প্রজাতি ও ভ্যারাইটিদের উৎপত্তি সম্বন্ধে এমন অনেক কিছুই অব্যাখ্যাত রয়েছে যে তার জন্য কারুর আশ্চর্যান্বিত হওয়া উচিত হবে না, যদি তিনি আমাদের চতুষ্পার্শ্বের জীবদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক সম্বন্ধে আমাদের গভীর অজ্ঞতা স্বীকার করেন। কেন। একটি প্রজাতি অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত ও সংখ্যাধিক হয়, এবং কেন সম্বন্ধযুক্ত অন্য প্রজাতির বিস্তার সংকীর্ণ ও বিরল হয়, কে তা ব্যাখ্যা করতে পারে? তথাপি এই সম্পর্কগুলো অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আমার বিশ্বাস এই পৃথিবীর প্রত্যেক অধিবাসীর বর্তমান কল্যাণ ও ভবিষ্যৎ সাফল্য এবং তার রূপান্তর এরাই নির্ধারণ করে। পৃথিবীর ইতিহাসে বিগত বহু ভূতাত্ত্বিক যুগের সময় এই গ্রহে বসবাসকারী অসংখ্য অধিবাসীদের পারস্পরিক সম্পর্ক সম্বন্ধে এখনও আমরা যথেষ্ট কম জানি। যদিও অনেক কিছুই অস্পষ্ট রয়েছে এবং দীর্ঘদিন অস্পষ্ট থাকবে, তবু সবিশেষ অনুশীলন এবং পক্ষপাতহীন বিচার-বিশ্লেষণের পর আমি এই মত পোষণ করতে পারি যে মতবাদটি, যা সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত অধিকাংশ প্রকৃতিবিজ্ঞানী পোষণ করেন এবং যা আমি পূর্বে পোষণ করতাম–যথা, প্রত্যেক প্রজাতি স্বাধীনভাবে সৃষ্ট হয়েছে–তা ভ্রমাত্মক। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে প্রজাতিরা অপরিবর্তনশীল নয়; আরও বিশ্বাস করি যে একই গণের অন্তর্গত প্রজাতিরা অন্য কোন এবং সাধারণতঃ বিলুপ্ত প্রজাতির বংশধর, একইভাবে যে কোন একটি প্রজাতির স্বীকৃত ভ্যারাইটিরা ঐ প্রজাতিটির বংশধর। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি প্রাকৃতিক নির্বাচনই হচ্ছে রূপান্তরের পদ্ধতিসমূহের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু একমাত্র পদ্ধতি নয়।
————-
১। অ্যারিস্টটল তার ‘Physicae Auscultationes (lib2.cap.8.s.2) গ্রন্থে শস্য ফলবার জন্য বৃষ্টি হয় না, এই মন্তব্য করে জীবের ক্ষেত্রে একই যুক্তি প্রয়োগ করেন; এবং বলেন (যেমন মিঃ ব্লেয়ার গ্রেসে অনুবাদ করেছিলেন, এবং যিনি রচনাংশটি সম্পর্কে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন), “প্রকৃতিতে (শরীরের) বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ গুলির আকস্মিক সম্পর্ক থাকার বাধা কোথায়? যেমন দাঁতগুলি প্রয়োজনের জন্য বিকশিত হয়, সামনেরগুলি তীক্ষ্ণ ও ছেদনের জন্য অভিযোজিত এবং পেষকগুলি চেপ্টা ও খাবার চেবানোর উপযোগী; এই সব কাজের জন্য এদের সৃষ্টি হয়নি, বরং এটা দৈবক্রমে ঘটেছিল। অন্য প্রত্যঙ্গগুলি সম্পর্কেও এই নিয়ম প্রযোজ্য, এবং পরিশেষে অভিযোজনের অস্তিত্ব আছে বলে মনে হয়। যে কোন স্থানেই হোক না কেন, সমস্ত জিনিসগুলি (একটি সমগ্রের বিভিন্ন অংশগুলি) একত্রে ঘটেছিল যেন এরা কোন কিছুর জন্য সৃষ্টি হয়েছিল, আভ্যন্তরীণ স্বতঃপ্রবৃত্ততার দ্বারা যথোচিতভাবে স্থাপিত হয়ে এগুলি সংরক্ষিত হয়েছিল; এবং যেকোন স্থানেই হোক না কেন, জিনিসগুলি এইরূপে স্থাপিত না হওয়ার জন্য ধ্বংস হয়ে গেছে এবং হচ্ছে।” এখানে প্রাকৃতিক নির্বাচন সূত্রটি অদৃশ্যভাবে অনুসৃত হয়েছিল দেখেছি। হাতের গঠনের ওপর তার মন্তব্য থেকে এই বিষয়ে অ্যারিস্টটলের ধারণা কত সীমিত ছিল তা বোঝা যায়।
২। ইসিডোর জিওফ্রয় সেন্ট-হিলারের (হিস্ট্রি ন্যাচ, জেনারালে’, খণ্ড ২, পৃঃ ৪০৫, ১৮৫৯) এই বিষয়ের ওপর মতবাদগুলির চমৎকার ইতিহাস থেকে আমি নামাৰ্কের রচনার প্রথম প্রকাশের তারিখটি গ্রহণ করেছি। এই বিষয়ের ওপর বুফনের সিদ্ধান্তসমূহের একটি পূর্ণ তালিকা এই গ্রন্থে দেওয়া হয়েছে। এটি কৌতূহলোদ্দীপক যে কেমন করে আমার পিতামহ ডঃ ইরাসমাস ডারউইন ১৭৯৪ সালে প্রকাশিত তাঁর বই ‘জুনোমিয়া’ (খণ্ড ১, পৃঃ ৫০০-৫১০)-তে লামার্কের দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিমতসমূহের ভ্রমাতৃক যুক্তিগুলি পূর্বেই বহুলাংশে উপলব্ধি করেছিলেন। ইসিডোর জিওফ্রয়-এর মতানুসারে, গেটে নিঃসন্দেহে অনুরূপ দৃষ্টিভঙ্গির অতিশয় অনুগামী ছিলেন, যেমনটা ১৭৯৪ ও ১৭৯৫ সালে লিখিত কিন্তু দীর্ঘদিন পর্যন্ত অপ্রকাশিত, তার বই এর ভূমিকায় দেখা যায়। তিনি স্পষ্টভাবে মন্তব্য করেছেন (গেটে আলস্ নেচারফস্টার, ভন ডঃ কার্ল মেডিং, এস ৩৪) যে প্রকৃতিবিদদের কাছে ভবিষ্যতের প্রশ্নটি হবে, উদাহরণস্বরূপ, কেমন করে গো-মহিষাদিরা তাদের শিঙের অধিকারী হয়, কীভাবে তা ব্যহহৃত হয় সে প্রশ্ন নয়। এটি বরং একটি উপায়ের উৎকৃষ্ট উদাহরণ যাতে অনুরূপ মতবাদ প্রায় একই সময়ে উদ্ভব হয়, যে জার্মানিতে গেটে, ইংল্যান্ডে ডঃ ডারউইন এবং ফ্রান্সে জিওফ্রয় সেন্ট-হিলারে (যেমন আমরা এখন দেখব) প্রজাতির উৎপত্তি সম্পর্কে ১৭৯৪-১৭৯৫ সালে একই সিদ্ধান্তে উপনীত হন।
৩। ব্রনের ‘আন্টারসূচন জেন ইউবার ডাই এণ্টউকেলাঙ্গস-গেজেটজে উল্লেখ থেকে প্রতীয়মান হয় যে প্রসিদ্ধ উদ্ভিদবিজ্ঞানী ও জীবাশ্মবিদ উনগার ১৮৫২ সালে বলেছিলেন যে প্রজাতিরা ক্ৰমবিকশিত ও রূপান্তরিত হয়। এইরূপে ডাল্টন, জীবাশ্ম শ্লথের উপর প্যাণ্ডার এবং ডাল্টনের ১৮২১ সালে প্রকাশিত গ্রন্থে একটি বিশ্বাস উপস্থাপিত হয়েছিল। সকলেই জানেন, ওকেন তার রহস্যময় ‘নেচার ফিলসফি’ গ্রন্থে একই মত ব্যক্ত করেছিলেন, গড্রনের সুর এল’ এসপেসে’ গ্রন্থের উল্লেখ থেকে মনে হয় রবিসেণ্ট ভিনসেন্ট, বুড্যাক, পয়রেট এবং ফ্রাইস সকলেই স্বীকার করেছেন যে নূতন প্রজাতি অনবরত সৃষ্টি হচ্ছে। আমি যোগ করতে পারি যে এই ঐতিহাসিক রূপরেখায় উল্লিখিত ৩৪ জন লেখকের মধ্যে, যাঁরা প্রজাতির রূপান্তরে বিশ্বাস করেন বা অন্ততঃ সৃষ্টির পৃথক প্রক্রিয়া অবিশ্বাস করেন, ২৭ জন প্রাকৃতিক ইতিহাস অথবা ভূবিদ্যার বিশেষ শাখাগুলির উপর লিখেছেন।
০১. গৃহপালনাধীনে পরিবৃত্তি
প্রথম অধ্যায় – গৃহপালনাধীনে পরিবৃত্তি