অক্টোবর ১৯,
হায়, আমার বুকের ভিতরে কি এক বিরাট শূন্যতা! আমার কেবল মনে হয় আমি যদি একবার এই বুকে তাকে চেপে ধরতে পারতাম, তাহলে আমার সব শূন্যতা পূরণ হয়ে যেত।
অক্টোবর ২৬,
লোত্তের এক বন্ধু দেখা করতে এসেছিল তার সঙ্গে। আমি পাশের ঘরে গিয়ে বই পড়তে লাগলাম। কিন্তু পড়া হলো না। আমি তাদের কথা শুনতে লাগলাম। ওরা। শহরের এক গরিব হতভাগ্য দম্পতির কথা বলাবলি করছিল। স্ত্রীর কাশি হয়েছে, ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে। স্বামীটিও ভুগছে, তার হাত-পা ফুলে গেছে। ওরা দুজনেই মরবে।
আমি একা একা ঘরে বসে ভাবতে লাগলাম। এই ঘরে লোত্তের কাপড়-জামা ছড়ানো আছে। তার কানের দুল রয়েছে টেবিলে। আলবার্তের কাগজপত্রও রয়েছে। আমিও যখন একদিন মরে যাব, এদের সবাইকে ছেড়ে চলে যাব, তখন কি এরা আমার কথা মনে রাখবে? হায়, মানুষের অস্তিত্ব কত ক্ষণভঙ্গুর! তার যে অস্তিত্বকে প্রিয়জনের মনে সুপ্রতিষ্ঠিত করে যায় সে অস্তিত্ব সেখানে বেশিদিন সুপ্রতিষ্ঠিত থাকে না। কোথাও হারিয়ে যায়, মিলিয়ে যায়। অক্টোবর ২৭,
আজকাল একটা কথা আমার প্রায়ই মনে হয়। কথাটা মনে হলেই দুঃখে বুকটাকে বিদীর্ণ করে ফেলতে ইচ্ছে হয়, মাথাটা ফাটাতে ইচ্ছে যায়। মানুষ কত স্বার্থপর। আমি যদি কাউকে ভালোবাসা না দিই তাহলে সে কখনই আমাকে ভালোবাসবে না, আমার অন্তর পরম আনন্দের প্রাচুর্যে পূর্ণ থাকলেও আমি অন্য কাউকে সুখী করার চেষ্টা করব না, আমার সে আনন্দের ভাগ দেব না–এটা কখনই উচিত নয়।
অক্টোবর ৩০,
আমি শত শতবার লোত্তেকে চুম্বন করতে গেছি। কিন্তু পারিনি। কোনও সুন্দর বস্তুকে দেখে মুগ্ধ হয়েও তাকে স্পর্শ না করে থাকটা যে কত কঠিন তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন।
নভেম্বর ৩,
প্রায় দিন রাত্রিতে ঘুমোতে ঘুমোতে আমার মনে হয় আমি আর জেগে উঠব না। কিন্তু সকাল হলেই রোজ জেগে উঠি অন্যদিনকার মতো। আমি যদি পরের উপর দোষ চাপিয়ে দিতে পারতাম তাহলে এতটা কষ্ট আমাকে পেতে হতো না। কিন্তু এই সব কিছুর জন্য আমি একা দায়ী–এই বোধ থেকে আমার কষ্ট আরও বেড়ে যায়। আমার কষ্টের মূল কারণ এই যে, আমার জীবনের একমাত্র আনন্দপ্রতিমা হারিয়ে গেছে অকালে। আমি যখন রোজ সকালে জানালা দিয়ে দূর পাহাড়ের দিকে তাকাই, যখন সকালের সোনা রোদ উপত্যকাভূমির উপর ছড়িয়ে থাকা কুয়াশা আর এঁকেবেকে এগিয়ে যাওয়া রূপালি নদীর উপর ঝরে পড়ে তখন সেই মনোরম দৃশ্যের আনন্দ আমার অন্তর থেকে মস্তিষ্কে কেউ নিয়ে যেতে পারে না। আমার সমগ্র অন্তরটা শুকিয়ে যাওয়া ঝর্নার মতো শূন্য হয়ে পড়ে থাকে। ঈশ্বরের কাছে আমার চোখে কিছু অশ্রু দেখার জন্য প্রার্থনা করি, কৃষকরা যেমন বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করে।
কিন্তু পরে বুঝলাম ঈশ্বর কখনও আমাদের প্রার্থনা অনুসারে বৃষ্টি অথবা রোদ পাঠিয়ে দেন না। একদিন অতীতে ঈশ্বর আমাকে সুখ দিয়েছিলেন তার কারণ তখন আমার ঈশ্বরে বিশ্বাস ছিল। ভালো-মন্দ সব আবেগ ঈশ্বরের দান হিসাবে গ্রহণ করতাম আমি। তাই শান্তি পেতাম সব সময়।
নভেম্বর ৮,
আমার সংযম না থাকার জন্য আমাকে তিরস্কার করেছে সে। অবশ্য খুব মৃদুভাবে। অনেক সময় আমি একটু মদ্যপান করতে গিয়ে গোটা বোতলটা খেয়ে ফেলি। লোত্তে তখন বলে, না না, আর খেও না। আমি তখন বলি, তুমি যদি নিষেধ করো, তাহলে খাব না। তুমি সব সময় আমার আত্মার মাঝে উপস্থিত আছ।…আজ সে যখন গাড়ি থেকে নামে তখন আমি বসেছিলাম। সে এসেই প্রসঙ্গটা পাল্টে দেয়। তার উপর আমার কোনও হাত নেই। সে যা খুশি তাই করতে পারে।
নভেম্বর ১৫,
তোমার সৎ পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ উইলেম। তবে আমি তোমাকে শান্ত হতে বলছি। আমি শেষ পর্যন্ত সহ্য করে যেতে চাই। তুমি জান ধর্মের প্রতি আমার শ্রদ্ধা আছে। এই ধর্ম বহু আত্মার উপাদান, অনেক দুর্বল মানুষের আশ্রয়, কিন্তু তাই বলে কি সকলের ক্ষেত্রেই এই কথা প্রযোজ্য? বিরাট পৃথিবীতে তাকিয়ে দেখবে হাজার হাজার লোকের ক্ষেত্রে একথা খাটে না। তা যদি না খাটে তাহলে আমার জীবনেই বা খাটবে কেন? ঈশ্বরের পুত্র কি বলেননি যে ঈশ্বর যাদের দান করেছেন তাঁর হাতে তাঁরাই তাঁর কাছে থাকবে সব সময়। ভাগ্যে যা আছে তা সব সহ্য করতেই হবে তা সে যতই তিক্ত হোক না কেন। এখন আমার সারা ভবিষ্যৎ এক বিরাট শূন্যতা আর অন্ধকারে ভরা আর সেই অন্ধকারে আমার অতীত বিদ্যুতের মতো ঝিলিক দিয়ে যাচ্ছে। আর আমার সমগ্র অস্তিত্ব কেঁপে কেঁপে উঠছে। হে ঈশ্বর, তুমি কি আমাকে ত্যাগ করেছ?
নভেম্বর ২১,
সে বুঝতে পারে না, সে মাঝে মাঝে এক বিষ প্রস্তুত করে যে বিষ তার ও আমার দুজনেরই ধ্বংস ডেকে আনবে। সে যে বিষের পাত্র তুলে দেয় তাতে আমার ধ্বংস অনিবার্য জেনেও অবশ্য আমি তার সবটুকু পান করি। সে মাঝে মাঝে আমার পানে সদয় দৃষ্টিতে তাকায়। মাঝে মাঝে আমার দুঃখের প্রতি এক অনুচ্চারিত সহানুভূতি মূর্ত হয়ে ওঠে তার জযুগলের মধ্যে। গতকাল আমি যখন তার কাছ থেকে বিদায় নিই তখন সে আমার হাত ধরে বলে, বিদায় প্রিয় ওয়ার্দার! প্রিয় এই কথাটা প্রথম সে। বলে আমায়। কথাটা যেন আমার সমগ্র অস্থিমজ্জায় ঢুকে যায়। গতকাল বিছানায় শোবার সময় আপন মনে কথাটা উচ্চারণ করে চলি আমি। নভেম্বর ২৪,