আমি অতিশয় দুঃখিত যে, যে সমস্ত প্রকৃতিবিদের কাছ থেকে উদার সাহায্য লাভ করেছি স্থানাভাবে তাদের কাছে আমার ঋণস্বীকার সম্ভব হচ্ছে না, এঁদের মধ্যে কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে আমার অপরিচিত। ডঃ হুঁকার, যিনি গত পঞ্চাশ বছর ধরে তার অগাধ জ্ঞানভাণ্ডার ও অপূর্ব বিচারশক্তির দ্বারা আমাকে সর্ববিধ সাহায্য করেছেন, তাঁর প্রতি আমার গভীর কৃতজ্ঞতা স্বীকারের এই সুযোগ আমি হারাতে পারি না।
প্রজাতির উৎপত্তি সম্বন্ধে সবকিছু বিবেচনা করে, এটি সম্পূর্ণ বোধগম্য হয় যে একজন প্রকৃতিবিজ্ঞানী জীবদের পারস্পরিক সম্বন্ধ, ভূণ সম্বন্ধীয় সম্পর্ক, তাদের ভূ বিস্তারণ, ভূতাত্ত্বিক পর্যায় এবং অন্য সব তথ্য বিবেচনা করে সিদ্ধান্তে আসতে পারতেন যে প্রজাতিরা স্বাধীনভাবে সৃষ্টি হয় নি, বরং ভ্যারাইটিদের মতো অন্য প্রজাতি থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। তা সত্ত্বেও এরূপ একটি সিদ্ধান্ত সুপ্রতিষ্ঠিত হলেও অসন্তোষজনক হবে যতক্ষণ পর্যন্ত না দেখানো যায় যে এই পৃথিবীতে বসবাসকারী অসংখ্য প্রজাতি রূপান্তরিত হয়ে থাকবে, এটি অর্জন করার জন্য যে গঠনের উৎকর্ষতা এবং সহ অভিযোজন প্রয়োজন তা সঙ্গতভাবেই আমাদের বিস্ময় উদ্রেক করে। প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা অনবরত পারিপার্শ্বিক পরিবেশের কথা উল্লেখ করেন, যথা আবহাওয়া, খাদ্য ইত্যাদি যেগুলি পরিবৃত্তির সম্ভাব্য একমাত্র কারণ। একটি সীমিত অর্থে যা আমরা এখন থেকে পর্যবেক্ষণ করব তা সত্য হতে পারে; কিন্তু, উদাহরণস্বরূপ, গাছের ছালে পোকামাকড় ধরার জন্য পায়ের পাতা, লেজ, ঠোঁট ও জিভ সমেত কাঠঠোকরার দেহগঠন এত সুন্দরভাবে অভিযোজিত যে তার কারণ কেবলমাত্র পারিপার্শ্বিক অবস্থায় আরোপ করা ভ্রমাত্মক হবে। মিলটো পরাশ্রয়ী গুল্মগাছের ক্ষেত্রে, যা অন্য গাছের থেকে পুষ্টি সংগ্রহ করে, তার একটি ফুল থেকে অন্য ফুলে পরাগ বহন করার জন্য কোন কোন পতঙ্গ কে মাধ্যম হিসাবে অবশ্যই প্রয়োজন হয়; পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রভাবের দ্বারা, বা স্বভাবের, বা উদ্ভিদের ইচ্ছাশক্তির দ্বারা কয়েকটি স্বতন্ত্র জীবের সম্পর্ক সমেত এই পরজীবীর দেহগঠনকে বিচার করা একইরকম ভ্রমাত্মক।
অতএব রূপান্তরের উপায়গুলি এবং সহ-অভিযোজনের মর্ম উপলব্ধি করা একান্তই প্রয়োজন। আমার পর্যবেক্ষণের প্রারম্ভে এটি সম্ভবপর বলে মনে হয়েছিল যে গৃহপালিত প্রাণী ও আবাদী উদ্ভিদদের যত্নপূর্বক পর্যবেক্ষণ এই দুর্বোধ্য সমস্যার সমাধানে ভাল ফল প্রদান করবে। তাতে আমি হতাশও হইনি; এক্ষেত্রে এবং অন্যান্য সমস্ত জটিল ক্ষেত্রে আমি নিয়তই দেখেছি যে আমাদের জ্ঞান অসম্পূর্ণ হলেও গৃহপালনাধীন অবস্থায় পরিবৃত্তি (variation) সম্পর্কে আমাদের সর্বোত্তম ও নিরাপদ সূত্র প্রদান করেছে। এ ধরনের পর্যবেক্ষণের প্রতি আমার দৃঢ় বিশ্বাস প্রকাশ করার সাহস আমি রাখি, যদিও প্রকৃতিবিজ্ঞানীদের কাছে এগুলো সাধারণভাবে অবজ্ঞাতই রয়েছে।
এগুলো বিচার-বিবেচনা করেই, এই সংক্ষিপ্ত বিবরণের প্রথম অধ্যায়ে গৃহপালনাধীনে পরিবৃত্তির উপর মনোনিবেশ করব আমি। এইরূপে আমরা দেখব যে বহুপরিমাণে বংশগত রূপান্তর সম্ভবপর এবং সমভাবে আরও গুরুত্বপূর্ণ হল আনুক্রমিক অল্প অল্প পরিবৃত্তিসমূহকে নির্বাচন দ্বারা সঞ্চয় করার ব্যাপারে মানুষের প্রচণ্ড ক্ষমতা। এরপর প্রাকৃতিক অবস্থায় প্রজাতিদের পরিবৃত্তি সম্পর্কে মনোনিবেশ করব আমি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ আমি এই বিষয়টি সংক্ষেপে বিবেচনা করতে বাধ্য হব, যদিও তথ্যসমূহের দীর্ঘ তালিকা প্রদান করেই এগুলোর সত্যতা অনুধাবন করা সম্ভব। তবে পরিবৃত্তির পক্ষে সবচেয়ে অনুকূল অবস্থাটা কী, তা আমরা আলোচনা করতে সমর্থ হব।
পরবর্তী অধ্যায়ে সমগ্র পৃথিবীব্যাপী সমস্ত জীবের মধ্যে জীবনসংগ্রাম প্রসঙ্গে আলোচনা করা হবে, যা এদের বৃদ্ধির উচ্চ জ্যামিতিক হার থেকে অনিবার্যভাবে অনুসৃত হয়। সমগ্র প্রাণী ও উদ্ভিদজগতে আরোপিত এটাই হচ্ছে ম্যালথাস তত্ত্ব। বেঁচে থাকার সম্ভাবনার তুলনায় প্রত্যেক প্রজাতির আরও অসংখ্য একক জন্মায়, এবং পরিণতিতে বাঁচার জন্য প্রায়শঃই পৌনঃপুনিক সংগ্রাম চলে। এর অর্থ হল–জীবনের জটিল ও কোন কোন সময় পরিবর্তিত জীবন-অবস্থায় যে কোন জীবের অল্প পরিবর্তন হলেও যদি তা লাভজনক হয়, তাহলে সেটির বেঁচে থাকার অধিকতর সম্ভাবনা থাকবে এবং এভাবে প্রকৃতিগতভাবে নির্বাচিত হবে। বংশানুসৃতির কঠোর নিয়মানুসারে, যে কোন নির্বচিত প্রকার তার নূতন ও রূপন্তরিত আকারে বংশবিস্তার করতে সমর্থ হবে।
প্রাকৃতিক নির্বাচনের এই মৌলিক বিষয়টি চতুর্থ অধ্যায়ে সবিস্তারে আলোচিত হবে। তখন আমরা দেখব প্রাকৃতিক নির্বাচন কেমন করে জীবনের কম উন্নত আকারদের অথবা জাতদের প্রায় অনিবার্যভাবে বিলুপ্তি ঘটায় এবং সেইদিকে প্ররোচিত করে, যাকে আমি বৈশিষ্ট্যের কেন্দ্ৰাপসারণ বলি। পরবর্তী অধ্যায়ে পরিবৃত্তির জটিল ও অল্পজ্ঞাত নিয়মগুলো আলোচনা করব। পরবর্তী পাঁচটি অধ্যায়ে তত্ত্বটিকে স্বীকার করার পক্ষে সবথেকে স্পষ্ট ও জটিল সমস্যাগুলো আলোচিত হবে: যথা, প্রথমতঃ, অবস্থান্তরের অসুবিধাসমূহ, অথবা একটি সরল জীব এবং একটি সরল অঙ্গ কেমন করে একটি উচ্চ বিকশিত জীবে অথবা সুগঠিত অঙ্গে পরিবর্তিত অথবা নিখুঁত হতে পারে; দ্বিতীয়তঃ, সহজাত প্রবৃত্তির বিষয়টি অথবা প্রাণীদের মানসিক ক্ষমতা; তৃতীয়তঃ, সঙ্করণ অথবা আন্তঃসঙ্করণের পর প্রজাতিদের অনুর্বরতা ও প্রকারদের উর্বরতা; চতুর্থতঃ, ভূতাত্ত্বিক রেকর্ডের অসম্পূর্ণতা। পরবর্তী অধ্যায়ে সর্বকালের জীবের ভূতাত্ত্বিক অনুগমন বিবেচনা করা হবে। দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ অধ্যায়ে সমগ্র পৃথিবীব্যাপী এদের ভৌগলিক বিস্তার; চতুর্দশ অধ্যায়ে এদের শ্রেণীবিভাগ বা পরিণত ও ভূণাবস্থায় এদের পারস্পরিক সম্পর্কসমূহ; সর্বশেষ অধ্যায়ে সমগ্র গবেষণার সারসংক্ষেপ ও কয়েকটি উপসংহারমূলক মন্তব্য উপস্থিত করব আমি।