পড়াশুনোর আনন্দে বেশই বিভোর হয়ে ছিলাম আমি। কিন্তু বনভোজনের সময় হঠাৎ ঝড় এসে যেমন তার সব আনন্দ উপভোগ উড়িয়ে নিয়ে যায় মুহূর্তে তেমনি হঠাৎ অসুখ এসে ছিন্নভিন্ন করে দিল আমার সেই আনন্দকে। হঠাৎ একদিন জ্বর ও বসন্তরোগে আক্রান্ত হলাম আমি। বেশ কিছুদিন ভুগে যখন ভালো হলাম তখন দেখি। পড়াশুনার দিক দিয়ে পিছিয়ে গেছি আমি। কিন্তু সবচেয়ে সমস্যার সৃষ্টি করলেন আমার বাবা। অসুখের জন্য আমার পড়ার যে ক্ষতি হয়েছে সে ক্ষতি পূরণের জন্য তিনি আমায় রোজ দ্বিগুণ পড়ার কাজ দিতে লাগলেন। আমার শরীর খুব দুর্বল। আমার খুবই কষ্ট হচ্ছিল সে পড়ার কাজ করতে। কিন্তু কোনও উপায় ছিল না।
দুঃখে যখনি অধৈর্য হয়ে পড়তাম আমি, অধৈর্যের পীড়নে যখন পীড়িত হতাম তখন নিজের মনকে নিজেই বোঝাতাম। তবে স্টইক সন্ন্যাসীদের কথা থেকে শেখা ও খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বে পড়া ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা নামক গুণটিকে সেই বয়সেই আয়ত্ত করে ফেলেছিলাম আমি। সেই গুণই আমাকে সান্ত্বনা দিত কোনও প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে।
তবে বাবার এই শিক্ষাগত পীড়নের হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্য মাঝে মাঝে আমরা ভাইবোনে চলে যেতাম আমাদের দিদিমার বাড়ি। আমাদের দিদিমা-দাদামশাই দুজনে যখনও জীবিত ছিলেন। তাঁদের বাড়িটা ছিল আমাদের শহরেই ফ্রেডবার্গ স্ট্রীটে। পুরনো দুর্গের মতো বাড়িটা আমার মোটেই ভালো লাগত না। ভালো লাগত শুধু বাড়ির পিছনের দিকের বিরাট বাগানটা। সে বাগানের একদিকে ছিল ফুলের গাছ আর অন্য একদিকে ছিল শাকসজি আর ফলের গাছ। এর মধ্যে আমাদের সবচেয়ে প্রিয় ছিল জাম আর জামরুল গাছ। গেলেই আশ মিটিয়ে ফল পেড়ে খেতাম গাছ থেকে। আমার দাদামশাই ছিলেন প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী। কিন্তু রোজ কোর্ট থেকে এসেই খোন্তা নিয়ে বাগানবাড়িতে চলে যেতেন। মালী থাকা সত্ত্বেও নিজের হাতে ফুলগাছগুলোর যত্ন। নিতেন। সারা বাগানটা তদারক করে বেড়াতেন।
আর একটা কারণে আমরা গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতাম আমাদের দাদামশাইকে। সে কারণটি হলো এই যে তিনি ভবিষ্যতের সব কিছু বলে দিতে পারতেন। তিনি নাকি স্বপ্নে অনেক জিনিস আগে হতে জানতে পারতেন। একবার নিজের সম্বন্ধে এক ভবিষ্যদ্বাণী করেন দাদামশাই। তিনি দিদিমাকে বলেন, সরকারের আইনবিভাগের একটি পদ অল্পদিনের মধ্যেই শূন্য হবে আর সেই শূন্য পদে তিনিই অধিষ্ঠিত হবেন। কিছুদিন পর দেখা গেল সত্যিই এক ভদ্রলোক মারা গেলেন সেই বিভাগে আর তাঁকেই সরকার সেই পদে বসাল। দাদামশাই একমাত্র দিদিমার কাছে বলেন তিনি নাকি স্বপ্নে একথা জানতে পারেন। আর একটি মৃত্যুর কথাও আগেই বলে দেন তিনি।
আমি একবার দাদামশাই-এর বইখানা ওলটাতে ওলটাতে একটি খাতায় দেখি কি সব রহস্যময় কথা লেখা রয়েছে। আজ রাত্রিতে অমুকে আমার কাছে এসেছিল। অমুক ছাড়া সবাই চলে গেল। এইভাবে কারও নাম না করে তিনি অনেক কথা খাতায় লিখতেন। তার অর্থ আমি কিছুই বুঝতে পারিনি।
আমার দুই মাসি ছিল। আমাদের শহরের মাঝেই দুজনের বিয়ে হয়েছিল দু জায়গায়। এক মাসির বাড়ি ছিল বাজারের কাছে ঘিঞ্জি জায়গায়। কিন্তু সে মাসি ছেলেবেলায় আমাদের বড় ভালোবাসত। শুধু আমাদের নয়, পাড়ার অনেক গরিব। ছেলেমেয়েদেরও সমানভাবে ভালোবাসত মাসি। তাদের গা পরিষ্কার করে দিত। চুল আঁচড়ে দিত। কোলে পিঠে করে খেলা করত তাদের সঙ্গে।
আমার এক মাসির বাড়িতে একটা ছোটখাটো গ্রন্থাগার ছিল। আমি একদিন। সেখানে হোমারের এক গদ্যানুবাদ দেখতে পাই। কিন্তু তাতে ট্রয় জয়ের পূর্ণ বিবরণ। পেলাম না। পেলাম শুধু বিকৃত রুচির কতকগুলি ছবি। ছবিগুলো দেখে তখন আনন্দ পেলেও এখন বুঝছি সেগুলি খুবই খারাপ ছবি। আমার মেসোমশাইকে কথাটা বলতে তিনি আমাকে ভার্জিল পড়ার কথা বললেন।
অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে ধর্ম বিষয়েও আমাদের শিক্ষাদান করা হতো। কিন্তু তখনকার দিনের প্রোটেস্টান্ট ধর্ম আমাদের মনকে তৃপ্ত করতে পারেনি। সে ধর্মের কথা ছিল শুধু কতকগুলো নীরব নীতিশিক্ষার কথা যার সঙ্গে আমাদের হৃদয় ও উপলব্ধির কোনও সম্পর্ক ছিল না। এই জন্যই হয়ত ধর্মের ক্ষেত্রে গড়ে উঠেছিল অনেক সম্প্রদায়, অনেক মত, অনেক পথ।
তবে আমি ধর্মের কথা বিভিন্নভাবে শুনেছিলাম তাতে আমার একটা কথা মনে হয়েছিল ঈশ্বর সম্বন্ধে। মনে হয়েছিল আমি ঈশ্বরকে খুঁজব প্রকৃতির মাঝে। আমি খুঁজব সেই ঈশ্বরকে যিনি একাধারে সারা বিশ্বের স্রষ্টা এবং পরিচালক, যে ঈশ্বরের মধ্যে নেই কোনও ক্রোধ বা রোষের প্রচণ্ডতা, আছে শুধু অফুরন্ত সৌন্দর্য। সেই সৌন্দর্যের স্রোতই বিশ্বের সর্বত্র বিশেষ করে প্রকৃতির মাঝে খেলা করে চলেছে সর্বক্ষণ।
আমার মনে হয়েছিল যে ঈশ্বর প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এবং তিনি প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে দিয়ে কাজ করে থাকেন সেই ঈশ্বর প্রকৃত ঈশ্বর। তবে এই ঈশ্বরকেই মানুষের সঙ্গেও সম্পর্কযুক্ত করে তুলতে হবে। এই ঈশ্বরই মহাশূন্যে গ্রহনক্ষত্রের গতিপ্রকৃতি পরিচালনা করে থাকেন। তবে আমার এ কথাও মনে হয়েছিল যে এ ঈশ্বরের কোনও আকার নেই। এ ঈশ্বর অরূপ নিরাকার।
একদিন এই ঈশ্বরের উপাসনা করার জন্য ওল্ড টেস্টামেন্টের কায়দায় এক বেদী তৈরি করলাম। তার উপরে আগুন জ্বালাতে হবে। সেই আগুনের শিখা ঈশ্বরের প্রতি মানুষের, ভগবানের প্রতি ভক্তের সুনিবিড় কামনার দ্যোতক হয়ে জ্বলতে থাকবে।