মে ২৫,
আমার মনের একটা কথা গোপন করে রেখেছিলাম। সেটা তোমায় বলতে চাইনি। ভেবেছিলাম কাজটা হয়ে গেলে বলব। আমি যুদ্ধে যোগদান করতে চেয়েছিলাম। রাজকুমার নিজেই সামরিক লোক। আমি তাঁকে আমার ইচ্ছার কথা জানাতে তিনি এ বিষয়ে নিবৃত্ত করতে চাইলেন। অনেক যুক্তি দেখালেন।
জুন ১১,
যা বলো বলবে আমি আর থাকতে চাইছি না। কি হবে থেকে? আমার মোটেই ভালো লাগছে না। রাজকুমার আমাকে তার সমমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি হিসাবেই জ্ঞান করেন। তবু আমি সহজ হতে পারি না। স্বভাবের দিক থেকে আমাদের দুজনের মধ্যে অনেক তফাৎ। তার বুদ্ধি আছে কিন্তু সে বুদ্ধি নিচু স্তরের। আর এক সপ্তা মাত্র এখানে আছি। এখানে এসে একটা লাভ হয়েছে। আমি কিছু ছবি আঁকতে পেরেছি। তবে রাজকুমারের ছবির প্রতি আগ্রহ থাকলেও তার মনটা বিজ্ঞানভাবাপন্ন। কোনও ছবি। দেখলেই তাই একটা শ্রেণীগত নাম দিয়ে দেন। প্রথাগত রীতিতে সব কিছুর বিচার। করে থাকেন।
জুন ১৮,
কোথায় আমি যাচ্ছি? পরে তোমায় গোপনে বলব। এখানে এখনও একপক্ষকাল থাকতে হবে আমায়। তারপর এক খনি অঞ্চল দিয়ে বেড়াতে যাব। আসলে আমি যাব লোত্তেকে দেখতে। আবার তাকে একবার দেখব। কথাটা উপহাসের মতো শোনাচ্ছে। তবু এটা আমার অন্তরের দাবি আর সে দাবি মেটাতেই হবে।
জুলাই ১৯,
হে ঈশ্বর, তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ। তুমি তবে তাকে আমার স্ত্রী হিসাবে আমায় দান করো। তাহলে সারা জীবন আমি তোমার প্রার্থনায় কাটিয়ে দেব। সে যদি আমার স্ত্রী হয়, স্ত্রী হিসাবে আমার বাহুবন্ধনে ধরা দেয়–কথাটা ভাবতেও বুকটা কেঁপে উঠে। সঙ্গে সঙ্গে আলবার্ত যখন তার কোমরটা জড়িয়ে ধরে তখনকার কথাটা মনে পড়ে যায়।
কথাটা বলা কি উচিত হবে? কেন হবে না উইলেম? আমার সঙ্গে বিয়ে হলে লোত্তে আরও সুখী হতো। আলবার্ত ঠিক তার মনের সব বাসনা পূরণ করতে পারবে না। আমার সঙ্গে লোত্তের মনের সব বিষয়ে মিল হয়। কিন্তু আলবার্তের মনের মধ্যে কোথায় যেন একটা সূক্ষ্ম ব্যবধান আছে। অবশ্য আলবার্ত সমস্ত অন্তর দিয়ে ভালোবাসে লোত্তেকে।
আগস্ট ৪,
একা আমিই দুঃখ পাই না। এ পৃথিবীতে অনেকেরই অনেক আশা, অনেক কামনা-বাসনা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। সেই লাইম গায়ের তলায় যার কুঁড়ে সেই মেয়েটির বাড়ি সেদিন বেড়াতে গিয়েছিলাম। তার ছেলেটা আমায় ধরে নিয়ে গেল। মেয়েটি বলল, তার ছোট ছেলেটি মারা গেছে। তার স্বামী সুইজারল্যান্ডে থেকে হতাশ হয়ে ফিরে এসেছে। এখন সে অসুস্থ। আমি তার কথা শুনে খুব দুঃখ পেলাম। ছেলেটির হাতে কিছু পয়সা দিলাম। মেয়েটি আমাকে কিছু আপেল দিল জোর করে।
আগস্ট ২১,
মাঝে মাঝে জেগে-জেগে স্বপ্ন দেখি আমি। স্বপ্নের মাঝে আনন্দ পাই। কিন্তু সে আনন্দ ক্ষণিকের জন্য। এই ধরনের স্বপ্নের মাঝে মনে হয় আলবার্ত যদি মারা যায়। কিন্তু এই ভয়ঙ্কর কথাটা ভাবতে ভাবতে আমি এক অন্ধকার খাদের প্রান্তে চলে যাই। নিজেই শিউরে উঠি।
যে শহরের নাচের আসরে প্রথম লোত্তেকে নিয়ে আসি এবং যেখানে তার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হয়, সেই শহরের দ্বারপ্রান্তে সেদিন আবার গেলাম। কিন্তু অতীত সুখের দিনের কোনও চিহ্নই নেই সেখানে। সেদিনকার আনন্দের আবেগ বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই আমার মনে। আমার মনে হলো আমি যেন কোনও প্রেতাত্মা, মৃত্যুর পর আবার ছেড়ে যাওয়া প্রাসাদে ফিরে এসেছি।
সেপ্টেম্বর ৩,
আমি বুঝতে পারি আমি যখন তাকে এমন গভীরভাবে, এমন একান্তভাবে ভালোবাসি তখন কি করে তাকে অন্য লোকে ভালোবাসতে পারে। আমি তো তাকে ছাড়া আর কাউকে জানি না। জানতে চাই না।
সেপ্টেম্বর ৬,
আমার একবার ইচ্ছা হলো সেই পুরনো কোটটা পরি। এই নীল কোটটা পরে আমি একদিন লোত্তের সঙ্গে তার হাত ধরে নেচেছিলাম। কোটটা তাই প্রিয় আমার। কাছে। ওটাকে আজও ভালোবাসি। কিন্তু সেটা পুরনো হয়ে গেছে। আর একটা কোট আমি করিয়েছি।
সেপ্টেম্বর ১৫,
মাঝে মাঝে শয়তান আর নরকের কুকুরের বেয়াদপি সহ্য করা ছাড়া কোনও উপায় থাকে না। তোমার মনে আছে চার্চের কাছে সেই বাদাম গাছগুলোর তলায় আমি কতদিন লোত্তের সঙ্গে বসে থেকেছি। যাজক সেই গাছগুলোকে একদিন নিজের হাতে বসান। সেই সব গাছের ডালপালাগুলো বড় হয়ে চারদিকে সারা উঠোনটাকে। ছায়াশীতল করে রাখত। কিন্তু এবার গিয়ে দেখলাম সেই সব গাছগুলো কাটা হয়ে গেছে। মন্ত্রীর স্ত্রীর হুকুম। কথাটা শুনে রাগ হলো আমার। গাঁয়ের সব লোকই এতে ক্ষুব্ধ। কিন্তু কোনোও উপায় নেই। মন্ত্রীর স্ত্রীর অসুবিধা হচ্ছিল গাছগুলো থাকাতে, ছেলেরা বাদাম পাড়ত। গাছের ডালে আলো-বাতাস আটকাত। তাই তার সহ্য হয়নি।
অক্টোবর ১০,
যদি আমি একবার তার কালো চোখের পানে তাকাই তাহলে সব দুঃখ দূর হয়ে যাবে আমার। সবচেয়ে আমার দুঃখ এই যে আলবার্ট আগের মতো আমার কাছে সহজ হতে পারে না।
অক্টোবর ১২,
হোমার আমার অন্তরকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছেন। এই মহান প্রতিভাধর কবি কি এক অলৌকিক মায়াময় জগতেই না আমার মনটাকে নিয়ে যান। আমি যেন ঘুরতে ঘুরতে ঝড়ের প্রহারে ক্রমাগত জর্জরিত ও প্রেতাত্মা অধূষিত কুয়াশাচ্ছন্ন এক বিশাল প্রান্তরে এসে পড়েছি। মনে হচ্ছে যেন প্রেমবিধুরা কোনও নিঃসঙ্গ কুমারী তার মৃত প্রণয়ীর তৃণাচ্ছন্ন সমাধি প্রান্তরের উপর বসে অশ্রুবর্ষণ করছে নির্জনে। আমার মনে হয় যেন কোনও বৃদ্ধ চারণ কবি এক শূন্য প্রান্তরে তার পূর্বপুরুষদের সমাধিভূমির মাঝে তাদের কায়াহীন অশরীরী উপস্থিতির মাঝে এক অতিসূক্ষ্ম আত্মিক আনন্দে বিভোর হয়ে হিমশীতল পৃথিবীর পানে তাকিয়ে আছে তার আপন মনে চিৎকার করে বলছে, আমার কবরের উপর দিয়ে কোনো পথিক হেঁটে যেতে যেতে হয়ত আমার কথা মনে করবে, হয়ত বৃথাই আমার খোঁজ করবে।