আমাকে ক্ষমা করো। আমি গতকালই সর্বপ্রথম আমার অস্তিত্বের গভীরতম প্রদেশ হতে এক সংশয়হীন সত্য এক প্রবল আবেগে সিক্ত হয়ে বেরিয়ে আসি। আমি সন্দেহাতীতভাবে বুঝতে পারি তুমি আমাকে ভালোবাস। তুমি আমাকে ভালোবাস। তোমার ওষ্ঠাধর থেকে যে উত্তাপ বেরিয়ে আসে, সে উত্তাপ আমার ওষ্ঠাধরকেও পুড়িয়ে দেয়। আমার অন্তরকেও স্পর্শ করে। তবু বলছি ক্ষমা করো আমায়।
তুমি আমাকে ভালোবাস একথা আমি জেনেছিলাম আমার প্রতি তোমার চাউনি দেখে, আমার হাতের উপর তোমার হাতের চাপ দেখে। তবু তোমার পাশে যখনি। আলবার্তকে দেখতাম তখুনি এক উত্তপ্ত সংশয় হতাশ করে তুলত আমায়। আচ্ছন্ন করে তুলত আমার মনকে।
তোমার মনে আছে, তুমি যখন আমাকে মুখে কোনও ভালোবাসার কথা বলতে না অথবা তোমার হাত স্পর্শ করতে দিতে না, তখন তুমি মাঝে মাঝে কিছু ফুল দিতে।
সেই ফুল আমি রাত্রিতে ঘরে রেখে তার সামনে অর্ধেক রাত নতজানু হয়ে বসে থাকতাম। সে ফুলের মধ্যে আমি পেতাম তোমার ভালোবাসার অভ্রান্ত স্বাক্ষর। কিন্তু এই বোধ আমার বেশিক্ষণ স্থায়ী হতো না। কারণ এই সব পবিত্র প্রতাঁকের মাধ্যমে ঈশ্বরের যে কৃপা ঝরে পড়ত আমার উপর তাতে বিশ্বাস আমি ক্রমশই হারিয়ে ফেলতাম।
ভালোবাসার এই সব স্বাক্ষর যত পবিত্রই হোক তা ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু গতকাল তোমার ওষ্ঠাধরে প্রেমের যে উত্তপ্ত নির্যাস আমি লাভ করি, আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে অনুভব করি, কোনও অবস্থাই তা তুলনীয় নয়। আমার এই বাহু তাকে আলিঙ্গন করেছে। আমার এই ওষ্ঠ তার ওষ্ঠ স্পর্শ করেছে, এই মুখ তার মুখ চুম্বন করেছে। তুমি আমার। হা লোত্তে, তুমি চিরকালের জন্য আমার।
তাহলে আলবার্ত তোমার স্বামী–এ কথার অর্থ কি? তার মানে এই কি যে তোমাকে ভালোবাসা পাপ? তার মানে এই যে আমি তোমাকে তার কাছ থেকে ছিনিয়ে আনতে চাই এবং তোমাকে ভালোবেসে আমি পাপ করেছি। তা হোক, এটা যদি পাপ হয় তাহলে এ পাপের স্বর্গীয় সুষমা আমি প্রাণভরে আস্বাদন করতে চাই। তাহলে তাতে আমি শক্তি পাব মনে। আমি আমার ও তোমার পরম পিতার কাছে চলে যাচ্ছি নির্ধারিত সময়ের আগেই। যতদিন পর্যন্ত তুমি সেখানে না যাও এবং আমি তোমাকে তাঁর সামনে অন্তহীন আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরতে না পারি ততদিন আমাদের সেই পরম পিতাই আমাকে সান্ত্বনা দেবেন।
এটা কোনও স্বপ্ন বা ভ্রান্তি নয়। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমি অনেক কিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। আমি বেশ জানি আমাদের আবার দেখা হবেই। আমি গিয়ে তোমার মার সঙ্গে দেখা করব। তিনি নিশ্চয়ই দেখতে তোমার মতোই। আমি তাকে আমার সব কথা খুলে বলব।
বেলা এগারোটা নাগাদ ওয়ার্দার তার চাকরকে জিজ্ঞাসা করল আলবার্ত বাড়ি ফিরেছে কি না। চাকর বলল, ফিরেছে। তার ঘোড়া সে দেখতে পেয়েছে। ওয়ার্দার তখন একটা চিরকুট লিখে চাকরের হাতে দিয়ে আলবার্তের কাছে পাঠাল। তাতে লিখল, আমি বাইরে যাচ্ছি কিছুদিনের জন্য, তোমার পিস্তল দুটো দেবে। বিদায়।
সই না করে চিরকুটটা পাঠিয়ে দিল ওয়ার্দার।
এদিকে গত সন্ধের সময় সেই ঘটনা ঘটার পর থেকে সারারাত ধরে একটু ঘুমোতে পারেনি লোত্তে। পরস্পরবিরোধী ভাবের দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছিল তার অন্তর। একদিকে ওয়ার্দারের নিবিড় আলিঙ্গনের পর থেকে তার প্রতি ভালোবাসার আবেগটাকে দূরীভূত করতে পারছিল না কিছুতেই; আবার তার অতীতের নিষ্পাপ নিষ্কলুষ নারীজীবনের হারানো শুচিতার জন্য দুঃখ হচ্ছিল। আলবার্ত ফিরে এসে ওয়ার্দারের আসার কথা জানতে পেরে বিরক্ত হয়ে নানারকম প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবে, তাতে উপহাস করবে, তার মুখে ক্রোধের ছায়া ফুটে উঠবে। এসব কথা মনে করে ভয় পেয়ে গেল লোত্তে। সে কখনও মিথ্যা কথা বলেনি জীবনে। কিন্তু আজ আলবার্তের কাছে মিথ্যা কথা বলা ছাড়া কোনও উপায় নেই। তার ক্রমবর্ধমান অস্বস্তি তার পাপটাকে বড় করে তুলল তার কাছে। তথাপি এ পাপের যে নায়ক তাকে অন্তরের
সঙ্গে ঘৃণা করতে পারল না অথবা তার মুখ কখনও দেখবে না সে প্রতিজ্ঞাও করতে পারল না। সারারাত অতন্দ্রভাবে চোখের জল ফেলে কাটিয়ে শেষ রাতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল লোত্তে। সকালে উঠতেই দেখল আলবার্ত এসে গেছে। আলবার্তের উপস্থিতিটা আজ প্রথম অসহ্য ঠেকল তার কাছে। পাছে তার চোখ-মুখ দেখে তার নিদ্রাহীনতার কথা জানতে পারে আলবার্ত এই ভয়ে কাঁদতে লাগল লোত্তে। সে। আলবার্তকে বেশ নিবিড় করে জড়িয়ে ধরল। সে আলিঙ্গনের মধ্যে আনন্দের আবেগের থেকে ভয় আর দুশ্চিন্তাটাই প্রকট হয়ে উঠল। আলবার্ত তাকে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে অথবা কেউ এসেছিল কিনা। লোত্তে সত্যি কথা বলল। বলল গতকাল ঘণ্টাখানেকের জন্য ওয়ার্দার এখানে এসেছিল। তখন আলবার্ত বলল, সে এখানে। আসার সময়টাও ঠিক বেছে নেয়।
এই কথা বলে তার পড়ার ঘরে গেল আলবার্ত। লোত্তে তার কাছে গিয়ে তার কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞাসা করল। আলবার্ত নীরসভাবে উত্তর করল তার কিছু লাগবে না। সে আপন মনে কি লিখতে লাগল। লোত্তে উন বুনতে লাগল। এইভাবে একঘণ্টা কেটে গেল। লোত্তে আলবার্তকে কি বলল। কিন্তু তার কোনও উত্তর দিল না আলবার্ত। লোত্তের মনে অনেক বিষণ্ণ চিন্তা ভিড় করে এল। তাতে তার দুঃখ আরও অনেক বেড়ে গেল। তার চোখে জল এল। সে মুখটা ঘুরিয়ে চোখের জল লুকোতে লাগল।