সেকালে শিক্ষাদীক্ষার আবহাওয়া ভালো ছিল না দেশে। শিক্ষাদানের নামে সর্বত্রই চলছিল আত্মম্ভরিতার প্রচার। আমার বাবা তাই আমার স্কুল জীবনেই বাড়িতেই নিজে আমাদের অনেক জিনিস পড়াতেন। তিনি বলতেন যিনি যে বিষয়ে অভিজ্ঞ ও পারদর্শী তাঁর কাছ থেকে সেই বিষয় শিখতে হবে।
পড়াতে গিয়ে আমার সহজাত বুদ্ধি ও স্মৃতিশক্তির প্রশংসা করতে লাগলেন বাবা। আবার বোনকে বাবা যখন ইতালীয় ভাষা ও সাহিত্য পড়াতেন তখন আমি ঘরের এক কোণে বসে তা শুনে অনেক কিছু শিখে নিতাম। বাবা স্পষ্ট একদিন আমাকে বললেন, আমি যদি তোর মতো বুদ্ধি ও স্মৃতিশক্তি পেতাম তাহলে আরও বড় হতাম জীবনে।
বাবা লিপজিগ বিশ্ববিদ্যালয় হতে আইনবিদ্যা পাশ করেন। বাবা বলতেন, তিনি জীবনে যা কিছু শিখেছেন প্রচুর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে শিখেছেন। অপরিসীম একাগ্রতা আর নিষ্ঠার সঙ্গে পড়াশুনা করে শিখেছেন। তাঁর সহজাত গুণ আর প্রতিভা বলে নাকি কিছু ছিল না।
আমার বাবা ও স্কুলের শিক্ষকরা যা পড়াতেন, অল্প সময়ের মধ্যেই তা আয়ত্ত করে ফেলতাম আমি। কিন্তু একটা বিষয় আমার পড়তে ভালো লাগত না। তা হলো ব্যাকরণ। আমার মতে ব্যাকরণের নিয়মকানুনগুলো মোটেই নির্ভরযোগ্য নয়, কারণ সেগুলো ব্যতিক্রমে ভরা এবং সেগুলো ব্যাপক সাহিত্যপাঠের মাধ্যমে শিখতে হয়। কোনও লেখার মধ্যে কিছু কিছু ব্যাকরণগত ত্রুটি থাকলেও ছন্দ, অলঙ্কার ও রচনালিখনে তাই তখনকার কোনও ছেলে পেরে উঠত না আমার সঙ্গে।
বাবা একদিন আমার বললেন আমার স্কুলের পড়া শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি কলেজে যাব। তিনি আরও বললেন তাঁর মতো আমাকেও লিপজিগে গিয়ে শিখতে হবে আইনবিদ্যা। অন্যান্য পিতার মতো আমার পিতাও স্বভাবতই আশা করতেন তাঁর আরদ্ধ কাজকে আমি শেষ করব, তাঁর মনের কোণে জমে থাকা গোপন স্বপ্নকে সার্থক করে তুলব। তিনি বললেন, লিপজিগ ছাড়া আমাকে যেতে হবে ওয়েসলার, র্যাটিসবন এবং তারপর ইতালি। ইতালি থেকে আসার পথে যেতে হবে প্যারিসে। তার মতে ইতালি থেকে আসার পরে প্যারিস ছাড়া আর কোনো জায়গা ভালোই লাগবে না। কিন্তু কেন জানি বা বাবা আমাকে একটি জায়গায় যেতে নিষেধ করলেন। সে জায়গা হলো গর্টিনজেন। অথচ ঐ জায়গাটায় যাবার খুব ইচ্ছা ছিল, আশা ছিল।
ইতালি দেশটার প্রতি বাবার কেমন যেন একটা দুর্বলতা ছিল। সে দেশের নদী সমুদ্র, পাহাড়-প্রান্তর, বন-উপবন, ভাষা-সাহিত্য, শিল্প সব কিছুই যেন অনবদ্য, অতুলনীয় ছিল তাঁর কাছে। স্বভাবতই তিনি স্বল্পভাষী ও রাশভারি প্রকৃতির হলেও তিনি যখন আমার কাছে লেপনস শহরের বর্ণনা করতেন তখন কেমন যেন আবেগে আপ্লুত হয়ে উঠত তাঁর নীরস অন্তর। তথাকথিত সেই ভূ-স্বর্গে সেই মুহূর্তে কল্পনার পাশা মেলে ছুটে যাবার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠত আমার বালকমন।
প্রতি রবিবার আমাদের এক সভা বসত। সভা মানে কবিতার আসর। আমরা কয়েকজন সহপাঠি মিলে একটি করে কবিতা লিখে আনতাম। আর তা একে একে পাঠ। করতাম। ছন্দ ও অলঙ্কারে আমার কিছু জ্ঞান হয়েছিল। তাই আমার কবিতায় ছন্দপতন বিশেষ ঘটত না। কিন্তু আমি লক্ষ্য করলাম, আমি যেমন আমার যে কোনও লেখায়। আনন্দ পাই তেমনি অন্য যেসব ছেলের ভাষা, ছন্দ ও অলঙ্কারে কোনও জ্ঞান নেই তারাও তেমনি আনন্দ পায় নিজেদের লেখায়। তারা প্রত্যেকেই মনে করে তাদের আপন আপন লেখা সবচেয়ে ভালো। কিন্তু একটা ঘটনায় আমি খুব ব্যথা পেলাম। আমাদের এক সহপাঠি বন্ধু তার শিক্ষকের কাছ থেকে কবিতা লিখে এনে বলত, সেটা তার লেখা। সে তার লেখার সঙ্গে আমার লেখার তুলনা করে অন্যায়ভাবে দাবি করত। আপন শ্রেষ্ঠত্বের। অবশেষে আমি কবিতা লেখা ছেড়ে দিলাম হতাশ হয়ে। কিন্তু আর একটি ঘটনায় আমি আবার ফিরে পেলাম আমার হারিয়ে যাওয়া আশা আর উৎসাহ। একদিন আমাদের শিক্ষকরা আমাদের মতো যে সব ছেলেরা কবিতা লিখত তাদের নিয়ে এক কবিতা প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করলেন। সেখানে কিন্তু আমার কবিতাই সাধারণভাবে সকলের প্রশংসা অর্জন করল।
সেকালে শিশুদের জন্য গ্রন্থাগার ছিল না। পাঠ্যপুস্তক আর বাইবেল ছাড়া অন্য কোনও বাইরের বই পড়তে পেতাম না আমরা। কিন্তু যে কোনও ভাবে হাতে একটা বই পেলাম আমি। বইটা খুব ভালো লেগে গেল আমার। বইটা হলো অভিদের ‘মেটামরফসিস’ বা রূপান্তর। এ বই-এর প্রতিটি ঘটনা ও চরিত্র ছবির মতো ভাসতে লাগল আমার মনে। আমি অবসর পেলেই সে বই-এর ছত্রগুলো আবৃত্তি করে ফেলতাম।
এরপর আরও কয়েকটা বই পড়ার সৌভাগ্য হয় আমার। যেমন ফেনেলনের ‘টেলিমেকাস’, ড্যানিয়েল দিফোর ‘রবিনসন ক্রুসো। ক্রুসো পড়ে মনে হলো ফসলেনবার্গ দ্বীপ কল্পনার সৃষ্টি নয় তা বাস্তবে আছে। আর একখানা বই আমাদের কল্পনাকে উদ্দীপিত করে তুলল। তা হলো লর্ড অ্যানসরের ভয়েজ রাউন্ড দি ওয়ার্ল্ড। বাস্তব ঘটনা ও পরিবেশের সঙ্গে দেশীয় রূপকথার এমন অপূর্ণ মিলন আমি আর কোথাও দেখিনি।
ঐ সময় আমাদের শহরে ছেলেদের জন্য বেশ কিছু মধ্যযুগীয় রূপকথার বই বিক্রি হতে থাকে। তরুণ ছেলেমেয়েদের কাছে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ঐ সব বই। এই সব বইয়ের মধ্যে ছিল ‘দি এমপারার অক্টেভিয়ান’, ‘দি ফেয়ার মেলুসিনা’, ‘দি ফোর সালয় অফ হাইম’, ‘দি ওয়ানডারিং জু’। সহজ ভাষায় লেখা এই সব বই পড়ে আমরা তার গল্পগুলো সহজেই বুঝতে পারতাম। অর্থাৎ এইভাবে দ্বিতীয়বার তাদের রস আস্বাদন করার সুযোগ পেলাম।