ওয়ার্দার বলল, চমৎকার! বেশ চতুরের মতো কথা বলছ তো! কথাগুলো কি আলবার্ত শিখিয়ে দিয়েছে? লোত্তে বলল, কেন, একথা তো সবাই বলবে। জগতে মেয়ের অভাব নেই। একটু খোঁজ করলেই তোমার ভালোবাসার পাত্রীকে ঠিকই খুঁজে পাবে। খুঁজে নিয়ে এস। তখন আমাদের বন্ধুত্ব আরও সুখের হয়ে উঠবে।
ওয়ার্দার তখন বলল, আমাকে শুধু একটু সময় দাও। একটু বিশ্রাম করতে দাও। লোত্তে বলল, না, এখন না, তুমি খ্রিস্টের জন্মদিনের আগে এসো না। এমন সময় আলবার্ত এসে ঘরে ঢুকল। এতে আলবার্ট ও ওয়ার্দার দুজনেই অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। আলবার্ত লোত্তেকে কয়েকটা কাজের কথা জিজ্ঞাসা করে জানল সে কাজ হয়নি। তাতে সে লোত্তেকে তিরস্কারের ভাষায় কি বলল। ওয়ার্দার যাব যাব করেও আটটা পর্যন্ত রয়ে গেল। আলবার্ত তাকে নৈশভোজে আহ্বান করল। কিন্তু ওয়ার্দার টুপিটা তুলে নিয়ে না খেয়েই বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
নিজের বাসায় ফিরে নিজের ঘরে একা চলে গেল ওয়ার্দার। ঘরে ঢুকে কাঁদতে লাগল জোরে। আপন মনে কথা বলতে লাগল উত্তেজিতভাবে। চাকর এসে তার পায়ের জুতো খুলে দিল। ওয়ার্দার তার চাকরকে বলল, সকাল বেলায় তাকে না ডাকা পর্যন্ত সে যেন ঘরে না আসে।
২১শে ডিসেম্বর ছিল সোমবার। ঐদিন সকালে ওয়াদার লোত্তেকে একখানা চিঠি লেখে। চিঠিটা তার টেবিলে তার মৃত্যুর পর পাওয়া যায়। চিঠিখানা তুলে দিচ্ছি।
আমি আমার মনস্থির করে ফেলেছি। আমি মরতে চাই। এ কথা আমি তোমাকে বিনা আবেগে লিখছি শান্তভাবে ঠাণ্ডা মাথায়। এ চিঠি যখন পড়বে তখন থেকে আমাকে দেখতে পাবে না। হে প্রিয়তমা, তুমি যখন এ চিঠি পাবে তখন আমার মতো এক অশান্ত চঞ্চল লোকের চিরশান্ত কঠিন হিমশীতল মৃতদেহটা কবরে শায়িত হবে। আমার জীবনের শেষদিকে তোমার সঙ্গে কথা বলতে পেরেছি–এটাই আমার একমাত্র সান্ত্বনা। গত রাতটা আমি অতি কষ্টে কাটিয়েছি। রাত্রির কষ্ট আমার মৃত্যুবাসনাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। বুকে একরাশ উত্তেজনার আবেগ নিয়ে যখন তোমার কাছ থেকে চলে আসি তখন এক হিমশীতল শঙ্কায় শিউরে উঠছিল আমার অন্তরাত্মা। সঙ্গে সঙ্গে মনে অনেক সম্ভাবনা জাগলেও শেষ পর্যন্ত এক সিদ্ধান্তে আমি স্থির ও অনড় হয়ে উঠি। সে সিদ্ধান্ত হলো মৃত্যুর সিদ্ধান্ত। এ মৃত্যুর সিদ্ধান্ত আমি হতাশা থেকে করিনি, করেছি তোমার জন্য আত্মত্যাগের আদর্শের বশে। হা লোত্তে! কেন মরব না? আমাদের তিনজনের মধ্যে একজনকে যেতেই হবে। উন্মত্ততার বশবর্তী হয়ে মাঝে মাঝে তোমাকে ও আমার স্বামীকে খুন করার কথাও মনে হয়েছে আমার। সুতরাং আমাকে মরতেই হবে। কোনও এক সুন্দর বসন্ত সন্ধ্যায় যখন তুমি পাহাড়ে উঠতে উঠতে সামনে উপত্যকার পানে তাকাবে যেখানে আমি প্রায়ই বেড়াতে যেতাম তখন তুমি আমার কথা ভাববে এবং আমার কবরের পানে তাকিয়ে দেখবে। সুর্যাস্তের রঙে রাঙা আমার কবরের পাশের ঘাসগুলো বাতাসে দুলতে থাকবে তখন। চিঠিখানা শান্তভাবে লিখতে শুরু করি। কিন্তু এখন চোখে জল আসছে।
বেলা দশটার সময় তার চাকরকে ডাকল ওয়ার্দার। বলল সে দিনকতকের জন্য বাইরে যাচ্ছে। সব বইপত্র যাকে যা দেওয়া আছে তা যেন সব আনা হয়। ভিখারীদের সাপ্তাহিক বরাদ্দ যেন বেশি করে দিয়ে দেওয়া হয়। তার ঘরে দুপুরের খাবার খেয়ে ঘোড়ার চড়ে বেরিয়ে গেল। সোজা চলে গেল লোত্তের বাবার বাড়ি।
লোত্তের বাবা তখন বাড়ি ছিল না। তার ভাইবোনদের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলল। বড় ছেলেটা তাদের জন্য খ্রিস্টের আসন্ন জন্মদিন উপলক্ষে এক সাদর সম্ভাষণ। লিখেছে।
সেখান থেকে সোজা বাসায় ফিরে এল ওয়ার্দার। কিন্তু আবহাওয়া খারাপ থাকা সত্ত্বেও ছটায় সময় আবার বেরিয়ে গেল আলবার্তের বাড়ি। গিয়ে দেখল লোত্তে একা রয়েছে ঘরে। ওয়ার্দারকে অসময়ে দেখে ভয় পেয়ে গেল লোত্তে। এখন আলবার্ত বাড়ি নেই। ওয়ার্দারের সঙ্গে বসে কথা বললে আলবার্ত তাকে সন্দেহ করবে। তাই ঝিকে দিয়ে তার দুজন বান্ধবীকে ডাকতে পাঠাল। কিন্তু কাউকে পাওয়া গেল না। তখন হতাশ হয়ে ভাবতে লাগল। কিন্তু তার অন্তরের শুচিতায় নিজেই আশ্বাস পেল মনে মনে। ভাবল সে যখন অন্তরে খাঁটি, তার মনে যখন কোনও পাপ নেই, সে কাউকে কোনও ভয় করবে না। সে ওয়ার্দারের কাছে বসে থাকবে। আলবার্ত এলে সব কথা বলবে। এই ভেবে সে ওয়ার্দারের সোফায় গিয়ে বসল। ওয়ার্দার তাকে বইগুলো ফেরত। দিতে এসেছে। লোত্তে আবৃত্তি শোনাতে বলল। ওয়ার্দার পড়তে শুরু করল। বইটার নাম ‘দি সংস অব সেলমা’।
হে শেষরাতের তারা! মেঘের ভিতর থেকে তুমি মুখ তুলতেই তোমার আলো পশ্চিম দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ছে। পাহাড়ে শোনা যাচ্ছে তোমার শব্দহীন পদধ্বনি। সমতলভূমির পানে তাকিয়ে তুমি কি দেখছ? ঝড়ের শব্দ আসছে। সমুদ্রের ঢেউগুলো আছাড় খেয়ে পড়ছে দূরের পাহাড়ে। আমি আমার মৃত বন্ধুদের দেখতে পাচ্ছি। তাদের গান শুনতে পাচ্ছি। সেই পক্ককেশ বৃদ্ধ ইউলিন, রাইনো, আলপিন আর মিলানো। সেলমার ভোজের পর থেকে তোমরা কত বদলে গেছ!!
মিলানো এল তার উজ্জ্বল সৌন্দর্য নিয়ে। তার চোখে জল, মুখে বিষাদ। তার। এলো চুল বাতাসে উড়ছিল তার সকরুণ গান শুনে মৃতরাও বিষণ্ণ হয়ে পড়ল। কলমা এক পাহাড়ে পড়ে রইল। সালগাতের আসবে বলেছিল। কিন্তু রাত্রির অন্ধকার ঘন হয়ে উঠল। অথচ সে এল না। এবারে কলমার কথা শোনো।