সে আমার দুঃখের কথা সব বোঝে। আজ তার চোখের দৃষ্টি আমার অন্তরের গভীরে চলে যায়। আজ সে একটা ছিল। আমি কোনও কথা বলিনি। সে নীরবে আমার মুখপানে তাকাল। কিন্তু আগের মতো তার চোখে-মুখে আর সে উজ্জ্বলতা খেলে যেতে দেখলাম না। তবে তার চোখে-মুখে আমার প্রতি সহানুভূতিটা আগের থেকে আরও গভীরভাবে ফুটে উঠেছিল। আমি কি তার পায়ে গড়িয়ে পড়ব? তার এই নিবিড় সহানুভূতির প্রতিদানস্বরূপ আমি তাকে অসংখ্য অভিনন্দন ও চুম্বনে তৃষিত করব না? সে হার্পসিকর্ড বাজিয়ে গান করতে লাগল। তার যে ওষ্ঠাধর থেকে মধুর সুর ও বাণী ঝরে পড়ছিল, সেই স্বর্গীয় সুষমামণ্ডিত ওষ্ঠাধর আমি চুম্বন করতে পারব না কখনও? কারণ আমি প্রতিজ্ঞা করেছি। তবু মনে হচ্ছে এ কাজ পাপের হলেও এ পাপ একবার করে সারা জীবন ধরে তার প্রায়শ্চিত্ত করে যাব আমি।
নভেম্বর ৩০,
আমি নিজেকে নিজে সামলাতে পারছি না। আত্মস্থ হতে পারছি না। যেখানেই যাচ্ছি আমি তার ভূত দেখছি যেন। হায কী দুর্ভাগ্যের কথা।
দুপুরের দিকে আমি গিয়েছিলাম নদীর ধার দিয়ে। যাবার কোনও ইচ্ছা ছিল না আমার। চারদিকে কেমন যেন একটা বিষাদের ভাব বিরাজ করছিল। হিমশীতল পশ্চিমা বায়ু বয়ে আসছিল পাহাড় থেকে। পাহাড় আর উপত্যকার উপর দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছিল ঝড়ো মেঘ। পাহাড়ের কোলে ঝোঁপ-ঝাড়ের ভিতরে একটা লোক ময়লা সবুজ কোট পরে গাছের শিকড় খুঁজে বেড়াচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কোনও দরকারী ওষধি খুঁজছে সে। আমি গেলাম তার কাছে। লোকটার চেহারার মধ্যে অদ্ভুত একটা বিষণ্ণ। ভাব ছিল। তার মাথার কালো চুল দুভাগ করে পিন দিয়ে আটকানো। দেখে মনে হলো লোকটি নিচু শ্রেণীর। আমি তার পেশার কথা জিজ্ঞাসা করলাম। সে বলল, সে নোজগে ফুল খুঁজছে। সে তার প্রিয়তমাকে উপহার দেবে। তার প্রিয়তমা ধনী। সম্পদশালিনী; সে শুধু ফুল চায়। কিন্তু শীতকালে সে ফুল পাচ্ছে না। সে আরও বলল, একদিন তার অবস্থা ভালো ছিল, এখন খারাপ হয়ে গেছে। এমন সময় এক বৃদ্ধা এসে লোকটির খোঁজ করতে লাগল। আমি বৃদ্ধাকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম লোকটি তার। ছেলে। এখন ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। বছর খানেক পাগলা গারদে ছিল। এখন। ছাড়া আছে। মারধোর করে না, এইভাবে কি সব খুঁজে বেড়ায় পাহাড়ে-জঙ্গলে।
আমি তখন লোকটির উদ্দেশ্যে বললাম, একদিন তুমি সুখী ছিলে। কিন্তু এটা তুমি বুঝতে পারছ না তোমার এই দুঃখ তোমার আপন অন্তর ও মস্তিষ্ক হতেই উদ্ভূত হচ্ছে।
কিন্তু রুগ্ন মানুষের রোগ নিয়াময় প্রচেষ্টাকে উপহাস করা উচিত নয়। তাকে পাগল বলে বিদ্রূপ করা উচিত নয়। হে ঈশ্বর, পরমপিতা, তুমিই আমাদের সৃষ্টি করেছ, আমাদের দুঃখের প্রতিকার এই পৃথিবীর সবখানেই ছড়িয়ে রেখেছে। হে পিতা, তুমি চুপ করে থেকো না আমার দুঃখে । আমি তোমার কাছে অকালে ফিরে যাচ্ছি। তুমি রাগ করো না। আমার যাত্রা গন্তব্যস্থলে গিয়ে শেষ না হতেই মাঝপথে থেমে যাচ্ছে। আমি ফিরে যাচ্ছি তোমার কাছে। এ পৃথিবীর সুখ-দুঃখ আশা-আকাঙ্ক্ষার আমার কোনও প্রয়োজন নেই। আমি যদি এইভাবে অকালে ফিরে যাই তাহলে আমাকে কি তুমি তাড়িয়ে দেবে?
ডিসেম্বর ১,
শোনো উইলেম, যে লোকটির কথা আমি তোমাকে সেদিন লিখেছিলাম সেই লোক লোত্তের বাবার অফিসে কাজ করত। সে কেরানি ছিল। সে মনে মনে লোত্তেকে ভালোবাসত। পরে কথাটা প্রকাশ করায় তার চাকরি যায়। তখন থেকে সে পাগল হয়ে যায়। কথাটা আমাকে জানায় আলবার্ত।
ডিসেম্বর ৪,
আমাকে ক্ষমা করো, আমি আর পারছি না। আমি আজ তার পাশে বসেছিলাম। সে গান গাইছিল। তার এক বোন আমার কোলের উপর বসে পুতুল নিয়ে খেলা করছিল। আমার চোখে জল আসছিল। তার হাতে বিয়ের আংটিটা দেখে আমার আরও কষ্ট হচ্ছিল। এমন সময় সে একটি পুরনো গান ধরল। সেই গানের সুরে অতীত সুখের দিনের কথা মনে পড়ল। আমার ব্যথা বেড়ে গেল। আমি তার কাছে গিয়ে তাকে অনুরোধ করলাম, দয়া করে গান থামাও, আমি আর পারছি না। সে বলল, ওয়ার্দার তোমার শরীর খারাপ। তুমি তোমার প্রিয় খাদ্য কিছুই খেতে পারছ না। আমি হঠাৎ চলে গেলাম তার কাছ থেকে।
ডিসেম্বর ৬,
তার ছবিটা সব জায়গায় দেখতে পাচ্ছি আমি। স্বপ্নে ও জাগরণে সব সময় তাকে দেখছি আমার চোখের সামনে। চোখ বন্ধ করলেই অন্ধকারে মনের পটে ছড়িয়ে রয়েছে তার ছবি। বিশেষ করে তার কালো চোখ দুটো অন্ধকার সমুদ্র বা খাদের মধ্যে প্রসারিত হয়ে থাকে আমার মুদ্রিত চোখের সামনে।
হায়, মানুষের জীবন কি অদ্ভুত! যখন সে ইন্দ্রিয়চেতনার শক্তিকে নিবিড়ভাবে চায় তখন সে শক্তি মিলিয়ে যায় ও বিলীন হয়ে যায়। অথচ যখন সে এ শক্তি চায় তখন শক্তি নিবিড় হয়ে ওঠে তার দেহে-মনে।
ডিসেম্বর ৮,
প্রিয় উইলেম, আমার অবস্থাটা এখন ঠিক ভূতে পাওয়া লোকের মতো। এখন যা আমার মনটাকে আচ্ছন্ন করে আছে তা ভয় বা কামনা নয়। শুধু এক ভয়ঙ্কর ক্রোধ যেন আমার বুকটাকে ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে, আমার গলাটাকে ধরে টিপতে চাইছে। সত্যিই আমি বড় হতভাগ্য। রাত্রিতে আমি প্রায়ই পথে পথে ঘুরে বেড়াই।
গত রাতে আমি বাইরে বেরিয়ে যাই। আমি শুনেছিলাম, নদীতে বান এসেছে। কূল ছাপিয়ে নদীর জল ওয়ালহেম গায়ের চারদিক প্লাবিত করে তুলেছে। আমি রাত্রি এগারোটার সময় বাইরে যাই। কী ভয়ঙ্কর দৃশ্য! প্রবল বন্যায় প্লাবিত সমস্ত উপত্যকাটা এক সমুদ্রের রূপ ধারণ করেছে। তার উপর ঝড় বইছে। তবে চাঁদের আলো ছিল আকাশে। সে আলোয় বন্যার রূপটাও আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিল। আমার কেবলি মনে হচ্ছিল ঝড়ে আকাশের মেঘগুলো ছিঁড়েখুড়ে গিয়ে মর্ত্যে নেমে এসে বন্যার ব্যাপ্ত জলধারাকে আলিঙ্গন করুক। মনে হলো তাহলে আমি শান্তি পাব।