পরিবর্তিত পরিবেশের অপ্রত্যক্ষ প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমি যা বলেছি অর্থাৎ জননতন্ত্র প্রভাবিত হওয়ার মধ্য দিয়ে, তা থেকে আমরা অনুমান করতে পারি যে অংশতঃ প্রকারণ এভাবে ঘটে, অংশতঃ পরিবেশের যে কোন পরিবর্তনে এই তন্ত্রের অতি সংবেদনশাল হওয়া থেকে এবং অংশতঃ, যেমন কোয়েলরয়টার ও অন্যরা বলেছেন, প্রকারণের মধ্যে সদৃশতা থেকে, যা স্বতন্ত্র প্রজাতির সঙ্করণের ফলে ঘটে এবং নতুন বা অস্বাভাবিক পরিবেশে লালিত-পালিত উদ্ভিদ ও প্রাণীদের ক্ষেত্রে যা দেখা যেতে পারে। অনেক তথ্য স্পষ্ট করে দেখায় পারিপার্শ্বিক পরিবেশের অতি অল্প পরিবর্তনে জননতন্ত্র কত বিপুলভাবে সংবেদনশীল হয়। একটি প্রাণীকে পোষ মানানোর থেকে সোজা আর কিছুই নয় এবং আটক অবস্থায় অবাবে সন্তান উৎপাদন করানোর থেকে কঠিন আর কিছুই নয়, এমনকি যখন স্ত্রী-পুরুষ মিলিত হয় তখনও। স্বদেশে মুক্তাবস্থায় রাখা সত্ত্বেও বহু সংখ্যক প্রাণী আছে যারা সন্তানসন্ততি উৎপাদন করতে পারে না! এটিকে সাধারণতঃ, কিন্তু ভুলবশতঃ, ত্রুটিপূর্ণ সহজাত প্রবৃত্তির ওপর আরোপ করা হয়। অনেক আবাদী উদ্ভিদ অত্যন্ত তেজিয়ান হয় এবং তথাপি বিরলভাবে অথবা কখনওই বীজ উৎপাদন করে বা করে না। কয়েকটি ক্ষেত্রে আবিষ্কৃত হয়েছে যে অতি তুচ্ছ পরিবর্তন, যেমন ধরুন বৃদ্ধির কোন বিশেষ সময়ে অল্প বা বেশি জল, একটি উদ্ভিদে বীজ হবে কি হবে না তা নির্ধারণ করে। এই অদ্ভুত বিষয়টি সম্পর্কে আমি যা তথ্য সংগ্রহ করেছি। এবং অন্যত্র প্রকাশ করেছি, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ এখানে দিতে পারছি না; কিন্তু যে নিয়মগুলো আটক অবস্থায় প্রাণীদের প্রজনন নির্ধারণ করে, সেগুলোর অনন্যতা দেখানোর জন্য আমি উল্লেখ করতে পারি যে এমন কি ক্রান্তীয় অঞ্চল থেকে আনীত মাংসাশী প্রাণীরাও এই দেশে আটক অবস্থায় মোটামুটি অবাধেই সন্তান উৎপাদন করে, কেবল প্ল্যান্টিগ্রেড অথবা ভল্লুক গোত্র ছাড়া যারা কদাচিৎ সন্তান উৎপাদন করে; পক্ষান্তরে, বিরলতম ব্যতিক্রম ছাড়া মাংসাশী পাখিরা কদাচিৎ উর্বর ডিম পাড়ে। এই অবস্থায় অতিশয় বন্ধ্যা সঙ্করগুলোর মত অনেক বিদেশি উদ্ভিদের পরাগরেণু নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর হয়। একদিকে আমরা দেখি গৃহপালিত প্রাণী ও উদ্ভিদরা দুর্বল ও অসুস্থ হলেও আটক অবস্থায় অবাধে সন্তান উৎপাদন করে, অন্যদিকে আমরা দেখি প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে সংগৃহীত শাবকের এককগুলোকে সঠিকভাবে পোষ মানানো গেলে তারা দীর্ঘায়ু ও স্বাস্থ্যবান হয় (যার অসংখ্য উদাহরণ আমি দিতে পারি), তথাপি এদের জননতন্ত্র কোন অজ্ঞাত কারণের দ্বারা এত গুরুতরভাবে প্রভাবিত হয় যে এটি কাজ করতে ব্যর্থ হয়। এই কার্যপদ্ধতিতে আমাদের বিস্মিত হওয়ার প্রয়োজন নেই, কারণ এটি অনিয়মিতভাবে কাজ করে এবং এদের পিতামাতার কিছু ভিন্ন প্রকৃতির বংশধর উৎপাদন করে, আটক অবস্থায় কার্য সম্পাদন করে। আমি আরও বলতে পারি, যেহেতু কিছু জীবের অস্বাভাবিক অবস্থায় (যেমন খরগোশ ও খাঁচায় রাখা নকুল জাতীয় প্রাণী) অবাধে সন্তান উৎপাদন করার দ্বারা বোঝা যায় যে এদের জননাঙ্গ সহজে প্রভাবিত হয়, সেহেতু কিছু প্রাণী ও উদ্ভিদ গৃহপালন অথবা চাষকরণ প্রতিরোধ করবে এবং অতি অল্প পরিবর্তিত হবে–বোধ হয় প্রাকৃতিক অবস্থার তুলনায় কদাচিৎ বেশি।
কিছু প্রকৃতিবিজ্ঞানী বলেছেন যে সব প্রকারণই যৌন জনন-প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু এটা অবশ্যই ভুল, কারণ অন্য একটি গবেষণামূলক কাজে আমি বাগানের মালীদের দেওয়া নাম ‘কৌতুককর উদ্ভিদের’ একটি দীর্ঘ তালিকা দিয়েছি; অর্থাৎ সেইসব উদ্ভিদ যেখানে একই গাছে অন্য কুঁড়ির তুলনায় একটি নতুন ও ব্যাপকভাবে পৃথক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ভিন্ন কুঁড়ি সহসা জন্মায়। জোড় কলম, শাখা কলম ইত্যাদি এবং কোন কোন সময় বীজের দ্বারা এইসব পরিবৃত্তির বংশবিস্তার ঘটানো যেতে পারে এবং এদের ভিন্ন ভিন্ন নাম রাখা যেতে পারে–যা প্রাকৃতিক পরিবেশে কদাচিৎ ঘটে, কিন্তু চাষের ক্ষেত্রে এটি বিরল নয়। একই পরিবেশে একই গাছে বছরের পর বছর জন্মানো কয়েক হাজার কুঁড়ির মধ্যে একটি ভিন্ন কুঁড়ি হঠাৎ নতুন বৈশিষ্ট্য ধারণ করে এবং ভিন্ন পরিবেশে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত গাছের কুঁড়িগুলো কোন কোন সময় একই ভ্যারাইটি উৎপাদন করে–যেমন, পীচ গাছের মধু-উৎপাদনকারী কুঁড়ি এবং মস-গোলাপ উৎপাদনকারী সাধারণ গোলাপের কুঁড়িরা। এইসব ক্ষেত্রে আমরা স্পষ্টভাবে দেখি যে প্রত্যেক বিশেষ ধরনের পরিবৃত্তি নির্ধারণ করতে জীবটির বৈশিষ্ট্যের তুলনায় পরিবেশের বৈশিষ্ট্য গৌণ মূল্যের হয়; বোধ হয় যার দ্বারা দাহ্যবস্তু প্রজ্জ্বলিত হয় সেই স্ফুলিঙ্গের বৈশিষ্ট্যের তুলনায় শিখার বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয় না।
স্বভাবের প্রভাব এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ব্যবহার অথবা অব্যবহারের
ফলাফল; পরস্পর সম্পর্কযুক্ত পরিবৃত্তি; বংশানুসৃতি
এক আবহাওয়া থেকে অন্য আবহাওয়ায় পরিবাহিত উদ্ভিদদের ফুল ফোঁটার ক্ষেত্রে যেমন হয়, পরিবর্তিত স্বভাব বংশানুক্রমিক ফলাফল সৃষ্টি করে। প্রাণীদের ক্ষেত্রে প্রত্যঙ্গগুলোর বেশি বেশি ব্যবহার বা অব্যবহারের আরও উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে। বন্য পাতিহাঁসের একই হাড়গুলোর তুলনায় সমগ্র কঙ্কালের অনুপাতে ডানার হাড় কম ওজনের হয় এবং পায়ের হাড়গুলোর ওজন বেশি হয়, এটা আমি গৃহপালিত পাতিহাঁসের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করেছি। বন্য পিতামাতার তুলনায় গৃহপালিত হাঁসরা অতি অল্প ওড়ে এবং বেশি হেঁটে বেড়ায়, তার ফলেই এই পরিবর্তন। অন্য দেশে গরু ও ছাগলের বাঁট-স্তনের তুলনায় নিয়মিত দুগ্ধদোহন করা হয় এমন দেশের গরু ও ছাগলের বাঁট স্তনের বিরাট ও বংশানুক্রমিক বিকাশ অনেক বেশি, যা সম্ভবতঃ ব্যবহারের ফলাফলের আর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আমাদের দেশের গৃহপালিত প্রাণীদের মধ্যে একটিরও নাম করা যেতে পারে না, অন্য কোন দেশে যাদের ঝুলন্ত কান নেই। কানের মাংসপেশী অব্যবহারের জন্যই কান ঝুলন্ত হয়, কারণ এই প্রাণীদের সতর্ক হওয়ার তেমন প্রয়োজন হয় না–এই মতটি যুক্তিসঙ্গত বলেই মনে হয়।