যাই হোক আমাদের পরিবারর এক বন্ধু ‘মেসিয়া’ বইখানি আমার মার হাতে দিয়ে যান। ভদ্রলোক ব্যবসায়ী হলেও বইখানি পছন্দ করেছিলেন এবং এর অনেক কবিতা তিনি আবৃত্তি করে পড়তেন। আমরাও মার সহযোগিতায় বাবাকে লুকিয়ে বাড়িতে সে বই-এর অনেক কবিতা মুখস্থ করতাম।
একদিন একটা মজার ঘটনা ঘটল। সন্ধের দিকে নাপিত এসে বাবার ঘরে তাঁর দাড়ি কামাবার জন্য মুখে সাবান মাখাচ্ছিল। ঠিক এই সময় তারা দুই ভাই-বোনে চাপা গলায় আগুনের কাছে এক কোণে বসে ‘মেসিয়া’ কাব্যগ্রন্থের একটা কবিতা আবৃত্তি করতে করতে আমাদের ভাব এসে গিয়েছিল। হঠাৎ আবেগের মাথায় আমার ছোট বোন একটা ছত্র বলতে গিয়ে চিৎকার করে ওঠে আর নাপিত চমকে যাওয়ায় তার হাত থেকে অনেকটা সাবানের ফেনা পড়ে যায় বাবার জামার উপর। বাবা রেগে গিয়ে এর। কারণ অনুসন্ধান করে অবশেষে বইটির কথা জানতে পারলেন। সেদিন থেকে ক্লপস্টকের ‘মেসিয়া কাব্যগ্রন্থখানি চিরদিনের জন্য নির্বাসিত হলো বাবার বিচারে।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
১৭৫৯ সাল এসে গেল। কিন্তু নববর্ষের পারস্পরিক সাদর সম্ভাষণের মিস্টি আবহাওয়াটা কেটে যেতে না যেতেই আমাদের শহরের উপর নেমে এল দুর্দিনের করাল কালো ছায়া। ফরাসি সৈন্যরা দলে দলে আমাদের শহরের ভিতর দিয়ে মার্চ করে যেতে লাগল। শহরের কৌতূহলী জনতা রাস্তার দুধারে দাঁড়িয়ে তাদের দেখল। কিন্তু তাদের বাধা দেবার কোনও ক্ষমতা ছিল না আমাদের। এমনি করে একদিন দেখা গেল শহরের সামান্য রক্ষীদের হারিয়ে দিয়ে শহরটা দখল করে নিল ফরাসিরা।
শান্তিপ্রিয় শহরবাসীদের কাছে এক বিরাট দুঃখের কারণ হয়ে উঠল ব্যাপারটা। কিন্তু সবচেয়ে বেশি দুঃখ পেলেন আমার বাবা। কারণ তাঁর নতুন বাড়িটার এক বড় অংশ ছেড়ে দিতে হলো বিদেশী সৈন্যদের অফিসের জন্য। বাবা ছিলেন প্রুশিয়ার পক্ষে তাই কার্যত তিনি বন্দি হয়ে রইলেন তার ঘরে।
কাউন্ট থোরেন নামে এক ফরাসি সামরিক অফিসার অফিস খুলল আমাদের একতলার বাইরের ঘরে। ফরাসি সৈনিকরা ঘিরে রইল বাড়িটাকে। নগরবাসী ও ফরাসি সৈন্যদের সঙ্গে কোথাও কোনও দ্বন্দ্ব বা বিবাদ বাধলে এবং কোন পক্ষ অভিযোগ জানালে থোরেন তার বিচার করবে এবং শাস্তি বিধান করবে। সারা দিন তাঁর কাজকর্মের অন্ত ছিল না।
কিন্তু লোক হিসাবে খারাপ ছিল না থোরেন। আসার প্রথম দিকে একদিন আমাদের বাড়িটা বাবার সঙ্গে ঘুরে দেখার সময় আমাদের ছবির ঘরটা দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়। বলে, এই সব শিল্পীদের মধ্যে যারা বেঁচে আছে তাদের সঙ্গে আলাপ করবে। আমাদের বাড়ির সকলের সঙ্গে খুবই ভালো ব্যবহার করত থোরেন। রোগা ছিপছিপে চেহারার মানুষটা ছিল লোহার মতো শক্ত এবং অসাধারণ গাম্ভীর্যে ভরা মুখে ছিল বসন্তের দাগ। কিন্তু কড়া সামরিক অফিসার হলেও শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি থোরেনের অনুরাগ ছিল অপরিসীম। আমরা সবাই অবাক হয়ে যাই তা দেখে।
তবু কিন্তু বাবার মন ভিজল না, গলা তো দূরের কথা। মা তো থোরেনের সঙ্গে কথা বলার জন্য সাধ করে ফরাসি শিখতে লাগল। আমাদের পরিবারের বন্ধুরা ও মা নিজে বাবাকে বোঝাতে লাগল, থোরেন ছাড়া অন্য লোক এসে অবস্থা আরও খারাপ হবে। কিন্তু থোরেন যত ভালো লোকই হোক বাবা এই চাপিয়ে দেওয়া অবাঞ্ছিত পরাধীন পরিবেশটা কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছিলেন না মনে মনে। আগে তিনি আমাদের যেভাবে পড়াতেন এখন তেমন করে মন দিতে পারলেন না পড়ানোয়। কোনও কাজেই তার উৎসাহ নেই।
কাউন্ট থোরেনের সঙ্গে একজন দোভাষী ছিল। সে হচ্ছে আমাদের শহরের লোক। ফরাসি এবং জার্মান দুইই জানত বলে এই কাজ পায়। সে রোজ কাজ সেরে আমাদের বাড়ির ভিতরে এসে মজার মজার গল্প বলত। কোনো কোনো মামলায় থোরেন কি কি রায় দিত তার একটা করে ফিরিস্তি দিত। এই সব গল্প শুনে আমার মা ও আমরা মজা পেতাম। এই দোভাষী আবার অবসর সময়ে আমার মাকে ভাষা শেখাত।
অদ্ভুত একটা রোগ ছিল থোরেনের। সে রোগের নাম হলো হাইপোকনড্রিয়া বা বিষাদময়তা। মাঝে মাঝে গম্ভীর ও বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়ত থোরেন। কাজ ফেলে সঙ্গে সঙ্গে নিজের ঘরের মধ্যে চলে যেত। আর বার হতো না, কারও সঙ্গে দেখা করত না। একমাত্র খাস চাকর ছাড়া কেউ তার কাছে যেতে পারত না। এক-এক সময় দু-তিন দিন পর্যন্ত এইভাবে থাকত। আমরা বলতাম ওর ঘাড়ে ভূত চেপেছে। ভূতটা ছেড়ে গেলেই আবার স্বাভাবিক মানুষ হয়ে উঠত থোরেন।
একবার থোরেন সত্যি সত্যি শহরের নামকরা আধুনিক শিল্পীদের ডেকে তাদের কাছ থেকে তার পছন্দমতো বেশি কিছু ছবি কিনে নেয়। সেই ছবিগুলো আমাদের এক ঘরে ভরে রাখে। ঘরখানা স্টুডিওর মতো দেখাত। তার মতো কড়া সামরিক অফিসারের সূক্ষ্ম শিল্পরুচি দেখে আশ্চর্য হলাম আমরা। একদিন ছবির ঘরে ঢুকে আমি একটা ফটোর বাক্সের তালা খুলে তার মধ্যে কোনও নিষিদ্ধ ছবি দেখার চেষ্টা করি। ঢাকনা বন্ধ করার আগেই কাউন্ট থোরেন ঘরে ঢুকে আমাকে এভাবে দেখে দারুণ। রেগে যায়। গম্ভীরভাবে আমাকে হুকুম দেয় আমি যেন আটদিন এ ঘরে আর না ঢুকি। আমার দোষের কথা বুঝতে পেরে আমি মাথা নত করে নীরবে বেরিয়ে যাই ঘর থেকে। সে হুকুম অক্ষরে অক্ষরে পালন করছিলাম আমি।
এই সময় আমি ফরাসি ভাষা শিক্ষা করি। কিছু কিছু কথা বলতে পারতাম এবং বুঝতাম। এমন সময় একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম অপ্রত্যাশিতভাবে। আমাদের শহরের একটা থিয়েটারে তখন বেশ কয়েকদিন ঘরে ফরাসি নাটক দেখানো হচ্ছিল। আমার দাদামশাই আমাকে একখানা সিজন টিকিট দিয়েছিলেন যাতে আমি রোজ যে কোনও নাটক দেখতে পারি। আমার বাবা এটা না চাইলেও মার সহযোগিতায় আমি সেখানে যেতাম। কিন্তু মিলনান্তক নাটক আমার মোটেই ভালো লাগত না। সে নাটকের সংলাপ কোনও রেখাপাত করত না আমার মনে। ভালো লাগত বিয়োগান্ত নাটক। দীর্ঘ বিলম্বিত লয়ে বাঁধা ছায়িত সংলাপ, নায়ক-নায়িকার ধীর উদাত্ত কণ্ঠস্বর, সদা সতর্ক পদক্ষেপ ও অঙ্গসঞ্চালন, গুরুগম্ভীর পরিবেশ–সব মিলিয়ে আমার বড় ভালো লাগত। অনেক সংলাপ আমার মুখস্থ হয়ে গেল।