আমরা মানুষের ভিড় এড়িয়ে জনপথ থেকে দূরে চলে গেলাম খাঁটি পর্বতের রাজ্যে। গোলোকধাঁধার মতো কত প্রায়ান্ধকার গিরিপথ, কত সুদৃশ্য পর্বতশৃঙ্গ যার উপরে মেঘের উপর মেঘ জমেছে। তুষার আর কুয়াশা জমে আছে যাদের গায়ে। আবার এক এক জায়গায় পথের দুধারে দাঁড়িয়ে আছে খাড়াই পাহাড়। ঠিক যেন রঙ্গ মঞ্চের দৃশ্যপটে আঁকা। এ পাহাড় যুগ যুগ ধরে স্থাণুর মতো অচল অটলভাবে এই। একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। সুখদুঃখের যে তরঙ্গ মানুষের জীবনকে ক্রমাগত অসহায়ভাবে দোলাচ্ছে সে তরঙ্গ ওদের কাছে যেতে পারে না। ওদের স্পর্শ করতে পারে না।
পাহাড়ের রাজ্যে অনেক ঘোরাফেরার পর আমরা সেই পার্বত্য প্রদেশে এক তীর্থস্থান দর্শন করলাম। সেটা হলো মেরিয়া আইনসীভাইন চার্চ। চার্চটি এক উঁচু পাহাড়ের উপর। সে পাহাড়ে উঠতে উঠতে ক্লান্ত হয়ে উঠলাম আমরা। তারপর অতিকষ্টে গিয়ে দেখলাম ডেভিল স্টোন বা শয়তানের পাথর।
আমার আমরা সমতলে ফিরে এলাম। আবার সেই উদার উন্মুক্ত প্রান্তর আর কুয়াশাঢাকা হ্রদ। আমরা অনেক পথ পার হয় অনেক ওঠানামা করে অবশেষে নিশ্চিন্ত। ও পরিপূর্ণ বিশ্রামের আশায় সেন্ট গথার্ড হসপিনে এসে উঠলাম। এখানে এক ফাদার আমাদের ইতালি যাবার কথা বললেন। কিন্তু জার্মানি ফিরে যাবারই মনস্থ করলাম।
সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াবার সময় আমি একটি কবিতায় লিখেছিলাম, আমি তোমার কাছ থেকে পালিয়ে এসেছি লিলি, কিন্তু না, আমি তোমার বন্ধনে আজও আবদ্ধ আছি। আমি একের পর এক বন, পাহাড় আর উপত্যকা পার হয়ে চলেছি, কিন্তু যেখানেই যাচ্ছি তোমাকে ছেড়ে যেতে পারছি না। তুমি দেখছি সব সময় আমার সঙ্গেই আছ।
বাড়ি ফিরে তাই আমি লিলির সঙ্গে দেখা না করে পারলাম না। আমি কিন্তু বাড়ি গিয়ে শুনলাম লিলিকে আমার অনুপস্থিতিকালে বোঝানো হয়েছে আসল ব্যাপারটা। বোঝানো হয়েছে আমার আশা তাকে ত্যাগ করতেই হবে। এ বিচ্ছেদ অনিবার্য। তার উত্তরে লিলি নাকি তাদের বলেছ সে আমার জন্য আমার সঙ্গে তার সবকিছু ছেড়ে, বাড়িঘর দেশ আত্মীয়-স্বজন সব ছেড়ে আমেরিকায় গিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে পার।
লিলির জন্য আমিও তা পারি। কিন্তু আমি পরক্ষণেই অন্য কথা ভাবলাম। ভাবলাম, আমার বাবার এই সুন্দর সাজানো বাড়ি, এত সব বিষয়-সম্পত্তি, এই নিশ্চিন্ত আরামঘন জীবনযাত্রা, সবকিছু ত্যাগ করে অজানা দূরদেশে গিয়ে নিশ্চিত জীবনযাত্রার মধ্যে নিজেকে ঠেলে দেওয়ার কোনও অর্থই হতে পারে না। সুতরাং লিলির এ প্রস্তাবে আমি সাড়া দিতে পারলাম না। তার প্রতি আমার ভালোবাসার কোনও ফাঁকি না থাকলেও আমি তা পারলাম না।
এই সময় এগমঁত নাটকটি লেখা শুরু করি। আয়রন হ্যান্ড’-এ যেমন নেদারল্যান্ডবাসীদের বিদ্রোহের ঘটনাকে রূপদান করেছি, তেমনি এ নাটকের বিষয়বস্তুও রাজনৈতিক। এতে দেখাতে চেয়েছি, কোনো স্বৈরাচারী দুর্ধর্ষ শাসকের কাছে গণতান্ত্রিক সুযোগ-সুবিধা বা অধিকারের কোনও মূল্য নেই। এই নাটকে আমি আবার আমার প্রতিহত প্রেমাবেগকেও বাণীরূপ দান করলাম।
এইভাবে লিলির কাছ থেকে নিজেকে ছিনিয়ে নিয়ে আমি বাড়ির মধ্যে স্বেচ্ছানির্বাসন গ্রহণ করলাম। একমনে এগমঁত নাটক লিখে যেতে পারলাম। এই সময় ওয়েগনারের কাউন্টের কাছ থেকে নিমন্ত্রণ পেয়ে সেখানে আবার মনস্থ করি। কিন্তু যথাসময়ে কাউন্টের দূত না আসায় আমি ইতালি চলে যাওয়াই স্থির করি।
ইতালি যাবার পরে অপ্রত্যাশিতভাবে দেখা হয়ে গেল ডেলফের সঙ্গে। দেখা হবার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ল লিলির কথা। যাকে এড়িয়ে দূরে পালিয়ে যাচ্ছি সে যেন আমার সামনে অন্যের রূপ ধরে এসে দাঁড়াল। ডেলফ আমায় অনেক করে বুঝিয়ে বলল। আমার সংসারজীবন সম্পর্কে তার পরিকল্পনার কথা বলল। কিন্তু আমার মনে কোনওরূপ সাড়া জাগাতে পারল না সে কথা। কেমন যেন বৈরাগ্যে ধূসর হয়ে গেছে আমার সে মন। আমার প্রতিহত প্রেমাবেগ এক ভয়ঙ্কর শূন্যতায় আবর্তিত হতে লাগল যেন। গ্রেচেন, ফ্রেডারিক, লিলি–এদের সকলের মধ্যে সেই এক নারী, এক প্রেম ভিন্ন ভিন্ন মূর্তি ধরে এসেছে আমার কাছে, কিন্তু কোনও না কোনও কারণে তারা চলে যেতে বাধ্য হয়েছে আমার কাছ থেকে। আমি এবার সম্পূর্ণরূপ মুক্ত সব মোহ থেকে। আমি এখন তাদের আর কাউকেই চাই না।
হোটেল থেকে ইতালির পথে আবার যাত্রা শুরু করব এমন সময় ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে লোক এল। একটি চিঠি দিল। ওয়েগনারের কাউন্টের লোকের আসতে কেন দেরি হয়েছে তার কারণ তাতে সবিস্তারে লেখা আছে। কাউন্টের অনুরোধ ফিরে যেতে হবে। অগত্যা আবার জার্মানির পথ ধরলাম।
পথ ভাবতে লাগলাম, আমি কোথায় চলেছি তা আমি জানি না। শৈশব থেকে বাল্যে, বাল্য থেকে যৌবনে আমার সারাজীবন ধরে আমি কী খুঁজে চলেছি। পাহাড়ে প্রান্তরে, জলে-স্থলে, সুন্দর-অসুন্দরে, রূপে-অরূপে, ইন্দ্রিয়ে ও অতীন্দ্রিয়ের মাঝে কী খুঁজেছি আমি? যা খুঁজেছি তা কি আমি পেয়েছি কোনওদিন? তা কি কেউ পায়?
গাড়ি এড়িয়ে চলেছে। চালকের হাতে লাগাম ধরা। আমার মনে হলো, কোনও এক অদৃশ্য দেবতার দ্বারা প্রহৃত হতে হতে অবিরাম কালের অশ্ব ছুটে চলেছে সারা বিশ্বজীবনের বিপুলতায়তন বেগভার নিয়ে। সেই আশ্চর্য অশ্বের লাগাম ধরার শক্তি সবার নেই। হয়তো কোনও মানুষেরই নেই। তবু মানুষের মতো বাঁচতে হলে সে লাগামটা শক্ত মুঠিতে ধরে রাখতেই হবে।
উইলেম মেস্তার (উপন্যাস)
উইলেম মেস্তার (উপন্যাস)
প্রথম পরিচ্ছেদ
নাটকটা ভাঙতে দেরি হচ্ছিল। সাজঘরের জানালা দিয়ে মঞ্চের দিকে বারবার তাকাচ্ছিল বারবারা। আজ তার মালিক সুন্দরী মেরিয়ানা এক ছোকরা অফিসারের অভিনয় করে প্রচুর আনন্দ দান করেছে দর্শকদের। কিন্তু মেরিয়ানার জন্য বারবারা অধৈর্য হয়ে পড়েছে অন্য কারণে। মেরিয়ানার গুণে মুগ্ধ ধনী ব্যবসায়ীর পুত্র নৰ্বার্গ একটা প্যাকেট পাঠিয়েছে ডাকে।