কলমা
এখন রাত্রিকাল! আমি একা! এই বিক্ষুব্ধ ঝড়-জলের মাঝে এই পাহাড়ে আমি একা। মাথা গোঁজার মতো কোথাও একটা কুঁড়েও নেই।
হে চাঁদ, হে নক্ষত্র, মেঘের আবরণ ছিঁড়ে বেরিয়ে এস। আমাকে আলো দিয়ে অন্তত একটু পথ দেখাও। আমার ক্লান্ত প্রেমাস্পদ কোথায় আছে তা দেখিয়ে দাও। আমি এই পাহাড়ের কোণে শ্যাওলাভরা ঝর্নার ধারে বসি। কিন্তু আমি তার কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি না কেন? কোথায় গেল আমার সালগাত? সে গর্জনশীল বাতাস, হে ঝর্নাধারা, তোমরা একটু চুপ করো। আমি আমার প্রেমাস্পদকে ডাকছি। তোমরা চুপ না করলে সে আমার ডাক শুনতে পাবে না। এই সেই গাছ, ঝর্নার ধারা, সেই পাথরের আসন। এখানেই সে আসবে বলেছিল। কিন্তু এল না। হে মৃত আত্মারা, তোমরা নির্জন গিরিকান্তার হতে কথা বলো। আমি মোটেই ভীত হব না। আমি সারারাত এইভাবে চোখের জলে কাটিয়ে মৃত্যুরবরণ করব। তোমাদের সমাধির পাশে আমাকে একটু স্থান দিও।
রাইনো
ঝড়-জল থেমে গেছে। এখন বেলা দ্বিপ্রহর। এখন চারদিক শান্ত। আকাশে খণ্ড খণ্ড মেষ ভেসে বেড়াচ্ছে। সবুজ পাহাড়ের মাথার উপর সূর্য দেখা যাচ্ছে। ঝর্নার মিষ্টি কলতানের থেকেও মিষ্টি কার কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছ আমি? এ কণ্ঠস্বর সঙ্গীতের সন্তান। আলপিনের। সে আলপিন, এই নির্জন পাহাড়ে একা তুমি কি করছ?
আলপিন
হে রাইনো, আমি মৃতদের জন্য চোখের জল ফেলছি। আমার মৃত প্রিয়জনের জন্য দুঃখে গান গাইছি।
ওয়ার্দারের আবৃত্তি শুনতে শুনতে লোত্তের চোখে জল ঝরে পড়ছিল। এত দুঃখের কথা কখনও শোনেনি সে। তার চোখে জল দেখে ওয়ার্দারের পড়া বন্ধ হয়ে গেল। সে লোত্তের একটি হাত টেনে নিয়ে তার চোখের জলে ভিজিয়ে দিল। ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে লোত্তে ওয়ার্দাররকে আরও পড়ে যেতে বলল। ওয়ার্দার আবার পড়তে লাগল, কেন তুমি আমায় জাগাচ্ছ হে বসন্ত বাতাস? আমার পাতায় যে শিশিরবিন্দু ঝরে পড়ে তাতে তুমি শীতল হও। কিন্তু আমার দিন শেষ হয়ে এসেছে। তুষারঝড়ে আমার পাতাগুলো সব ঝরে পড়ছে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। যে পথিক একদিন আমার যৌবনসৌন্দর্য দেখে বিমুগ্ধ হয়েছিল সে কাল আসবে, আমাকে খুঁজবে। কিন্তু দেখতে পাবে না।
নিজেকে আর সামলাতে পারল না ওয়ার্দার। লোত্তের পায়ের কাছে পড়ে গেল। লোত্তের হাত দুটো টেনে নিয়ে নিজের চোখ ও কপালে চেপে ধরল। ফলে লোত্তের মাথাটা ঘুরে গেল। সব ভাবনাচিন্তা ওলটপালট হয়ে গেল। উল্টে গেল তার মনের কাঠামোটা। সেও সহসা উত্তেজিত হয়ে ওয়ার্দারের হাত দুটো টেনে নিয়ে নিজের বুকের উপর চেপে ধরল। তার গালটা ওয়ার্দারের গালে ঠেকল। ওয়ার্দার তখন লোত্তের হাত দুটো নিয়ে নিজের বুকে চেপে ধরে তার কম্পমান উত্তপ্ত ঠোঁটদুটো অসংখ্য চুম্বনে ভরিয়ে দিল।
এবার হুঁশ হলো লোত্তের। সে শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে ডাকল, ওয়ার্দার! সে নিজেকে ওয়ার্দারের আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করার জন্য সচেতনভাবে চেষ্টা করল।
ওয়ার্দার আর তাকে আটকে রাখল না। তাকে ছেড়ে তার পায়ের তলায় নতজানু হয়ে বসে পড়ল। লোত্তে তখন ভালোবাসা আর ক্রোধ এই দুই পরস্পরবিরুদ্ধ ভাবের। দ্বন্দ্বে কাঁপছিল। কম্পিত কণ্ঠে সে বলল, ওয়ার্দার, মনে রেখো এই আমাদের শেষ দেখা।
এই বলে সে শেষবারের মতো ওয়ার্দারের পানে তাকিয়ে পাশের ঘরে ছুটে চলে গেল। তাকে মরিয়া হয়ে ধরার জন্য হাত দুটো একবার শূন্যে বাড়িয়ে দিল ওয়ার্দার। কিন্তু তখন লোত্তে পাশের ঘরে গিয়ে খিল দিয়ে দিয়েছে।
ঘরের মেঝের উপর হতাশ হয়ে আধঘন্টা মতো শুয়ে রইল ওয়ার্দার। পরে হুঁশ হতে সে পাশের ঘরের রুদ্ধ দরজায় বাইরে থেকে ডাকল, লোত্তে, শোনো একবার। বিদায়কালে শুধু একটা কথা বলতে চাই।
কিন্তু লোত্তে কোনও উত্তর দিল না। তখন হতাশ হয়ে ওয়ার্দার চলে গেল। শুধু বলে গেল, চিরদিনের জন্য বিদায় লোত্তে।
লোত্তেদের বাড়ি থেকে সোজা শহরে চলে গেল ওয়ার্দার। তখন বৃষ্টি পড়ছিল গুঁড়িগুড়ি। তার উপর তুষারপাতও হচ্ছিল। ওয়ার্দার যখন তার বাসায় পৌঁছল তখন রাত্রি এগারোটা। তার চাকর দরজা খুলে দিয়ে দেখল তার মাথায় টুপিটা কোথায় পড়ে গেছে। তার গায়ের জামাকাপড় সব ভিজে গেছে।
রাত্রে ভালোভাবে বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে ঘুমোল ওয়ার্দার। সকালে চাকরকে কফি বানাতে বলল। তারপর একখানা চিঠি লিখল লোত্তেকে।
এই শেষবারের মতো চোখের পাতা খুলে চাইছি সূর্যের পানে। আর কোনওদিন এই সকালের আলো প্রাণভরে উপভোগ করব না। কথাটা যেন সত্যিই স্বপ্নের মতো শুনাচ্ছে। জীবিত অবস্থায় মৃত্যুর কল্পনা বা চিন্তা অস্পষ্ট ধূসর এক তরল স্বপ্নের মতোই মনে হয়। কিন্তু আশ্চর্য কথা দেখ। আজ আমি এই মুহূর্তে আমার দেহ-মনের সব শক্তির নিবিড়তা নিয়ে বেঁচে রয়েছি। অথচ আগামীকাল সকালে আমার অসাড় দেহটা টান টান হয়ে ছড়িয়ে থাকবে। মৃত্যু। কিন্তু কথাটার মানে কি? কত মানুষ মরেছে, কত মানুষ জন্মেছে, তবু এই জন্মমৃত্যুর আদি-অন্তহীন চক্রবর্তনের আসল মানেটা কেউ আজও বুঝতে পারেনি।
আমি চলে যাব। তোমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব। সেই অন্ধকার সংকীর্ণ কবরে গিয়ে ঢুকে থাকব। কিন্তু চলে যাব মানে? কথাটা কি শুধু এক অর্থহীন শব্দ নয়? মৃত্যু, কবর–এসব কথার আমল মানে আমি সত্যিই বুঝি না।