যাই হোক, অবশেষে দোভাষীর আবেদন মঞ্জুর হয়। শাস্তির আদেশ প্রত্যাহার করে নেয় থোরেন। পরের দিন দোভাষী আমাদের বাড়িতে এসে এ ব্যাপারে থোরেনের সঙ্গে যা যা কথা হয় সব গর্বের সঙ্গে বলে যায়। কোনও খুঁটিনাটি বাদ দেয়নি। এর মধ্যে হয়ত কিছু অত্যুক্তিও থাকতে পারে।
সেই দিন থেকে কেমন যেন বেশি গম্ভীর দেখাত থোরেনকে। বাবাও সাবধান হয়ে যান। হঠাৎ দেখা গেল অদ্ভুত খেয়াল চাপল থোরেনের মাথায়। সে শহরের নামকরা আধুনিক চিত্রশিল্পীদের ডেকে যে সব ছবি কিনেছিল তাতে তার মন ঠিকমতো তৃপ্ত হয়নি। সে লক্ষ্য করেছিল তাদের হাত ভালো হলেও প্রত্যেকের এক-একটি বিশেষ দিকে প্রতিভা আছে। কেউ প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলি ভালো ফুটিয়ে তুলতে পারে, কেউ মানুষের বিচিত্র জীবনধারা, কেউ মানুষের মন ও দেহ। থোরেন সবাইকে ডেকে বলল, তোমরা সবাই মিলে এমন একখানি বড় ছবি আঁকবে যাতে এই সব কিছু থাকবে, সার্থকভাবে ফুটে উঠবে। সকলের সব প্রতিভা একখানি ছবির মধ্যে ধরে রাখবে থোরেন, এই ছিল তার অভিপ্রায়। তার এই অভিপ্রায়ের অর্থ শিল্পীরা ঠিক বুঝতে না পারলেও মোটা টাকার লোভে রাজি হয়ে গেল সকলে। সে ছবির কাজ শেষ হতেই একদিন দেখা গেল থোরেন তার সব সংগৃহীত ছবি গাড়িতে করে পাঠিয়ে দিল তার ভাই-এর কাছে। আমাদের ঘরটা খালি হয়ে গেল।
তার অফিস সমেত থোরেনকে আমাদের বাড়ি থেকে যাবার জন্য অনেক আবেদন-নিবেদন যায় ফরাসী রাজার কাছে। অবশেষে সে আবেদন মঞ্জুর হয় এবং একদিন তার দলবল নিয়ে আমাদের বাড়ি থেকে চলে যায় থোরেন। তবু তার কথা আমি ভুলিনি কখনও।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
আমাদের নিজস্ব ঘরখানা আবার আমি ফিরে পেলাম। এই ঘরে থাকত থোরেনের ছবিগুলো। ঘরটা খালি হলেও বেশ কিছুদিন ধরে সেই সব ছবির ভূতগুলোকে আমি যেন আমার ঘরের দেওয়ালগুলোতে চলাফেরা করতে দেখতাম।
কাউন্ট থোরেন ও তার দলবল চলে যাওয়ার পর ঘরগুলো পরিষ্কার ও ঝাড়ামোছা হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে নূতন ভাড়াটে এল। এলেন প্রসিদ্ধ আইনজীবী, বাবার অন্যতম বন্ধু মরিৎস। মরিৎস নিজের আইনব্যবসা ছাড়াও বড় বড় সামন্তদের পরিবারের ও রাজপরিবারের মামলা-মোকদ্দমা দেখাশোনা করতেন। মরিৎস বাবার কাছে প্রায়ই এলেও তাঁর স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা ঘর থেকে বেরোয় না। আমাদের বাড়িতে আসত না। তাই থোরেনরা চলে যাবার পর আমাদের বাড়িটাকে বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগত।
মরিৎস শিল্পী না হলেও কিছু কিছু আঁকতে পারতেন। আমি ঘরবাড়ির স্কেচ করে তাঁকে দেখাতাম। তারপর ল্যান্ডস্কেপ পেস্টিং-এ মন দিলাম। আমার বাবা অসীম ধৈর্যের সঙ্গে নিজে শিখে আমাকে শেখাতেন। তারপর গান। অনেকদিন ধরেই আমাদের গান। শেখাবার কথা হচ্ছিল। অবশেষে ঠিক হলো আমরা ভাইবোনে হাপসিকউ শিখব। কিন্তু শিক্ষক পছন্দ হচ্ছিল না। এমন সময় একদিন আমার এক সহপাঠি বন্ধুর বাড়ি গিয়ে দেখি সে একজনের কাছে ঐ বাজনা শিখছে। শিক্ষকের শিক্ষাদান পদ্ধতি আমার ভালো লাগল। তার ডান ও বাঁ হাতের আঙুলগুলো সমানে চলত এবং প্রত্যেকটা আঙুলের একটা করে নাম দিয়েছিলেন। কখন কোন আঙুলটা চালাতে হবে তা খুব সুন্দরভাবে দেখিয়ে দিতেন।
আমি বাড়ি ফিরে বাবা-মাকে বলে সেই শিক্ষককে নিযুক্ত করলাম। কিন্তু লোকটার নীরস গুরুগম্ভীর ভাব দেখে অল্পদিনের মধ্যেই মোহমুক্ত হলাম আমরা। আবার বোন তো আমায় গাল দিতে লাগল। আমার বাবা অবশ্য আমার গান-বাজনা শেখার উপর তেমন জোর দিতেন না। তিনি শুধু চাইতেন আমার বোনই কিছু গান বাজনা শিখুক। আর চাইতেন আমার পাঠ্যপুস্তক ছাড়াও আমি কিছু ছবি আঁকতে শিখি।
এই সময় গিফেন নামে এক ফরাসি যুবককে দিয়ে একটি বোর্ডিং স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে ফরাসি ছাড়াও গ্রীক ও লাতিন ভাষা শেখানো হতো। পিফেন গান বাজনাও জানত। মস্ত বড় গাইয়ে ফেলতিনি নোরার সঙ্গে তার ভাব ছিল এবং নোরার কাছ থেকে একটা বড় পিয়নো কিনে আনে আমার বোনের জন্য। এই পিয়ানো বাজনা শিখতে আমার বোনের বড় কষ্ট হতো। এই সময় বাবা আবার ইংরেজি শিক্ষার জন্য একজন গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করেন।
ছোট থেকে আমার ইহুদি ভাষার শেখার শখ ছিল। আমারও আশা ছিল এই ভাষা শিখে আমি ওল্ড টেস্টামেন্ট গ্রন্থটি পড়তে পারব। আমার প্রায়ই মনে হতো ইহুদি জাতি সমগ্র মানবজাতির মধ্যে ঈশ্বরের অনুগৃহীত এমনই এক জাতি যারা পৃথিবীর মধ্যে হাজার বছরের ইতিহাস রচনা করেছে। যুগ যুগ ধরে কত কথা ও কাহিনী গড়ে উঠেছে তাদের নিয়ে। কল্পনার পাখায় চড়ে আমার মন চলে যেত সেই সুদূর পৌরাণিক অতীতের অজানা রাজ্যে। একটি পরিবার কিভাবে বংশ বিস্তার করে এগিয়ে যায় আরবের টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস বিধৌত ভূখণ্ড হতে প্যালেস্টাইন, জর্ডন ও পর ঈজিপ্টের পথে। কত সব মরুভূমি, পাহাড়, নদী ও সমুদ্রের দেশ ঘুরে একটি জাতি এগিয়ে চলেছে আত্মপ্রতিষ্ঠার পথে। আদ্রাবাথ, মোজেস জ্যাকব, র্যাশেল, জোশেফ প্রভৃতি কত সব পৌরাণিক চরিত্র ভিড় করে আসত আমার মনে। তাদের আশা, আকাক্ষা, আত্মদহন, দুঃখ-কষ্ট, প্রেম-ভালোবাসা সব নাড়া দিত আমার মনকে। হাজার বছরের একটা প্রকাণ্ড অতীতের ধূসর পটভূমিকা সহসা জীবন্ত হয়ে উঠত আমার মনে।
বাইবেলের এইসব ঘটনা ও চরিত্র নিয়ে আমি এক বিরাট পদ্য রচনা শুরু করে দিলাম। লেখা শেষ হলে আমাদের বাড়িতে যে যুবকটি থাকত এবং যার হাতের লেখা খুব ভালো ছিল তাকে দিয়ে ভালো করে প্রথম থেকে লেখালাম। তারপর বই বাঁধাই কারখানা থেকে ভালো করে বাঁধাই করে বাবাকে দেখালাম। এই বই আমি লিখেছি আমার অবসর সময়ে আমার পড়ার কাজ বাঁচিয়ে। দেখে খুশি হলেন বাবা।