পায়রাদের জাতগুলির মধ্যেকার পার্থক্যসমূহ যতই বিরাট হোক না কেন, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে প্রকৃতিবিদদের সাধারণ অভিমত নির্ভূল। যথা, পাহাড়ি পায়রাদের (কলম্বিয়া লিভিয়া) থেকেই কিছু ভৌগোলিক জাত অথবা উপপ্রজাতি সমেত সকলের উদ্ভব ঘটেছে, যারা পরস্পরের থেকে অতি তুচ্ছ কয়েকটি বিষয়ে ভিন্ন হয়। যুক্তিগুলোর কয়েকটি যা আমাকে বিশ্বাস করতে অনুপ্রাণিত করেছে ও যেগুলো অন্য ক্ষেত্রে কিছু মাত্রায় প্রযোজ্য হয়, তা আমি এখানে সংক্ষেপে উল্লেখ করব। যদি কয়েকটি জাত ভ্যারাইটি (প্রকার) না হয় এবং পাহাড়ি পায়রা থেকে উদ্ভূত না হয়ে থাকে, তাহলে এরা নিশ্চয় অন্ততঃ সাত বা আটটি আদিম বংশ (স্টক) থেকে উদ্ভূত হয়ে থাকবে, কারণ যে কোন কম সংখ্যক সঙ্করণের মাধ্যমে বর্তমান গৃহপালিত জাতগুলির। সৃষ্টি অসম্ভব : উদাহরণস্বরূপ, কোন একটি পিতামাতার বংশে বিরাট পাকস্থলী না থাকলে, কেমন করে দুটি সঙ্করণের দ্বারা একটি পাউটার পায়রা সৃষ্টি করা যেতে পারে? তথাকথিত আদিম বংশগুলো সকলে নিশ্চয় পাহাড়ি পায়রা হয়ে থাকবে, অর্থাৎ এরা বংশবৃদ্ধি করেনি বা স্বেচ্ছায় গাছে এসে বসে না। কিন্তু কয়েকটি উপপ্রজাতি সমেত কলম্বিয়া লিভিয়া ছাড়া পাহাড়ি পায়রাদের কেবল দুটি বা তিনটি প্রজাতি আছে বলে জানা গেছে এবং এদের মধ্যে গৃহপালিত জাতসমূহের কোন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য লক্ষিত হয় না। অতএব তথাকথিত আদিম বংশগুলি সেইসব দেশে এখনও নিশ্চয় আছে। যেখানে এদের প্রথমে গৃহপালিত করা হয়েছিল, তথাপি এটি পক্ষীবিশারদদের নিকট অজ্ঞাত রয়েছে; এবং এদের আকার, স্বভাব, লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্যগুলি বিবেচনা করলে মনে হয় এটি অসম্ভব; অথবা বন্যাবস্থায় এরা বিলুপ্ত হয়ে থাকবে। কিন্তু পাহাড়ের ঢালু জায়গায় ডিম পাড়তে ও ভালভাবে উড়ে পালাতে পারায় অভ্যস্ত পাখিদের নিশ্চিহ্ন হওয়া অসম্ভব, এবং ছোট ছোট কয়েকটি ব্রিটিশ দ্বীপে বা ভূমধ্যসাগরের উপকূলে গৃহপালিত জাতগুলোর স্বভাব সম্বলিত সাধারণ পাহাড়ি পায়রারা নিশ্চিহ্ন হয়নি। অতএব পাহাড়ি পায়রাদের সদৃশ স্বভাব সম্বলিত অসংখ্য প্রজাতির তথাকথিত নিশ্চিহ্ন হওয়ার বক্তব্যটি সম্ভবতঃ একটি হঠকারী সিদ্ধান্ত। এ ছাড়াও উপরোক্ত গৃহপালিত জাতগুলোর কয়েকটি পৃথিবীর সকল অংশে স্থানান্তরিত হয়েছে এবং এদের মধ্যে কয়েকটি নিশ্চয় এদের নিজের দেশেও পুনরায় স্থানান্তরিত হয়েছে; কিন্তু একটিও বন্য। অথবা অপোষ্য হয়নি, যদিও অল্প পার্থক্যযুক্ত পাহাড়ি ডোভেকট পায়রাটি কয়েকটি জায়গায় অপোষ্য হয়েছে। যাবতীয় সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা দেখায় যে বন্যপ্রাণীদের গৃহপালনাধীনে অবাধে বংশবিস্তার করানো অতিশয় কষ্টকর; তথাপি আমাদের পায়রাদের বহুবিধ উৎপত্তির প্রকল্প অনুসারে নিশ্চয় অনুমান করা উচিত যে প্রাচীনকালে অর্ধসভ্য মানুষদের দ্বারা অন্ততঃ সাত বা আটটি প্রজাতি এত সম্পূর্ণরূপে গৃহপালিত হয়েছিল যে আটক অবস্থাতেও এরা বহু সন্তান উৎপাদনক্ষম হয়েছিল।
অন্য কয়েকটি ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং অত্যন্ত জোরালো একটি যুক্তি হচ্ছে যে উপরোক্ত জাতগুলো, যদিও দেহগঠনে, স্বভাবে, কণ্ঠস্বরে, বর্ণে এবং এদের দেহের অধিকাংশ প্রত্যঙ্গে পাহাড়ি পায়রাদের সঙ্গে সাধারণভাবে সঙ্গতিপূর্ণ বা সামঞ্জস্যপূর্ণ, তথাপি অন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গে নিশ্চয় অতিমাত্রায় অস্বাভাবিক হয়; ইংলিশ গিরাবাজ অথবা। হ্রস্বমুখওয়ালা লোটন বা গোলা পায়রার ঠোঁটের মতো একটি ঠোঁট, জ্যাকোবিনদের মতো উল্টানো পালক, পাউটারের মত গলার থলি, লক্কা পায়রাদের মত লেজ পালক কলুকিম্বডির মত বিরাট গোত্রে খুঁজতে বৃথাই চেষ্টা করি আমরা। অতএব নিশ্চয় মনে করা উচিত যে অর্ধসভ্য মানুষরা কেবল কয়েকটি প্রজাতিকে গৃহপালিত করতে সমর্থ হয়নি, বরং তারা ইচ্ছাকৃত বা আকস্মিকভাবে অসাধারণ অস্বাভাবিক প্রজাতিদের বেছে নিয়েছিল; এবং আরও বলা যায় যে এইসব আসল প্রজাতিরা তখন থেকেই সকলে লুপ্ত হয়েছে অথবা অজ্ঞাত রয়েছে। এত সব অদ্ভুত অনিশ্চিত সম্ভাবনা অতিমাত্রায় অসম্ভাব্য।
পায়রাদের বর্ণ সংক্রান্ত কিছু তথ্য বিবেচনার যোগ্য। পাহাড়ি পায়রারা শ্লেট পাথরের মত নীলাভ, যার কটিদেশ শ্বেত বর্ণের; কিন্তু ভারতীয় উপপ্রজাতি স্ট্রিকল্যান্ডের কলম্বিয়া ইন্টারমিডিয়া পায়রার এই অংশটি ঈষৎ নীলাভ, লেজের শীর্ষভাগে কালো ডোরা দাগ থাকে, বাইরের পালকের নিচের দিকের ধার সাদা রঙের হয়। ডানাতে দুটি কালো ডোরা দাগ থাকে। কয়েকটি অর্ধগৃহপালিত এবং প্রকৃত বন্য জাতের দুটি কালো ডোরা দাগ ছাড়া ডানাগুলি কালো রঙের ছোপ দিয়ে নকশা কাটা। সমগ্র গোত্রের যে কোন প্রজাতিতে এইসব চিহ্ন একত্রে থাকে না। এমতাবস্থায় সম্পূর্ণরূপে বংশবৃদ্ধিপ্রাপ্তদের ধরে নিয়ে গৃহপালিত জাতসমূহের প্রত্যেকটিতে উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলি, এমনকি লেজের বাইরের পালকের সাদা ধারও কোন কোন সময় একত্রে নিখুঁতভাবে বিকশিত হয়ে ওঠে। এছাড়াও, যখন দুই বা ততোধিক ভিন্ন জাতের অন্তর্গত। পাখিরা সঙ্করিত হয়, তখন এদের কোনটাই নীল রঙের হয় না অথবা এরা উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যমূলক চিহ্নের অধিকারী হয় না, বর্ণসঙ্কর বংশধরে এইসব বৈশিষ্ট্য হঠাৎ-হঠাৎ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একটি উদাহরণের মাধ্যমে আমি যা লক্ষ্য করেছি তা হচ্ছে : কয়েকটি সাদা লক্কা পায়রার সঙ্গে, যারা অনুরূপ বংশধরের জন্ম দেয়, কয়েকটি কালো গোলা। পায়রার প্রজনন ঘটাই আমি; ফলস্বরূপ দেখা গেল যে গোলা পায়রার নীল জাতটি এত, বিরল হল যার একটিও উদাহরণ ইংল্যান্ডে আমি কখনও শুনি নি; এবং বর্ণসঙ্কররা কালো, বাদামী ও বহু বর্ণের হয়েছিল। একটি গোলা পায়রার সঙ্গে একটি ছোপ-ছোপ দাগওয়ালা পায়রার সঙ্করণ ঘটিয়েছিলাম, দাগওয়ালা সাদা পায়রাটির লেজ লাল ও কপালে লাল দাগ ছিল এবং সকলেই জানে যে এরা সদৃশ বংশধর উৎপাদন করে। বর্ণসঙ্কররা হয়েছিল ইষৎ লালচে রঙের এবং নানা বর্ণের ছোপযুক্ত। এরপর আমি গোলা-লক্কা পায়রার বর্ণসঙ্করদের একটির সঙ্গে গোলা ও ছোপ-ছোপ দাগওয়ালা পায়রার বর্ণসঙ্করদের একটির সঙ্করণ ঘটাই, এবং তার ফলে কোমর সাদা, ডানায় জোড়া কালো ডোরা দাগ ও মোটা ডোরা দাগ এবং লেজের পালকের ধারে ডোরা দাগ সম্বলিত যে কোন বন্য পাহাড়ী পায়রার মত একটি অতি সুন্দর নীল বর্ণের পাখি উৎপাদন করেছিল এরা! যদি সমস্ত গৃহপালিত জাতগুলি পাহাড়ি পায়রা থেকে উদ্ভূত হয়ে থাকে, তাহলে পৈতৃক বৈশিষ্ট্যে প্রত্যাবর্তনের সুপরিচিত নীতির ওপর ভিত্তি করে আমরা এ সব বিষয় বুঝতে পারি। কিন্তু যদি আমরা এটি অস্বীকার করি, তাহলে নিচের দুটি অসম্ভব কল্পনা আমাদের অবশ্যই করতে হবে। প্রথমতঃ হয় সমস্ত কল্পিত আদিম বংশগুলো পাহাড়ি পায়রার মত বর্ণময় ও ছোপচিহ্নিত ছিল, যদিও বর্তমানের কোন প্রজাতি এইরূপ বর্ণময় ও চিহ্নিত নয়, যাতে করে প্রত্যেক পৃথক জাতে সেই একই বর্ণ ও চিহ্নের প্রত্যাবর্তনের প্রবণতা থাকতে পারত। দ্বিতীয়তঃ, নয়তো বিশুদ্ধতম জাতটি সমেত প্রত্যেক জাত বারো অথবা অন্ততঃ এক কুড়ি বংশের মধ্যে এমন একটিও বংশের উদাহরণ জানা নেই যেখানে সঙ্করিত বংশধররা বেশি সংখ্যক বংশ বাদ দিয়ে অনাত্মীয় রক্তের পূর্বপুরুষে প্রত্যাবর্তন করেছে। কেবলমাত্র একবার সঙ্করিত হওয়া জাতে এই সঙ্করণের ফলে উদ্ভূত যে কোন বৈশিষ্ট্যে প্রত্যাবর্তনের প্রবণতা স্বভাবতই অল্প থেকে অল্পতর হবে, কারণ প্রত্যেক পরবর্তী বংশে অনাত্মীয় (বিদেশি) রক্ত কমতে থাকবে; কিন্তু যখন কোন সঙ্করণ হয় না এবং একটি জাতে পূর্বের কোন কোন বংশে লুপ্ত হওয়া একটি বৈশিষ্ট্যে প্রত্যাবর্তনের প্রবণতা থাকে, তখন আমরা দেখি অনির্দিষ্ট সংখ্যক বংশ ধরে এই প্রবণতা অপরিবর্তিতভাবে পরিবাহিত হতে পারে। প্রত্যাবর্তনের এই দুটি ভিন্ন ঘটনা প্রায়শই তারা একত্রে মিশিয়ে ফেলেন, যাঁরা বংশগতি সম্বন্ধে লিখেছেন।