এমন সময় সেই চিরকুট নিয়ে ওয়ার্দারের লোক এল। চিরকুট দেখে আলবার্ত নীরসভাবে তার স্ত্রীকে বলল, পিস্তল দুটো দিয়ে দাও। আমি তার শুভযাত্ৰা কামনা করি।
কিন্তু কথাটা বজ্রপাতের মতো শোনাল লোত্তের কানে। নানারকম বিপদের আভাসে আচ্ছন্ন হয়ে উঠল তার অন্তর। এক অব্যক্ত অনির্বচনীয় বেদনায় ভরে গেল তার মন। কিন্তু কোনও কথা বলতে পারল না সে। সে নীরবে ঘরে গিয়ে দেওয়ালের তাক থেকে পিস্তল দুটো বার করে ঝেড়ে মুছে ওয়ার্দারের লোকটার হাতে তুলে দিল যন্ত্রচালিতের মতো। একবার লোত্তের মনে হলো তার স্বামীর পায়ের উপর পড়ে। গতকাল যা যা হয়েছে সব বলবে। কিন্তু পরে আবার ভাবল তাতে কোনও ফল হবে না। আলবার্তকে অনুরোধ করলেও সে ওয়ার্দারের কাছে যাবে না।
খাবার টেবিলে সাজানো হলো। লোত্তের বান্ধবী এসেছিল। তার সঙ্গে কিছু কথা বলে কিছুটা হালকা হলো লোত্তে।
এদিকে পিস্তল পেয়ে সেগুলো আগ্রহভরে নিল ওয়ার্দার। যখন শুনল সেগুলো লোত্তে লোকটার হাতে তুলে দিয়েছে তখন তার আনন্দ বেড়ে গেল। সে রুটি আর মদ আনিয়ে সেই ঘরে বসে খেল। তারপর কি লিখতে লাগল। সে লোত্তেকে লিখল :
এই পিস্তল দুটো তোমার হাতের ছোঁয়া পেয়েছে। তুমি তাদের গা থেকে ধুলো ঝেড়ে পরিষ্কার করেছ। আমি এগুলোকে তাই অসংখ্যবার চুম্বন করেছি। আমি আমার চাকরকে সব কথা খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করায় সে বলল তুমি পিস্তল দুটো যখন তার হাতে তুলে দাও তখন তোমার হাত কাঁপছিল। কিন্তু তুমি আমাকে বিদায় জানাওনি। তবে কি আমার প্রতি তোমার অন্তরের দরজাটা রুদ্ধ করে দিয়েছ? কিন্তু লোত্তে, আমার মনে যে ছাপ তুমি রেখেছ তা হাজার হাজার বছরেও মুছে যাবে না। যে তোমাকে এত জ্বালাচ্ছে তাকে তুমি ঘৃণা করতে পার না।
খাওয়ার পর কতকগুলো কাগজপত্র বেছে তা নষ্ট করে ফেলল। একবার বাইরে গিয়ে ঘুরে এল ওয়ার্দার। তখনও বৃষ্টি পড়ছিল। তবু বাইরে বেরিয়ে বেড়াতে বেড়াতে কাউন্টের বাগানবাড়ি পর্যন্ত চলে গেল ওয়ার্দার। তারপর বাসায় ফিরে এল। তারপর রাত্রিতে আবার দুটো চিঠি লিখল। একটা উইলেম আর একটা আলবার্তকে। উইলেমকে লিখল, শেষবারের মতো মাঠ, বন আর আকাশটাকে দেখে এলাম। তোমাকে শেষবারের মতো বিদায় জানাচ্ছি উইলেম। আমাকে ক্ষমা করো। মাকে সান্ত্বনা দিও। ঈশ্বর তোমাদের মঙ্গল করুক। বিদায়। পরে সুদিন এলে দেখা হবে।
এরপর আলবার্তকে লিখল, তোমার দানের প্রতিদান ঠিকমতো দিতে পারলাম না আলবার্ত। এজন্য ক্ষমা করো আমায়। আমি তোমাদের মধ্যে অবিশ্বাস জাগিয়ে তোমাদের পারিবারিক শান্তি নষ্ট করেছি। আমার মৃত্যু যাতে তোমাদের সংসারে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে পারে তার জন্যই আমি মরছি। আলবার্ত, আমার দেবদূতকে সুখী করো। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন।
এরপর লোত্তেকে আবার একটা চিঠি লিখল ওয়ার্দার।
এখন আমার অন্তর চমৎকারভাবে শান্ত। হে ঈশ্বর, শেষ সময়ে আমাকে এই আত্মশক্তি দান করার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। জানালার ধারে গিয়ে মেঘের ফাঁকে ফাঁকে কিছু নক্ষত্র দেখলাম। লোত্তে, গতকালও তোমার ঘর থেকে বেরিয়ে ওদের দেখেছিলাম। ওদের দেখে তোমার কথা মনে পড়ল।
আমি তোমার বাবাকে একটা চিঠিতে জানিয়েছি চার্চের উঠোনে সমাধিভূমিতে যে দুটো লাইম গাছ আছে কোণের দিকে, আমার দেহটা যেন সেইখানে সমাহিত করা হয়। আশা করি তিনি তার বন্ধুর জন্য এটুকু অন্তত করবেন। আমার ইচ্ছা ছিল কোনও পথের ধারে অথবা কোনও নির্জন উপত্যকাভূমিতে আমার দেহটাকে সমাহিত করা হবে।
এবার যে মৃত্যুর পেয়ালা তুমি নিজের হাতে তুলে দিয়েছ লোত্তে, আমি তা প্রাণভরে পান করব। আমি তোমার জন্য মৃত্যুবরণ করছি। তোমার জন্য আত্মত্যাগ করছি–একথা ভেবে এ মৃত্যুতে আনন্দবোধ করছি আমি। প্রিয়জনের জন্য জীবনদান করার ঘটনা এমন কিছু নূতন নয়। আমি এই পোশাক পরেই মরব। এ পোশাক তোমার স্পর্শে পবিত্র হয়ে আছে। যে গোলাপটি তুমি আমার জন্মদিনে দান করেছিলে সে গোলাপটি আমার মৃতদেহের সঙ্গে সমাহিত হবে কবরে। তুমি শান্তভাবে সব কিছু সহ্য করবে।
পিস্তল দুটো গুলিভর্তি আছে। এখন রাত্রি বারোটা বাজে। বিদায়, লোত্তে, বিদায়।
ঐ সময় জনৈক প্রতিবেশী ওয়ার্দারের ঘরে গুলির শব্দ শোনে এবং আগুনের একটা ঝিলিক দেখে। কিন্তু তা শুধু মুহূর্তে জন্য। পর পরমুহূর্তে সব চুপ হয়ে যায়।
পরদিন সকাল ছটায় সময় ওয়ার্দারের চাকর বাতি হাতে তার ঘরে ঢোকে। ঢুকেই দেখে ওয়ার্দার মেঝের উপর পড়ে রয়েছে। তার মাথা থেকে রক্ত ঝরছে এবং তার পাশে একটা পিস্তল পড়ে রয়েছে। সে তখন ওয়ার্দারের দেহটা ধরে নাড়া দেয়। কিন্তু সে দেহ নিথর নিস্পন্দ। শুধু তার গলা থেকে ঘর্ষর একটা আওয়াজ হচ্ছিল। সে তখন ছুটে গিয়ে ডাক্তার ডাকে। আলবার্তকে খবর দেয়। কথাটা শুনে আলবার্তের সামনেই মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে লোত্তে।
ডাক্তার এসে ওয়ার্দারকে পরীক্ষা করে দেখল কোনও আশা নেই। তার নাড়ীতে তখনও অবশ্য স্পন্দন ছিল। কিন্তু অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো অসাড় হয়ে গেছে। ওয়ার্দার তার ডান চোখের পাশ দিয়ে রগের ভিতর গুলি করেছে। তার মাথার ভিতরটা গুড়ো গুড়ো হয়ে গেছে। তার হাতে আর চেয়ারে রক্ত লেগে ছিল। এর থেকে বোঝা গেছে যে টেবিলের কাছে চেয়ারে বসে গুলি করেছে নিজের মাথায়। তারপর সে চেয়ার থেকে মেঝেয় গড়িয়ে পড়ে যায়। তার পায়ে জুতো ছিল আর পরনে ছিল প্যান্ট, নীল কোট আর হলুদ রঙের ওয়েস্ট কোট।