পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠতে বেলা হয়ে গিয়েছিল আমার।
স্টইক সন্ন্যাসীদের অনেক আত্মনিগ্রহের কথা শুনে আমিও নিজের উপর তা প্রয়োগ করতাম। এর মধ্যে একটি আত্মনিগ্রহ আমাদের শিখতে হলো শিক্ষকদের কাছ থেকে। সেটা হলো দৈহিক যন্ত্রণা সহ্য করতে শেখা। এই সহনশক্তি শিক্ষা দেওয়াই হলো বেশির ভাগ খেলাধূলার লক্ষ্য। আমাদের শিক্ষক আমাদের মুখে গায়ে ঘুষি মেরে যেতেন আর তাই চুপ করে আমাদের সহ্য করে যেতে হতো। কোনও কথা বলতে পেতাম না। এর থেকে আমরা ক্রোধ দমন করতে ও দৈহিক যন্ত্রণা সহ্য করার ক্ষমতা অর্জন করতাম।
১৭৫৭ সালটা মোটের উপর শান্তিতে কেটে গেল। যে সব সংসারে রাজনৈতিক মতামতের জন্য ফাটল ধরেছিল সে সব সংসারেও অনেকটা শান্তি ফিরে এল। ফাটলের অনেকখানি পূরণ হলো। আমার বাবা তখন বাড়িতে ছিলেন না। দেশভ্রমণে বার হয়েছিলেন।
অনেক অভিজ্ঞতা নিয়ে অবশেষে ঘরে ফিরলেন বাবা। ফিরে কি মনে হলো, আমাদের শহরের পৌর প্রতিষ্ঠানে এক অবৈতনিক প্রশাসকের পদ চাইলেন। কিন্তু তাঁর সে আবেদন প্রত্যাখ্যাত হতে বড় ব্যথা পেলেন। যাই হোক, ঠিক এই সময় উফেনব্যাক নামে একজন নামকরা গাইয়ে আসেন আমাদের শহরে। আমাদের সকলের দৃষ্টি তখন চলে যায় সেই দিকে।
ব্যারন ভন বেকেন নামে একজন সামন্তের কথা আমার আজও মনে আছে তিনি বড় অদ্ভুত প্রকৃতির লোক ছিলেন। একবার শহরের বহু ভিখারীকে ডেকে তাদের প্রত্যেকের ছেঁড়া কাপড় আর কম্বল সব কেড়ে নিয়ে তাদের পোশাক বিতরণ করেন এবং এক ঘোষণা জারি করে বলে দেন, প্রতি সপ্তাহে তিনি তাঁর বাড়িতে ভিখারীদের কিছু দান করবেন। কিন্তু যারা এই দান নিতে চায় তাদের প্রত্যেকে ফর্সা জামাকাপড় পরে আসতে হবে। তিনি যেমন সমাজের অভিজাত শ্রেণীর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতেন তেমনি নিঃস্ব গরিব ও ভিখারীদের খাওয়াতেও ভালোবাসতেন।
এরপর মনে পড়ে আমার ডাক্তার ওর্থের কথা। তিনি ধনী ঘরের সন্তান হয়েও প্রচুর পড়াশুনা করেন। জ্ঞানের গভীরতা, পাণ্ডিত্য, প্রশাসনিক যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তিনি কখনও সরকারি পদ গ্রহণ করেননি। তিনি রিফরমেশান অফ ফ্যাঙ্কফোর্ট’ নামে একখানি বই লেখেন এবং তা প্রকাশ করেন। আমি যৌবনে বইখানি পড়েছিলাম। বইখানির ঐতিহাসিক মূল্য অনস্বীকার্য। জন মাইকেল ভন লোরেন নামে আর একজন লেখকের কথা মনে আছে। তিনি কাউন্ট অর রিভেয়া’ ও ‘দি টু রিলিজিয়ন’ নামে দুখানি বই লিখে বেশ নাম করেন। প্রথম বইখানি শিক্ষামূলক রোমান্স। তাতে অভিজাত সমাজের জন্য বেশ কিছু নীতিশিক্ষার কথা ছিল। আর দ্বিতীয় বইখানি ধর্ম বিষয়ে বিতর্কে ভরা। এই বই পড়ে অনেক ধর্মতাত্ত্বিক বিতর্কে নেমে যান। এর ফলে রাজা দ্বিতীয় ফ্রেডারিকের দৃষ্টি পড়ে তার উপর এবং তাঁকে লিনজেনের সভাপতির পদ দান করেন।
আমাদের প্রতিবেশী ভন অকসেনস্টাইনের নাম আগেই করেছি। তার তিনটি ছেলে ছিল। এই পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্র জীবদ্দশায় কোনও নাম-যশ লাভ করতে পারেননি। কিন্তু মৃত্যুর পর হঠাৎ খ্যাতি অর্জন করে প্রচুর। মৃত্যুকালে যাজকদের কাছে তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করে যান তার মৃতদেহ সমাধিক্ষেত্রে নিয়ে যাবে দরিদ্র শ্রেণীর লোকেরা। এতে সমাজের উচ্চশ্রেণীর অনেকে রেগে যান। কিন্তু পরে দেখা গেল অনেকে আবার এই রীতি গ্রহণ করছে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকেরা এই রীতির পক্ষপাতী হয়ে ওঠে কারণ এতে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়র খরচ কম পড়ে।
আমাদের শহরের আর এক অদ্ভুত পরিবারের কথা মনে আছে। সে পরিবারের নাম হলো সেনকেনবার্গ পরিবার। তাদের বাড়িতে একটি পোষ খরগোস ছিল বলে সেই জন্য স্থানীয় রাস্তার নাম হেয়ার স্ট্রিট হয় আর সেই পরিবারের তিনটি ছেলেকে তিনটি খরগোস বলত পাড়ার লোক। অথচ পরবর্তীকালে তিনটি ছেলেই আপন আপন ক্ষেত্রে কৃতিত্ব অর্জন করে। বড় ছেলে ছিল রাজপরিষদের নামকরা সদস্য। দ্বিতীয় ছেলে ছিল সুযোগ্য জেলাশাসক। আর তৃতীয় ছেলে ছিল ডাক্তার।
ভন লোয়েন যেমন অভিজাত সমাজের উচ্ছখল লোকদের নৈতিক অনুশাসনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করতে চেয়েছিলেন, ভন মোসের নামে এক ব্যবসায়ী তেমনি কয়েকখানি বই লিখে ব্যবসায়ীদের অসাধুতা দূর করে তাদের সৎ জীবন যাপন করার শিক্ষা দিয়েছিলেন। কিন্তু ব্যবসায়ী মহল তাঁর কথা শুনেছিল বলে মনে হয় না। ফলে মনে কোনওদিন শান্তি পাননি মেসের। এমন একটা দুঃসহ দুরন্ত অনুভূতির সঙ্গে সারাজীবন তাঁকে যুদ্ধ করে যেতে হয়েছিল যে অনুভূতিকে সহ্য করা সম্ভব হচ্ছিল না তার পক্ষে। আমার সেই অনুভূতিকে একেবারে দূর করে দিতেও পারছিলেন না মন থেকে।
আমার বাবা মনে করতেন ছন্দই হলো কবিতার প্রাণ। তাই বেছে বেছে সেই সব প্রবীণ ও নবীন কবিদের কাব্যগ্রন্থ কিনে ঘরে সাজিয়ে রেখেছিলেন যারা ছন্দে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন ক্যানিস, হেগেডন, ড্রোনিংগার, জগেলার্ত ও হলার।
এমন সময় ক্লপস্টক নামে একজন আধুনিক কবি হঠাৎ নাম করে বসলেন, তাঁর ‘মেসিয়া’ নামে একখানি কাব্যগ্রন্থ আমাদের শহরের প্রায় ঘরে ঘরে স্থান পেল। অনেকে আবৃত্তি করল তাঁর কবিতা। বাবা সব নামকরা আধুনিক কবিদের কবিতার বই ঘর কিনে সাজিয়ে রাখতেন। নূতনদের বাবা পছন্দ করতেন, কিন্তু ক্লপস্টকের কবিতা ‘হেক্সামিটার বা ষষ্ঠপার্বিক ছন্দে লেখা বলে বাবা তাঁর কবিতার বই কেনেননি। বাবা বলতেন, ও ছন্দ ছন্দই নয়।