চারদিকে তাকাতে গিয়ে একটা জায়গায় নজর পড়ল আমার। ফাঁকা প্রান্তরে একটা উইলো গাছের তলায় একদিন বেড়াতে বেড়াতে ক্লান্ত হয়ে লোত্তের সঙ্গে বসেছিলাম। জায়গাটা এখন জলে ডুবে গেছে। গাছটা কোথায় বুঝতেই পারছি না। আমার মনে হলো আমি যেন এমন এক অসহায় বৃদ্ধার মতো বসে আছি সে শুধু পরের কাছে রুটি ভিক্ষা করে তার নীরস নিরানন্দ জীবনটাকে অহেতুক দীর্ঘায়িত করে চলেছে।
ডিসেম্বর ১৭,
আমার নিজের আচরণে আমি নিজেই চমকে উঠছি বন্ধু। তার প্রতি আমার ভালোবাসা কি পবিত্র ভ্রাতৃসুলভ ভালোবাসা নয়? সে ভালোবাসার মধ্যে কি প্রাপপ্রবৃত্তি আছে? কিন্তু গত রাত্রিতে, একথা বলতে আমার কুণ্ঠবোধ হচ্ছে–আমি তাকে প্রবলভাবে চেপে ধরেছিলাম আমার বুকে। অসংখ্য চুম্বনে সিক্ত করে দিয়েছিলাম তার মুখ। আমার মাথাটা ঘুরছিল। আমি সব বুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছি। এক সপ্তা হলো আমি কথা বলতে পারি না। চোখে শুধু জল আসে। কোথাও কোনও শান্ত পাই না। এখন পৃথিবী থেকে চলে যেতে পারলেই ভালো।
(পাঠকের নিকট সম্পাদকের নিবেদন)।
ওয়ার্দারের শেষ জীবনের কাহিনীর উপদান আমি পেয়েছি লোত্তে, আলবার্ট আর তার চাকরের কাছ থেকে। সেই কাহিনীটি বলার জন্যই তার চিঠির প্রকাশ বন্ধ করে দিলাম।
ওয়ার্দারের প্রেমাবেগের ক্রমবর্ধমান প্রবলতা আলবার্ত ও তার স্ত্রীর মানসিক শান্তিতে ক্ষুণ্ণ করে তুলেছিল। আলবার্ট ক্রমশ ভাবতে শুরু করল ওয়ার্দারের এই ক্রমবর্ধমান প্রেমাবেগ লোত্তের মনটাকেও ক্রমশই প্রভাবিত করে তুলছে। ফলে ওয়ার্দারের প্রতি আলবার্তের মনটা বিষিয়ে যেতে লাগল ক্রমশ। লোত্তের ঘরে যতক্ষণ ওয়ার্দার থাকত ততক্ষণ সে ঘরে যেত না আলবার্ত। একদিন সে তার স্ত্রীকে স্পষ্ট বলে দিল, ওয়ার্দার যেন এত ঘন ঘন তার কাছে না আসে। সেটা লোকচক্ষে দৃষ্টিকটু ঠেকছে।
কথাটা হয়ত জানতে পারে ওয়ার্দার। এই সময় তার আত্মহতার ইচ্ছাটা প্রবল হয়ে ওঠে। লোত্তের কাছে দ্বিতীয়বার ফিরে আসার পর থেকেই এ ইচ্ছাটা জাগে তার মধ্যে। এর সঙ্গে হঠকারিতার কোনও সম্পর্ক ছিল না। সে ঠাণ্ডা মাথাতেই এ কাজ করতে চেয়েছিল। তার মনের মধ্যে কি ধরনের অন্তর্দ্বন্দ্ব চলছিল তা উইলেমকে লেখা তারিখবিহীন একটি চিঠির প্রথম অংশ থেকে জানা যাবে। ওয়ার্দার লিখেছে, তার উপস্থিতি আর আমার প্রতি সহানুভূতি আমার উত্তপ্ত মস্তিষ্ক থেকে শেষ অশ্রুবিন্দুটুকুকেও টেনে বার করে নিয়েছে। এবার যবনিকা সরিয়ে পিছনে পা ফেলে যাওয়া। কিসের ভয়, কিসের কুণ্ঠা? কারণ পিছনে কি আছে তা আমরা জানি না, কারণ সেখান থেকে ফিরে আসা যায় না। আর একটা কারণ এই যে, মানুষের মনের গঠন প্রকৃতিটাই এমনি। যেখানে আমরা নির্দিষ্ট ও নিশ্চিত করে জানি না কি আছে সেখানে, যত সংশয় আর শঙ্কার অন্ধকার ভিড় করে আসে।
রাষ্ট্রদূত অফিসের চাকরির ব্যাপারটা চাকরি ও রাজনীতিক কাজকর্মের প্রতি তার বিতৃষ্ণাটা বাড়িয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে তার ব্যর্থ প্রেমাবেগের আতিশয্যও বেড়ে যায় তার মনে ভীষণভাবে। এই আবেগের আতিশয্য তার সব প্রাণশক্তি ক্ষয় করে ফেলে ধীরে ধীরে। সে তার প্রেমাস্পদের মনের ভারসাম্যও নষ্ট করে ফেলে। তার এই প্রাণশক্তির নিদারুণ অপচয় এবং তার অসংযত প্রেমাবেগের ধ্বংসাত্মক পরিণতিই অবশেষে তাকে এই ভয়ঙ্কর কাজে প্রবৃত্ত করে।
ডিসেম্বর ২০,
আমার প্রতি তোমার ভালোবাসার জন্য ধন্যবাদ উইলেম। তুমি আমাকে তোমার কাছে যেতে লিখেছ। এতে আমি কিন্তু সন্তুষ্ট হতে পারলাম না। তুমি আমাকে নিতে আসবে জেনে খুশি হলাম। তবে কিছুদিন অর্থাৎ একপক্ষকাল দেরি করতে হবে। এখন এখানে বরফ পড়ছে। রাস্তাঘাট খারাপ। আমি তোমাকে চিঠি দেব। আমার চিঠি পেলে আসবে। মাকে তাঁর সন্তানের জন্য প্রার্থনা করতে বলবে। তিনি যেন আমার সব অপরাধ ক্ষমা করেন। আমরা যারা হিতাকাঙ্ক্ষী তারা আমার থেকে কষ্ট পায়–এটাই আমার ভাগ্যে আছে। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন।
সেদিন ছিল রবিবার। খ্রিস্টের জন্মদিনের আগে। সে গিয়েছিল লোত্তের কাছে। লোত্তে তার ভাই-বোনদের পাওয়া উপহারের পুতুলগুলো গুছিয়ে রাখছিল। ছেলেদের উপহার আর তাদের আনন্দ নিয়ে কথা বলছিল ওয়ার্দার। লোত্তে একসময় বলল, তুমি যদি ভালোভাবে চলো, তোমার আচরণ শোভন ও মঙ্গলজনক হয় তাহলে তুমিও অনেক সুন্দর উপহার পাবে। ওয়ার্দার তখন প্রশ্ন করল লোত্তেকে, ভালো আচরণ বলতে কি চাও? আমাকে কি করতে হবে? লোত্তে বলল, আগামী বৃহস্পতিবার খ্রিস্টের জন্মদিন। ঐদিন সন্ধ্যায় তুমি আসবে, তার আগে নয়। আমার মনের শান্তির খাতিরে অন্তত নিজেকে সংযত করো। এভাবে আর চলে না।
কথাটা গভীর রেখাপাত করে ওয়ার্দারের মনে। সে অশান্তভাবে পায়চারি করতে থাকে ঘরে। লোত্তে বুঝতে পেরে প্রথমটা পালাবার চেষ্টা করে। কিন্তু কোনও ফল হলো না। ওয়ার্দার স্পষ্ট বলল, না লোত্তে, তোমার সঙ্গে আর আমার কোনওদিন দেখা হবে না।
লোত্তে ব্যস্তভাবে বলল, কেন হবে না? অবশ্যই হবে, তবে শুধু নিজেকে একটু সংযত করে চলো। ওয়ার্দারের কথাটা টেনে নিয়ে লোত্তে আবার বলল, কী ভয়ঙ্কর আবেগ নিয়েই না তুমি জন্মেছিলে! অথচ তোমার বুদ্ধি ও প্রতিভা আছে। কিন্তু শুধু একটু আত্মসংযমের অভাবে সব মাটি হয়ে যেতে বসেছে। তুমি আমার কথাটা একবার ভেবে দেখো ওয়ার্দার। শুধু আমার কথাটা। আমি এখন অপরের। আমাকে পাওয়া সম্ভব নয় বলেই আমাকে পাওয়ার কামনা এমন দুর্বার হয়ে উঠেছে তোমার মনে।