দিরোনেস নামে একটি ছেলের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। সে একবার তার বোনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। বোনটি বয়সে আমার থেকে কিছু বড় ছিল। দেখতে মেয়েটি ভালো ছিল–সবল সুগঠিত চেহারা, বাদামী রং কালো চুল। কিন্তু তার ভাসা ভাসা চোখ দুটো সব সময় বিষাদের ছায়ায় কেমন যেন আচ্ছন্ন হয়ে থাকত। মেয়েটিকে আমার ভালো লাগে এবং তার কাজে আমার প্রিয় করে তোলার জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা করতে থাকি। যখনি তাদের বাড়ি যেতাম আমি কোনও ফুল বা ফল বা কোনও না কোনও একটা জিনিস উপহার দিতাম মেয়েটিকে। কিন্তু কোনও কিছুতেই তার মুখে হাসি ফোঁটাতে পারিনি আমি। অবশেষে একদিন মেয়েটির বিষাদের কারণ জানতে পারলাম। একদিন তার ঘরে বিছানার পাশে দেওয়ালে একটি ফটো দেখলাম। ছবিটি এক সুন্দর চেহারার ভদ্রলোকের। দিরোনেস আমাকে যা বলল তাতে বেশ বুঝতে পারলাম, ঐ ভদ্রলোক তাদের মার প্রথম পক্ষের স্বামী এবং তার দিদি হচ্ছে এ ভদ্রলোকের মেয়ে তারা দুই ভাই তার মার এক পক্ষের স্বামীর ছেলে। এবার বুঝলাম তার বাবাকে অকালে হারিয়ে পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হওয়ার জন্যই মেয়েটি সতত বিষাদগ্রস্ত হয়ে থাকে।
কাউন্ট থোরেন ছিল ফরাসি রাজার লেফটন্যান্ট। সেই সূত্রে বহু গণ্যমান্য ফরাসি লোক ও উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসার প্রায়ই দেখা করতে আসত তার সঙ্গে। এক সময় দেখা গেল রাজা নিজে এলেন কাউন্টের সঙ্গে গোপনে পরামর্শ করার জন্য। দেখলাম থোরেনের কাছে ঘন ঘন সেনাবাহিনীর অফিসারেরা দেখা করতে আসছে। এমন সময় একটা গুজব রটনা হয়ে গেল। শোনা গেল প্রুশিয়ার রাজা ফার্ডিন্যান্ড আবার আসছেন। তিনি শীঘ্রই ফরাসিদের তাড়িয়ে দেবেন ফ্রাঙ্কফোর্ট শহর থেকে। অনেকে ব্যগ্রভাবে সেই মুক্তির দিনের প্রতীক্ষা করতে লাগল। কথাটা শুনে আমার বাবা খুব আশান্বিত হলেন। খুশি হলেন মনে মনে। কিন্তু আমার মা কেমন যেন মুষড়ে পড়লেন। তাঁর কথা হলো এই যে ফরাসিদের শহর থেকে তাড়াতে পারলেই যুদ্ধ বাধবে। ফরাসিরা তাতে হেরে গেলেও পালিয়ে যাবার সময় যে ক্ষয়ক্ষতি করে যাবে তার ফল খুবই খারাপ হবে। তার থেকে যে অবস্থা বর্তমানে রয়েছে তাই থাক।
শহরের মধ্যে প্রচুর সৈন্য আনাগোনা করতে লাগল। আমাদের বাড়িতে দিনরাত সমানে লেগে থাকত ভিড় আর গোলমাল। বাড়ি থেকে ছেলেদের বার হতে দেওয়া হতো না। আমার বাবা ছিলেন প্রুশিয়ার পক্ষে। যুদ্ধ শুরু হতেই তিনি এগিয়ে গেলেন বিজয়ী বীরদের শহরে বরণ করে আনার জন্য। কিন্তু বাবা বেশ কিছুটা শহরের বাইরে এগিয়ে দেখলেন উল্টো ফল ফলেছে। দলে দলে আহত বন্দি জার্মানরা ফিরে আসছে শহরে। শুনলেন ফরাসিদের অবস্থা বর্তমানে ভালো। আপন দেশবাসীদের বন্দিদশা দেখে বাবা কেমন যেন আত্মহারা হয়ে পড়লেন। তিনি হতাশ মনে বিষণ্ণ মুখে বাড়ি ফিরে একে দুঃখে জলস্পর্শ করলেন না। নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে আকাশ পাতাল কি সব ভাবতে লাগলেন। মা ও আমরা সকলে পীড়াপীড়ি করেও কিছু খাওয়াতে পারলাম না বাবাকে।
সেদিন থোরেনকে খুব খুশি দেখাচ্ছিল। সে অফিস থকে ঘোড়ায় চেপে কোথায় যাচ্ছিল। আমরা তার কাছে গিয়ে তার হাত চুম্বন করলাম। সে খুশি হয়ে আমাদের মিষ্টি দেবার হুকুম দিল তার লোকদের। কিন্তু ঘরে ফিরে আবার জন্য খারাপ লাগছিল আমাদের। বাবা তখনও কিছু খাননি। অনেক করে কোনওমতে মধ্যাহ্নভোজনে রাজি করালাম আমরা। নিচেকার খাবার ঘরে গিয়ে তিনি আমাদের সঙ্গে খাবেন।
কিন্তু তখন আমরা ঘুর্ণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি আমরা তাঁকে এর দ্বারা বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছি। বাবা উপর থেকে সিঁড়ি নিয়ে নিচে নামবার সময় দুর্ভাগ্যক্রমে থোরেনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। মুখোমুখি হতেই থোরেন বাবাকে বলল, এই ভয়ঙ্কর বিপদটা যে এত সহজে কেটে গেল এর জন্য তুমি আশা করি নিজেকে ও আমাদের সম্বর্ধনা জানাবে।
আমার বাবা কিন্তু গম্ভীর মুখে বললেন, কোনওক্রমেই না। তার থেকে তুমি আমি সব যদি নরকে যেতাম তাও ভালো ছিল।
এতে কাউন্ট থোরেন রেগে গিয়ে বলল, এর জন্য দুঃখ পেতে হবে তোমায়। তুমি বুঝতে পারবে এভাবে অকারণে আমাকে অপমান করা তোমার উচিত হয়নি।
সেকথায় কান না দিয়ে বাবা নিচে নেমে এসে খাবার টেবিলে বসলেন। সাধ্যমতো যা পারলেন খেলেন। কাউন্ট থোরেনকে কিছু শক্ত কথা বলে মনটা যেন কিছুট হাল্কা হয়েছে তার।
কিন্তু সে রাতে আমরা যখন ঘুমিয়ে ছিলাম এক তুমুল ব্যাপার ঘটে যায়। জানতে পারলাম পরের দিন সকালে। দোভাষী সেই ফরাসি ভদ্রলোকের কাছ থেকে সব শুনলাম আমরা। শুনলাম গত রাতে আমরা বাড়ির ছেলেরা শুতে যাবার পর থোরেন বাবাকে গ্রেপ্তার করে গার্ড হাউসে নিয়ে যাবার হুকুম দেয়। বাবার পরিত্রাণের কোনও উপায় ছিল না। তার অধীনস্থ কর্মচারীরা সে হুকুম তামিল করতে কিছু দেরি করে আর সেই অবসরে দোভাষী সব নিয়মকানুন ভুলে গিয়ে কাউন্ট থোরেনের খাস কামরায় চলে যায়। মা ও আমাদের নামে আবেদন জানায় থোরেনে কাছ। বলে এ দণ্ডাদেশ মকুব করতেই হবে। থোরেন বলে, সে এ অপমান কিছুতেই সহ্য করবে না। তার হুকুম নড়চড় হবার নয়। কিন্তু দোভাষী অনেক করে বুঝিয়ে বলতে থাকে, আমার বাবা আসলে লোকটা খারাপ নয়, হঠাৎ কি মনে করে কথাটা বলে ফেলেছেন। তাছাড়া আমার মা ও আমরা ছেলেমেয়েরা তার আনুগত্য তো মেনেই নিয়েছি। সুতরাং থোরেনের মতো একজন সদাশয় অফিসার যদি সকলের সকল অভিযোগ ধৈর্য ধরে শুনে সকলের প্রতি সুবিচার করেন, তাঁর পক্ষে সামান্য একটা তুচ্ছ ব্যাপারে একজন নিরীহ লোককে এ শাস্তি দান করা শোভা পায় না।