অনেকে মনে করেন যে মানুষ গৃহপালনের জন্য এমন সব প্রাণী ও উদ্ভিদ নির্বাচন করে যাদের পরিবর্তনের জন্যে সহজাত প্রবণতা রয়েছে এবং যারা বিচিত্র জলবায়ু সহ্য করতে সমর্থ। আমি ভিন্নমত পোষণ করি না যে এই সামর্থগুলো আমাদের অধিকাংশ গৃহপালিত উৎপাদনে ব্যাপকভাবে সাহায্য করেছে। কিন্তু যখন একজন বন্য মানুষ একটি প্রাণীকে প্রথম পোষ মানিয়েছিল, তখন কেমন করে সে জানত সেটি পরবর্তী বংশপরম্পরায় পরিবর্তিত হবে কিনা এবং অন্য জলবায়ু সহ্য করতে পারবে কিনা? গাধা ও রাজহাঁসের অল্প পরিবৃত্তি অথবা বন্না হরিণের গরম সহ্য করার বা সাধারণ উটের ঠাণ্ডা সহ্য করার অল্প ক্ষমতা এদের গৃহপালনে বাধা সৃষ্টি করেছে কি? আমি সন্দেহ পোষণ করি না যে যদি আমাদের গৃহপালিত উৎপাদনগুলোর সমান সংখ্যায় এবং সমভাবে বিভিন্ন শ্রেণী ও দেশের অন্তর্গত অন্য প্রাণী ও উদ্ভিদদের প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে গ্রহণ করা হত এবং গৃহপালনাধীন অবস্থায় এরা সমসংখ্যক বংশপরম্পরায় বংশবিস্তার করত, তাহলে এরা বর্তমানে গৃহপালিত জাতগুলোর পিতামাতা প্রজাতিদের মতো গড়ে একইরূপে পরিবর্তিত হত।
আমাদের সবচেয়ে প্রাচীন গৃহপালিত প্রাণী ও উদ্ভিদের অধিকাংশের প্রসঙ্গে বলা যায় যে এরা এক বা কয়েকটি বন্য প্রজাতি থেকে উদ্ভূত হয়েছে কিনা, সে ব্যাপারে কোন নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে আসা অসম্ভব। গৃহপালিত প্রাণীদের বহুবিধ উৎপত্তিতে বিশ্বাসী লোকেদের প্রধান যুক্তি হচ্ছে যে ইজিপ্টের স্মৃতিসৌধে এবং সুইজারল্যান্ডের অধিবাসীদের মধ্যে অতি প্রাচীনকালের জাতগুলোর ক্ষেত্রে বিপুল বিভিন্নতা লক্ষ্য করি আমরা, এবং প্রাচীন জাতগুলোর কয়েকটি বর্তমান জাতগুলোর সদৃশ বা এমনকি সমরূপ হয়। কিন্তু এটি সভ্যতার ইতিহাসকে অনেক পিছনে টেনে নিয়ে যায় এবং আজ পর্যন্ত যা মনে করা হয় তার চেয়ে বহু পূর্বেই প্রাণীদের গৃহপালিত করা হয়েছিল। সুইজারল্যান্ডের হ্রদ অধিবাসীরা কয়েক ধরনের গম এবং বার্লি, ছোলা, তেলের জন্য আফিম ও তিসির চাষ করত এবং কয়েকটি প্রাণীকেও পোষ মানিয়েছিল। অন্য দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যও করত তারা। হিয়ারের মন্তব্যানুসারে এ সব তথ্য স্পষ্ট করে দেখায় যে এরা সভ্যতার গোড়ার দিকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটিয়েছিল; এবং এটি আবার কম উন্নত সভ্যতার পূর্ববর্তী দীর্ঘস্থায়ী পর্যায়ের ইঙ্গিত দেয়, যখন বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন গোষ্ঠীর পোষ মানানো গৃহপালিত প্রাণীরা পরিবর্তিত হয়ে থাকবে এবং স্বতন্ত্র জাত উদ্ভূত হয়ে থাকবে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ভূপৃষ্ঠে চকমকি পাথরের হাতিয়ার আবিষ্কার থেকে সব ভূবিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে বহু বহু বছর পূর্বে বর্বর মানুষরা বসবাস করত; এবং আমরা জানি যে অন্তত কুকুরকে পোষ মানাতে পারে না এ-রকম বর্বর গোষ্ঠী বর্তমানে একটিও নেই।
আমাদের অধিকাংশ গৃহপালিত প্রাণীদের উৎপত্তির বিষয়টি চিরকালের মত অস্পষ্ট থাকবে। সারা পৃথিবীর গৃহপালিত কুকুরদের লক্ষ্য করে আমি কিন্তু এখানে বলতে পারি যে সমস্ত জানা তথ্য কঠোর পরিশ্রম সহকারে সংগ্রহ করে আমি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে কুকুর গোত্রের বন্য প্রজাতিকে পোষ মানানো হয়েছে এবং এদের রক্ত কয়েকটি ক্ষেত্রে একত্রে মিশ্রিত হয়ে আমাদের গৃহপালিত জাতগুলোর শিরায় প্রবাহিত হয়ে আসছে। ভেড়া ও ছাগলের ক্ষেত্রে আমি কোন স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি। কুঁজওয়ালা। ভারতীয় গবাদি পশুদের স্বভাব, কণ্ঠস্বর, দেহগঠন ও অবয়ব সম্বন্ধে মিঃ ব্লিথ প্রেরিত তথ্যসমূহ থেকে নিশ্চিতরূপে বলা যায় যে এরা আমাদের ইউরোপিয় গবাদি পশুদের থেকে ভিন্ন একটি আদিম কুল (বংশ) থেকে উদ্ভূত হয়েছে, এবং কয়েকজন দক্ষ বিচারক বিশ্বাস করেন যে ইউরোপিয় গবাদি পশুদের দুটি বা তিনটি বন্য পূর্বপুরুষ ছিল–এদের প্রজাতি হিসাবে গণ্য করা যুক্তিযুক্ত হবে কিনা তা পরের কথা। এই সিদ্ধান্তটি এবং কুঁজওয়ালা ও সাধারণ গবাদি পশুদের বিশেষ পার্থক্যের বিষয়টি অধ্যাপক রুটিমেয়ারের প্রশংনীয় গবেষণামূলক কাজের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। ঘোড়াদের ক্ষেত্রে, কয়েকজন বিশেষজ্ঞের মতামতের বিরুদ্ধে, আমি মনে করি সমস্ত জাত একই প্রজাতির অন্তর্গত, যার কারণগুলো আমি এখানে দিতে পারছি না। মুরগীদের প্রায় সমস্ত ইংলিশ জাতগুলোকে জীবিত রেখে, এদের প্রজনন করে সঙ্করণ ঘটিয়ে এবং এদের কঙ্কাল পরীক্ষা করে আমার কাছে স্পষ্টতঃ প্রতীয়মান হয়েছে যে গ্যালাস ব্যাঙ্কিভা নামক ভারতীয় বন্য মুরগী থেকেই এরা উদ্ভূত হয়েছে; এবং মিঃ ব্লিথ ও অন্য যাঁরা এই পাখিটি সম্পর্কে অনুসন্ধান করেছেন, এটা তাদেরই সিদ্ধান্ত। পাতিহাঁস ও খরগোশদের ক্ষেত্রে, যাদের কয়েকটি জাত পরস্পরের থেকে ভীষণভাবে ভিন্ন হয়, সাক্ষ্য প্রমাণাদি থেকে এটা পরিষ্কার যে এরা সকলে সাধারণ বন্য পাতিহাঁস এবং খরগোশ থেকেই উদ্ভূত হয়েছে।
কয়েকটি আদিম বংশ (কুল) থেকে কয়েকটি গৃহপালিত জাতের উৎপত্তি তত্ত্বকে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ অযৌক্তিক সীমায় নিয়ে গিয়েছেন। তারা বিশ্বাস করেন যে প্রত্যেক জাতের, যারা অকৃত্রিম বংশধর উৎপাদন করে এবং যাদের পার্থক্যমূলক বৈশিষ্ট্য যতই অল্প হোক না কেন, বন্য আদিরূপ ছিল। এই অনুপাতে কেবলমাত্র ইউরোপেই কম করেও এক কুড়ি বন্য গবাদি পশুর প্রজাতি, সমসংখ্যক ভেড়া, কিছু ছাগল নিশ্চয়ই থেকে থাকবে, এমনকি গ্রেট ব্রিটেনেও কয়েকটি। একজন বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করেন যে। কেবল গ্রেট ব্রিটেনেই পূর্বে ভেড়ার এগারটি বন্য প্রজাতি ছিল! আমরা যখন স্মরণে রাখি যে এখন গ্রেট ব্রিটেনের নিজস্ব কোন স্তন্যপায়ী প্রাণী নেই, এবং জার্মানির তুলনায় স্বতন্ত্র কয়েকটি ফ্রান্সে এবং এরূপে হাঙ্গেরি, স্পেন প্রভৃতি দেশেও নেই, তথাপি এসব দেশগুলোর প্রত্যেকটিতে গবাদি পশু, ভেড়া প্রভৃতির কয়েকটি নিজস্ব জাত রয়েছে, তখন আমাদের নিশ্চয় স্বীকার করা উচিত যে সারা ইউরোপে অনেক গৃহপালিত জাত উদ্ভূত হয়ে থাকবে, কারণ তা না হলে কোথা থেকে উদ্ভূত হয়েছে এরা? ভারতবর্ষের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এমন কি সারা পৃথিবীর গৃহপালিত কুকুরদের জাতগুলোর ক্ষেত্রে–আমি স্বীকার করি যে এরা কয়েকটি বন্য প্রজাতি থেকে উদ্ভূত হয়েছে– নিঃসন্দেহে বলা যায় যে এদের মধ্যে বিরাট পরিমাণে বংশগত পরিবর্তন ঘটেছে; কারণ কে বিশ্বাস করবে যে ইতালির গ্ৰেহাউণ্ড, ব্লাডহাউণ্ড, বুলডগ, পাগ-ডগ বা ব্লেনহিম স্প্যানিয়েল প্রভৃতি ঘনিষ্ঠভাবে সদৃশ প্রাণীরা, যারা সমস্ত বন্য কুকুর গোত্রীয়দের থেকে এত পৃথক, তারা কখনও প্রাকৃতিক পরিবেশে বর্তমান ছিল? প্রায়শই হালকাভাবে বলা হয় যে কয়েকটি আদিম প্রজাতির মধ্যে সঙ্করণের মাধ্যমে কুকুরদের সমস্ত জাতের উদ্ভব ঘটেছে। কিন্তু সঙ্করণ প্রক্রিয়া দ্বারা এদের পিতামাতাদের কেবলমাত্র কিছু মাত্রায় মধ্যবর্তী আকারই পেতে পারি আমরা; এবং এই পদ্ধতির দ্বারা আমরা যদি আমাদের গৃহপালিত জাতগুলো সম্বন্ধে বিচার-বিবেচনা করি, তাহলে ইতালির গ্ৰেহাউণ্ড, ব্লাডহাউণ্ড, বুলডগ ইত্যাদির অতিশয় চরম আকারদের বন্যাবস্থায় পূর্ব অবস্থান আমাদের। অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। অধিকন্তু সঙ্করণ প্রক্রিয়ার দ্বারা স্বতন্ত্র জাত সৃষ্টির সম্ভাবনার বিষয়টিকে অতিরঞ্জিত করা হয়েছে। অনেক লিপিবদ্ধ ঘটনা থেকে জানা যায় যে আকাঙ্খিত বৈশিষ্ট্য সমেত এককদের যত্নসহকারে নির্বাচন করা হলে আকস্মিক সঙ্করণ পদ্ধতির দ্বারা একটি জাত রূপান্তরিত হতে পারে, কিন্তু দুটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। জাতের মধ্যবর্তী একটি জাতের উদ্ভব ঘটানো অত্যন্ত কষ্টকর। স্যার জে. সেবরাইট এই উদ্দেশ্যে বিষয়টি নিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন এবং ব্যর্থ হয়েছিলেন। দুটি বিশুদ্ধ জাতের মধ্যে প্রথম সঙ্করণ থেকে উৎপন্ন বংশধররা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে সহনীয় ও কোন কোন সময় (যেমন আমি পায়রাদের ক্ষেত্রে দেখেছি) সম্পূর্ণ একইরূপ হয়, এবং এর থেকে মনে হয় সবকিছুই যথেষ্ট সরল; কিন্তু যখন কয়েক বংশ ধরে এই বর্ণসঙ্কররা পরস্পরের সঙ্গে সঙ্করিত হয়, তখন কদাচিৎ এদের দুটি হুবহু একই রকম হয়, এবং তখন করণীয় কাজের অসুবিধাটি স্পষ্টতঃ প্রতীয়মান হয়।