আমি আমার কাব্যচর্চা করে গেলেও লিলির সংস্পর্শে আসার পর কিছু গান লিখেছিলাম। এ গান কেউ শুনলে বা গাইলে বেশ বুঝতে পারতাম লিলির সঙ্গে কাটানো আমার সেই আনন্দোজ্জ্বল মুহূর্তগুলো কিভাবে মূর্ত হয়ে উঠেছে এই সব গানের মধ্যে।
শীতের পর বসন্ত এল। কিন্তু এ বসন্তকে শহরে থেকে গ্রামাঞ্চলেই অনুভব ও উপভোগ করা যায় বেশি। কোনও নদীর ধারে ফাঁকা মাঠে কোনো নির্জন ফুলের বনে এ বসন্তের মায়াময় আবেগ সারা দেহমনে উপভোগ করা যায়। বিশেষ করে বসন্তের এই মনোরম গ্রাম্য পরিবেশ কোনও নূতন প্রেমসম্পর্কের পক্ষে খুবই অনুকূল।
আমি সাধারণত সকালের দিকটা কাব্যচর্চা বা লেখালেখির কাজ করতাম। দুপুরের দিকটায় আমাদের বাড়ির কাজ অর্থাৎ বাসার কোনও কাজের কথা বললে করে দিতাম। বাবা সাধারণত বিষয়-সম্পত্তির বা আইনের ব্যাপারে আমার সঙ্গে পরামর্শ করে উনি নিজেই সব কাজ করতেন। ওঁর নিজের আইনজ্ঞান ছিল। তাছাড়া বিভিন্ন লোককে আইনের পরামর্শ দেবার জন্য উনি ওঁর অধীনে কিছু উকিলকে রেখে দিয়েছিলেন। তাদের দিয়েই দরকার হলে কাগজপত্র সই করাতেন। আমি বেড়াতে যেতাম বিকালে এবং আমার আমোদ-প্রমোদের ব্যাপারগুলো সন্ধের দিকেই সারতাম।
এই সময় জন আঁদ্রে নামে আর একজন সঙ্গীতসাধকের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয় যে গানকে ভালোবাসত এবং যাকে আমি গান লিখে দিতাম। সে আমার গান সুর সহযোগে গেয়ে শোনাত। একই সঙ্গে এইভাবে গান ও কবিতার রস উপভোগ করতাম।
কুমারী ডেলফ নামে একটি মেয়ে লিলিদের বাড়ি যাতায়াত করত। লিলির মা তাকে ভালোবাসত। ডেলফ লিলির সঙ্গে আমার প্রেম সম্পর্কের কথা জানত। একদিন সে লিলির মার কাছ থেকে আমাদের বিয়ের অনুমতিসহ লিলিকে নিয়ে এসে আমার সামনে দাঁড় করিয়ে বলে, নাও, পরস্পরে হাতে হাত দাও।
আমি অবাক হয়ে গেলাম। মনে হলো ডেলফ যেন এক অসাধ্য অসম্ভব কাজকে সম্ভব করে তুলেছে। সে আমদের বাড়ির মতও নিয়েছে।
যাই হোক, আমরা দুজনেই হাতে হাত রাখলাম। পরে পরস্পরকে আলিঙ্গন করলাম। সঙ্গে সঙ্গে লিলির রূপটা আরও সম্পূর্ণ হয়ে উঠল আমার চোখে। সে এমনিতেই দেখতে সুন্দরী ছিল। কিন্তু তার সঙ্গে আমার বিয়ের কথা সব ঠিক হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হলো হঠাৎ সে যেন আগের থেকে অনেক বেশি সুন্দরী হয়ে উঠেছে। তখন থেকে তার দেহের প্রতিটি অঙ্গপ্রতঙ্গ, তার মনের সব সুষমা আমার, শুধু একান্তভাবে আমার।
লোকে বলে মানুষ নাকি তার আকাঙ্ক্ষিত সুখ বা উন্নতির সর্বোচ্চ চূড়ায় বেশিদিন দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না স্থিরভাবে। বিয়ের ব্যাপারে আমাদের ও লিলিদের বাড়ির সম্মতি পেয়ে আমরা দুজনেই যেন হাতে চাঁদ পেয়েছিলাম। কিন্তু আবেগের উন্মাদনার একটা দিক তলিয়ে দেখিনি। সেটা হলো আর্থিক দিক।
আমি বেশ বুঝতে পারলাম বাবা এ বিয়েতে কোনওরকমে মত দিলেও তিনি মনেপ্রাণে এ প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারেননি। কারণ তিনি পুত্রবধূ হিসাবে চেয়েছিলেন আরও অভিজাত বাড়ির মেয়ে। সুতরাং তিনি আমাকে এ বিয়ের জন্য আর্থিক সাহায্য নাও করতে পারেন। আমি তখন স্বাধীনভাবে অর্থ উপার্জনের কথা ভাবলাম। চাকরির চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু ব্যাপারটা যত সহজ ভেবেছিলাম কার্যক্ষেত্রে ততটা সহজ বলে মনে হলো না।
আমি অনেকটা দমে গেলাম। এদিকে আমার বোনের বিয়েটা সেই ক্লোজারের সঙ্গে হয়ে গেল। কিন্তু আমার বোন আমাকে বার বার লিলিকে বিয়ে করতে নিষেধ করল। কেন তা জানি না।
কেন জানি না লিলির সঙ্গে আমার বিয়েতে কোনও পক্ষের অমত না থাকলে দুটি পরিবারের মধ্যে যাওয়া-আসা বা কোনওরকম ঘনিষ্ঠতা হলো না।
ষোড়শ পরিচ্ছেদ
লিলির ব্যাপারে আমার বোনের আপত্তির কারণ হলো দুটি পরিবারের জীবনযাত্রার মানের মধ্যে বিরাট তারতম্য। আমার বোন স্পষ্ট করে আমায় বলল, তুমি কি ভেবেছ। তুমি লিলিকে বিয়ে করে এনে আমাদের পুরনো বাড়িটার একটা ঘরে ভরে রেখে দেবে? সে আধুনিক জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত নয়। সে আমাদের বাড়ির আত্মীয়-স্বজনদের ঠিকমতো অভ্যর্থনা জানাতে পারবে না।
আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম শুধু আমার বোনের কথাগুলো। কিন্তু কোনও কথা বললাম না। তাকে শুধু বললাম, এখন কিছু বলতে পারছি না। তবে তোমার কথা মনে থাকবে।
আমি সুইজারল্যান্ডে বেড়াতে গেলাম কিছুদিনের জন্য। জুরিখে গিয়ে দেখা করলাম ল্যাভেটারের সঙ্গে। আমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে সাদর অভ্যর্থনা জানাল ল্যাভেটার। দারুণ খুশি হলো। তার স্ত্রীকেও বেশ ব্যক্তিত্বপূর্ণ মহিলা বলে মনে হলো। মনে হলো ভদ্রমহিলা সব বিষয়েই সমর্থন করে চলে তার স্বামীকে। দুজনের কী অদ্ভুত মিল।
সমগ্র সুইজারল্যান্ডের মধ্যে আমার সবচেয়ে ভালো লাগল রাইনের জলপ্রপাত। এটি হচ্ছে শাকসেন পার্বত্য অঞ্চলে। তারপর যে জিনিসটি ভালো লাগল আমার তা হলো জুরিখের লেক। এই দুটি দৃশ্যই আমি জীবনে কখনও ভুলব না।
আমি ল্যাভেটারকে তার দেহতত্ত্বের গবেষণার কাজ সম্বন্ধে খবর জিজ্ঞাসা করলাম। সে বলল, কাজটা এখনও শেষ হয়নি। তবে তার প্রায় অর্ধেক লেখা ছাপা হয়ে গেছে। এতে যে সব তথ্য ও তত্ত্ব লেখা আছে তা সবই তার অভিজ্ঞতালব্ধ।
রাইনের নিম্ন উপত্যকা ধরে আমি ল্যাভেটারদের সঙ্গে নূতন করে যাত্রা শুরু করলাম। আমার ভ্রমণ তখন শুরু হয়েছে সবেমাত্র। দেখলাম ল্যাভেটারের গবেষণার কাজের সত্যিই বেশ প্রচার হয়েছে। ও যেখানেই যাচ্ছিল বহু লোক ওকে দেখতে ও ওর সঙ্গে আলাপ করতে আসছিল। অনেক বিদেশী ভ্রমণকারীও ওর নাম শুনেছে। লোকের ভিড় দেখে ল্যাভেটার নিজেও বিবৃত হচ্ছিল।