একদিন ভোর হতেই উঠে পড়লাম আমি। তখনও সূর্য উঠতে দেরি আছে। সূর্য ওঠার আগেই বেদীতে আগুন জ্বালব আমি। কিন্তু সুগন্ধি কাঠ কোথায়? একমাত্র সুগন্ধি ধূম পরিবৃত্ত অগ্নিই হতে পারে আমার অন্তরের প্রতিনিধি। অনেক কষ্টে আমি অবশেষে কিছু সুগন্ধি চন্দনকাঠ যোগাড় করে বেদীর উপর রেখে তাতে অগ্নিসংযোগ করলাম। আমার ধারণা আমি এইভাবে ঈশ্বরের সাক্ষাৎ পাব। তখন সূর্য উঠেছে, কিন্তু চারদিকের বাড়িগুলোর আড়ালে সে সূর্যের মুখ দেখতে পেলাম না। যাই হোক, বেদীতে আগুন জ্বলতে লাগল। সুগন্ধি ধোঁয়া উঠতে লাগল যজ্ঞবেদী হতে। আর আমি চোখ বন্ধ করে একমনে ধ্যান করতে লাগলাম ঈশ্বরের।
চোখ বন্ধ করে একমনে ধ্যান করছিলাম। কিন্তু দেখতে পাইনি যজ্ঞবেদীর আগুন প্রবল হয়ে কখন বেদীর কাছে রাখা ফুল, পূজোর উপকরণ ও আরও কিছু জিনিসপত্র সব পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে। আমার নিজের ঘরে এই পূজোর আয়োজন করেছিলাম আমি। হঠাৎ আমার ধ্যান ভেঙে গেল আমার। না ভাঙলে ঘরের সমস্ত জিনিস এবং এমনকি আমিও পুড়ে ছাই হয়ে যেতাম।
তারপর এ কাজ আর আমি কখনও করিনি।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
আমার সাতটা বছর শান্তিতেই কেটেছিল। সারা দেশে তখন বিরাজ করত নিরঙ্কুশ শান্তি। কিন্তু সহসা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল সেই অবিচ্ছিন্ন শান্তির ধারা। এল অশান্তি। এল যুদ্ধ। ১৭৫৬ সালের ২৮শে আগস্ট তারিখে বাধল অস্ট্রিয়ার সঙ্গে প্রুশিয়ার যুদ্ধ। প্রুশিয়ার রাজা দ্বিতীয় ফ্রেডারিক ষাট হাজার সৈন্য নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সেদিন। অস্ট্রিয়ার পাক্সলি শহরের উপর। রাজনৈতিক মতবাদের দিক থেকে দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেল আমাদের দেশের লোকেরা। একদল সমর্থন করতে লাগল প্রশিয়ার রাজা। ফ্রেডারিককে আর একদল সমর্থন করতে লাগল অস্ট্রিয়াকে।
আমাদের পরিবারের মধ্যেও দেখা দিল এক ফাটল। আমার দাদামশাই অস্ট্রিয়ার পক্ষ অবলম্বন করলেন অথচ আমার বাবা সম্রাট সপ্তম চার্লস কর্তৃক মনোনীত ইম্পিরিয়াল কাউন্সিল-এর সদস্য হিসাবে অবলম্বন করলেন ফ্রেডারিকের পক্ষ। ফলে রবিবার আর আমাদের দাদামশাই-এর কাছে যাওয়া হতো না। এমনকি মা নিষেধ করে। দিয়েছিলেন তাঁর নাম যেন কখনও উচ্চারণ না করি।
সুতরাং তখন আমার বালক মনেও পড়েছিল প্রুশিয়ার প্রভাব। প্রুশিয়ার হয়ে অনুভব করতাম জয়ের আনন্দ। কিন্তু আমার দাদামশাই-এর কথা মনে করে সেই আনন্দের মাঝেও অনুভব করতাম এক নিদারুণ বেদনা! সঙ্গে সঙ্গে লিসবনের সেই ভূমিকম্পের মতো এই যুদ্ধের ঘটনাটাও নতুন করে প্রচণ্ডভাবে কাঁপিয়ে দিল আমার ঈশ্বরবিশ্বাসের ভিত্তিভূমিটাকে। আমার কেবলি মনে হতো আমার দাদামশাই সব দিক দিয়ে একজন আদর্শ চরিত্রের মানুষ হয়েও কেন আজ রাজনৈতিক কারণে জনসাধারণের ও শহরের বহু বিশিষ্ট লোকের কাছ থেকে পাচ্ছেন দুঃসহ অবহেলা আর অপমান? এখানে কি ঈশ্বরের করার কিছু নেই? আর জনমতেরই বা সততা কোথায়? কোথায় তাদের ন্যায়বিচার? লোকে কি বলবে বলে ছোট থেকে আমাদের যে জনমতের জুজুর ভয় দেখানো হয় আসতে সে জনমত অর্থহীন।
যুদ্ধের সময় ছেলেদের বাইরে বার হতে দেওয়া হতো না। সারাদিনই আমাদের মতো ছেলেদের সবসময় থাকতে হতো বাড়ির ভিতর। তাই মাঝে মাঝে আমাদের আমোদ-প্রমোদের জন্য পুতুলনাচের অনুষ্ঠান হতো। আমাদের বাড়িতে একবার পুতুলনাচ হয়েছিল আর তাতে পাড়ার ছেলেমেয়েদের প্রচুর ভিড় হয়েছিল।
মাঝে মাঝে রাত্রিবেলায় স্বপ্ন দেখতাম আমি আর সেই স্বপ্নের কথাগুলোকে গল্পের মতো করে বলতাম আমার খেলার সঙ্গী-সাথীদের কাছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আমার কথা বিশ্বাস করত। কেউ আবার স্বপ্নের কথা অর্থাৎ বন, বাগানবাড়ি কোথায় আছে তা মিলিয়ে দেখবার চেষ্টা করত।
একদিনকার এমনি এক স্বপ্নের কথা মনে আছে আমার। একদিন রাত্রিতে আমি স্বপ্নে দেখলাম আমি আয়নার সামনে নূতন পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছি। তখনও আমার সাজসজ্জা শেষ হয়নি, এমন সময় এক সুদর্শন যুবক এসে হাসিমুখে দাঁড়াল আমার সামনে। আমি তাকে অভ্যর্থনা জানাতে সে বলল, তুমি জান আমি কে? আমি বললাম, তোমাকে দেখতে লাগছে ছবিতে দেখা বুধগ্রহের মতো। সে বলল, হ্যাঁ, আমি তাই। দেবতাদের এক বিশেষ অনুরোধে আমি এসেছি তোমার কাছে। তার হাতের উপর রাখা তিনটি আপেল দেখিয়ে সে তখন বলল, দেখতে পাচ্ছ এই আপেলগুলো? আমি ভালো করে দেখলাম তার হাতের তিনটি আপেল তিন রং-এর এবং সেগুলো দেখতে খুবই সুন্দর। একটি আপেল লালচে, একটি সোনালী আর একটি সবুজাভ। আমি তখন হাত বাড়িয়ে আপেলগুলো নিতে গেলাম তার হাত থেকে। কিন্তু সে সরে গিয়ে বলল, এগুলো তোমার জন্যে নয়। তুমি এই আপেলগুলো শহরের তিনজন খুব সুন্দর যুবককে দেবে। তাহলে তারা তাদের পছন্দমতো সুন্দরী স্ত্রী খুঁজে পাবে। এই বলে আপেলগুলো আমার হাতে দিয়ে যুবকটি চলে গেল। আমি আপেলগুলো হাতে। নিয়ে দেখতে লাগলাম আশ্চর্য হয়ে। কিন্তু আপেলগুলো সহসা বড় হতে হতে মাঝারি আয়তনের তিনটি পুতুলের আকার ধারণ করে। তারা রূপান্তরিত হলো তিনটি নারী মূর্তিতে। তাদের শাড়ির রং ছিল ঠিক সেই আপেল তিনটির মতো। তাদের মধ্যে দুজন পালিয়ে গেল আমার আঙুলের ফাঁক দিয়ে। আর একজন আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে তার পায়ের বুড়ো আঙুলের উপর ভর দিয়ে নাচতে লাগল। অনেকক্ষণ ধরে তার নাচ দেখতে লাগলাম। আমি ভাবলাম সে আমায় ধরা দেবে। তাই যেমন তাকে ধরতে গেলাম অমনি আমার মাথায় কে যেন জোর আঘাত দিল আর আমি পড়ে গেলাম।