিষাদি প্রজননকারীকে জিজ্ঞাসা করি, যে তার গো-মহিষাদি লম্বা শিংওয়ালা গো-মহিষাদি থেকে বা উভয়েই সাধারণ পিতামাতা বংশ থেকে উদ্ভূত হয়েছে কিনা, তাহলে সে আপনার-আমার কথায় অবজ্ঞা সহকারে হেসে উঠবে। পায়রা বা গৃহপালিত পাখি ও হাঁস বা খরগোশ বিশেষজ্ঞদের মধ্যে আমি এমন একজনেরও সাক্ষাৎ পাইনি যিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন না যে প্রত্যেক প্রধান জাত একটি স্বতন্ত্র প্রজাতি থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। ভ্যান মন্স ন্যাসপাতি ও আপেল সম্বন্ধে তার লেখা গ্রন্থরাজিতে দেখান কত চূড়ান্তভাবে তিনি অবিশ্বাস করেন যে রিবস্টোন-পিপ্পিন ও কডলিন-আপেলের মতো কয়েক জাতের আপেল একই গাছের বীজ থেকে উৎপন্ন হয়। অন্য অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যেতে পারত। আমি মনে করি ব্যাখ্যাটি সরল : দীর্ঘদিন ধরে অনুসন্ধানের পর কয়েকটি জাতের পার্থক্যগুলো সম্পর্কে তারা দারুণভাবে প্রভাবিত হয়েছে; এবং যদিও তারা ভালভাবে পরিচিত যে প্রত্যেক জাত খুব অল্প ভিন্ন হয়, সেজন্য তারা এই অল্প পার্থক্যযুক্ত জাতগুলোকে নির্বাচন করে, পুরস্কার লাভ করে, তথাপি তারা সমস্ত সাধারণ যুক্তিগুলোকে অগ্রাহ্য করে এবং বহু বংশপরম্পরা ধরে অল্প পার্থক্যগুলো সঞ্চিত হয়েছে। এই ধারণাকে মনে স্থান দিতে অস্বীকার করে। আবার যখন প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা প্রাকৃতিক পরিবেশে একটি প্রজাতিকে অন্য প্রজাতির বংশধর হিসেবে ভাবার ধারণাকে উপহাস– করেন, তখনই এইসব প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা প্রজননকারীর তুলনায় বংশগতির নিয়মাবলী অতি অল্প ও দীর্ঘ বংশধারার মধ্যবর্তী অবস্থা সম্বন্ধে একেবারে কিছু না জানলেও স্বীকার করেন যে আমাদের গৃহপালিত জাতগুলি একই পিতামাতা থেকে উদ্ভূত হয়েছে।